#লজ্জাহীনা #কলমে : সাহানা

#লজ্জাহীনা
#কলমে : সাহানা

বাইরের বারান্দাটা প্রশস্ত। দরজা খুলেই সারি দিয়ে ফুলের টব আর একটি টিঁয়াপাখি। করবীদেবী সকাল বিকেল এই ঘর আর বারান্দা নিয়ে অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকেন। পরিচর্যায়। বাকি সময়টা কাটে লেখালেখি নিয়ে। হ্যাঁ,  করবীদেবী একজন লেখিকা। সাপ্তাহিক এবং বাৎসরিক অনেগুলো পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছেন অজস্রবার।
লেখার টেবিলে কলমটা নামিয়ে ল্যাপটপের ঢাকাটা বন্ধ করলেন তিনি। আজ খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন, বারংবার। অনেক স্মৃতি তাঁর মনের দুয়ারে বারবার আঘাত হানছে, তাঁকে মনঃসংযোগ করতেই দিচ্ছে না!
-মা, একটু চা খাবে? বানিয়ে দিই?
পার্বতী দরজা ঠেলে তাকিয়ে উৎসুক চোখে।
-নাহ্!
-খাও না। ভালো লাগবে। দুপুরে তো কিছুই খেলে না…
-আচ্ছা,  আন্।
খুশি মনে মাথা নেড়ে চলে যায় সে। যাবার আগে দরজাটা
ভেজিয়ে দিয়ে যায়।
এ বাড়ির সবাই জানে তিনি নির্জনতা পছন্দ করেন।
করবীদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসেন। পার্বতীকে চেনেন ছোটো থেকেই। উচ্ছ্বল প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সম্প্রতি একটি অন্য জাতের ছেলেকে ভালো লেগেছে তার। কিন্তু তাদের গোত্রে ভিনদেশীর আসা নিষেধ। অগত্যা কেঁদে পড়েছে তাঁর পায়ে। পার্বতীর মা-বাবা অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকেই।
-লোকলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে, দিদিমণি।
পার্বতীর বাবা তাঁর ড্রাইভার। মা’ও রান্নার কাজে আছে দীর্ঘ দিন।
-এখন তো এসব কেউ মানে না, দয়াল। আর, ছেলেটি তো বেশ ভালো। আমি কথা বলেছি। অমত কোরো না।
তারপর থেকেই পার্বতী তাঁর সুবিধে অসুবিধের খেয়াল রাখে।
একটু বেশিই রাখে।
নিজের মনেই হেসে ফ্যালেন, চশমাটা তুলে নিয়ে …
সম্প্রতি একটি উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছেন। সামাজিক। কিছুটা জীবনীও বটে। নিজের জীবনের প্রতিফলন!
মুখ্য চরিত্র একান্নবর্তি পরিবারে দায়বদ্ধ, নিজের বিলিতি ডিগ্রী, ছবি আঁকা, গান ইত্যাদি প্যাশনগুলোর ক্রমশ গলা টিপে ধরছে সংসারের জাঁতাকল…দুই ছেলে, মেয়ে,  স্বামী, শাশুড়ি….
এত দায়িত্ব সামলেও রোজ লেখার খাতাটা টেনে বসেন। ডাইরি লেখেন। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে স্বামী এবং শাশুড়ির প্রেরণায়।
ফিসফাস যেগুলো কানে আসে, ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস পান এঁদের জন্য।
-মা, কি লিখছো?
কিশোর পুত্রের জিজ্ঞাসা।
-একটা গল্প রে।
-চরিত্রে আমাকে রেখো। পুত্রদ্বয় ছোট থেকেই বই-এর পোকা।
-হ্যাঁ রে, বাবা। সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেন।
সবটাই ঠিকঠাক চলছিল। একটি সতেজ, সুঠাম পারিবারিক ছবি। নিটেল ভালোবাসার পরিবেশ।
বাধ সাধলো কন্যাটি।
ছোটবেলা থেকেই একরোখা, বড্ড জেদী। বাবার অত্যধিক স্নেহে বিপথগামী।
কতবার বলেছেন…
-শোনো, বিপাশাকে অত আদর দিও না, একটু শাসন করো, প্লিজ। মা, আপনিও একটু শাসন করুন। নাহলে ও আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাবে যে!
-আহা, তুমি ভুল ভাবছো। ও হচ্ছে আধুনিকা। ওরকম একটু আধটু করবেই।
তখন চুপ করে গেলেও ভেতরে অন্তর্দাহ টের পান। তিনি যে মা!
বছর দশেকের মধ্যেই সংসারের চিত্রটা পাল্টায়।
ছেলেরা বিদেশে উচ্চ ডিগ্রীর আশায়। স্বামী গত হলেন হার্ট অ্যাটাকে। শাশুড়ি তার আগেই।
অতএব সংসারের রাশ তাঁর হাতেই।
কিন্তু বিপাশা?
কলেজের গন্ডী পেরোনোর আগেই নানা কুসঙ্গে পড়ে সে। একদিন…
-মা, আজ আমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসবো। আলাপ করিয়ে দেবো।
-বয়ফ্রেন্ড?
হোঁচট খান…কি করে অবলীলায় বলছে মেয়ে!
বিপাশা নির্বিকার।
বাবা তার জন্য রেখে গিয়েছেন আয়ের একটি বিরাট অংশ।
সুতরাং, হাল ফ্যাশনের গাড়ি, পোশাক এবং উদ্দাম জীবনযাত্রা তার নিত্যসঙ্গী।
সমাজ, লোকলজ্জা? এত কিছু ভাববার সময় কোথায়?
জীবন গতিশীল, এগিয়ে চলতেই হবে। মা-এর মত কলম পেশা বা ভাইদের মত ডিগ্রী অর্জনের পরিশ্রম, কোনোটাই পছন্দ নয়।
৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹
দীর্ঘশ্বাস ফেলে করবীদেবী আবার লেখায় মনোযোগ দেন। এ সমাজে স্বেচ্ছাচার এখন নিত্য অঙ্গ। যুবসমাজ স্বাধীন, উদ্দাম, জীবনমুখী। অসামাজিক যেকোন কার্যকলাপের জন্য লোকলজ্জা …..আজ কোথায়? অথচ, দুই ভিন্ন গোত্রের সজীব প্রাণকে আলাদা করতে চায় বিনা দোষে, শুধুমাত্র লোকলজ্জার ভয়ে! এ কিরকম বিচার!
অগত্যা সমাজের দায়বদ্ধতা নিতে হবে কলমকে, লেখককে এবং পাঠকসমাজকে। এই বিশ্বাসেই নাহয় এগিয়ে চলবেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *