#একটি ব্যর্থতার গল্প #কলমে : সাহানা

#একটি ব্যর্থতার গল্প
#কলমে : সাহানা

সাফল্য, কে না ভালোবাসে! সব মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য সফল হওয়া, জীবনের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো। ব্যর্থতা সেই অর্থে থাকে পেছনে, আড়ালে অন্তরালে। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, কিছু কিছু ব্যর্থতা আমাদের ভাবতে শেখায়, নতুন একটি দিক উন্মোচিত করে। আমরা ভাবি, সত্যিই তো, এমন করে তো ভাবিনি কখনও!!
৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹৹
রাস্তার ধারে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোকে রোজ খেলতে দেখি। আমার লেখালেখির টেবিলটি পশ্চিমের জানলা ঘেঁষে, বাইরেটা বেশ দেখা যায়। এই বাচ্ছারা সব পাশের বস্তিতে থাকে। ওদের বাবা-মা সবাই কাজকর্ম করে। কেউ ঠিকে ঝি, কেউ রান্নার দিদি আবার কেউ ছোটোখাটো দোকানে কাজ করে। ছেলেরা বেশিরভাগই মজুর শ্রেণীর।
এদের সংসারে নিত্যদিনের অভাব লেগেই থাকে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো তো দূরের ব্যাপার, প্রতিদিনের খাওয়াটুকুও ঠিকভাবে জোটে না।
নানা চিন্তায় ডুবে ছিলাম। হঠাৎ ..
জানলার ওপাশে একটা ছোট্ট মাথা…চোখগুলো চকচকে, এদিকেই তাকিয়ে আছে!!
পাশেই একটা বিস্কুটের খোলা প্যাকেট ছিল। কি মনে করে, সেটা বাড়িয়ে দিলাম খোলা জানলা দিয়ে। চট্ করে হাত বাড়িয়ে দিল।
-এই! কোথায় থাকিস তুই?
ঘাড় ঘুরিয়ে আঙুল তুলে দেখালো। দেখিয়েই ছুট্।
-এই! দাঁড়া, দাঁড়া বলছি!
কে, কার কথা শোনে!
এইভাবে বেশ কদিন চলল। প্রতিদিন একটা নয়, দুটো চারটে কচি মাথা সংখ্যায় বাড়তে থাকল।
আমার কাজের মহিলাটি সব দেখেশুনে মাথা নাড়ল!
-দিদি, কি করছো? অ্যাই! যা সব এখান থেকে।
-আহা! ওদের তাড়িও না। ভাবছি, ওদের লেখাপড়া শেখাব।
-সেকি গো, দিদি।
হেসেই আকুল সে। এত হাসার কি আছে! বিরক্ত হই।
-পারবে না গো দিদি। এদের পড়ানো এত সহজ নয়।
-দেখা যাক্।
সংক্ষেপে বলি।
কদিন ধরে আমার অক্লান্ত প্রচেষ্টা চলে। বিস্কুট, মিষ্টি ইত্যাদির লোভ দেখিয়ে কয়েকটি অবাধ্য মনকে একত্রিত করি।
সমস্বরে অ-আ-ই-এর রব ওঠে।
সবটাই চলছিল নিজস্ব ভঙ্গিমায়।
তারপর একদিন বেশ ভোরে ঘুম ভেঙে উঠেই শুনি অনেকগুলো গলার চিৎকার…একসঙ্গে অনেকে শোরগোল করলে যেমন হয়!
কি ব্যাপার?
নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় আসি। বারান্দার সিঁড়ি পেরিয়ে একফালি জমি, তারপর গেট। সেই গেটের একটু ওপাশে রাস্তা। বেশ কজন মানুষ এই সাতসকালে জমা হয়েছে।
আমাকে দেখে ওরই মধ্যে একজন এগিয়ে আসে। চিনতে পারি, এ হলো কার্তিক, প্লাম্বার। কাজ করেছে এ বাড়িতে।
-দিদি, আমার ছেলে আপনার বাড়িতে পড়তে আসত।
-হ্যাঁ। কিন্তু কি হয়েছে? কিছু হয়েছে কি?
-আজ সকালে উঠে ওকে পাচ্ছি না।
-পাচ্ছ না মানে?
-জানি না, দিদি। এক কামরার ঘরে তো থাকি। এপাশে ওপাশে কত খুঁজলাম! আপনার কাছে এসেছে কিনা, দেখতে এলাম।
-এত সকালে!
-তাই তো!
কথার মাঝেই এগিয়ে আসে আরও কজন। সবাই মুখচেনা। প্রত্যেকের এক কথা। এক অভিযোগ!
-তাজ্জব ব্যাপার!
ছেলেমেয়েগুলো রোজ এখানেই আসত। আজ কি হলো ওদের?
এরপর ঘটনাগুলো ঘটল খুব দ্রুত।
বিস্তর থানা পুলিস, ছোটাছুটি এবং তদন্তে জানা গেল একটি মিষ্টি চেহারার দিদিমণি নাকি খাবার, চকোলেট ইত্যাদি প্রায়ই বিতরণ করতো বস্তিতে গিয়ে। ঘটনার দিনে তাকেই নাকি দেখা গিয়েছে অনেক ছোট বাচ্ছাদের সঙ্গে! তারপর, আর কিছুই জানা নেই।
সব শুনেও মনে খটকা থেকেই গেল! ছোটো ছোটো অভাবী পরিবারের বাচ্ছা, খাবারের লোভে তারা সবার কাছে হাত পাততো। পড়াশোনা ও তো খাবারের লোভেই। কিন্তু অত ভোরে তাদের জটলা বাঁধতে দেখেও….হয়তো বস্তির মানুষ ভেবেছিল, আমারই মতো কোনো দিদিমণি ওদের ভালো কিছু শেখাবে! তাই সন্দেহ হয়নি।
ধিক্কার জাগল।
সমাজ সংস্কার করতে চাইছি, অথচ নিষ্পাপ শিশুদের জন্য কি বিপদ অপেক্ষায় আছে, জানি না। বাস্তবের রাস্তায় আমি হাঁটিনি। যদি হাঁটতাম, আমার চেহারা পরিচিত হতো, কেউ ভুল করতো না!
কি ভুলই যে করেছি! এ আমার চরম ব্যর্থতা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *