শিরোনাম_আমেণ ✒️✒️ কলমে_সাহানা

শিরোনাম_আমেণ

কলমে_সাহানা

আমানিশা আঁৎকে উঠলো। ঘরের চারপাশটা কেমন আলো-আঁধারি, অদ্ভুতুড়ে! ওপাশে ওইগুলো কি? ওই যে কালো কালো কিসব যেন চারপাশে….টেবিল ল্যাম্পের হালকা আলোটা একটা ঘেরাটোপ তৈরি করেছে….হলুদ একটা বৃত্ত চারপাশে হালকা-গাঢ়, গাঢ়-হালকা! আঁধারি আলোর ওপাশে কাচের জানলাটা একটু আগেও ভারী পর্দা টানা ছিলো। এখন খোলা। খুললটা কে?
কাচের শার্সির ওপাশে রাত কুয়াশার পাতলা চাদরটা ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে, যেন একটা ছায়া!
আজ কি বার? ওহ্! হ্যাঁ! আজ তো ক্রিসমাস ইভ। ঠিক রাত বারোটায় পাহাড়ের মাথায় চার্চটা থেকে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজবে। আর ক্রিসমাস ক্যারোল….ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে তার।
অথচ, এই কিছুদিন আগে তারা চার বন্ধু আমালিশা, লিরা, মায়া আর তনহি একসঙ্গে ওই পাহাড়ের মাথায় ছুটে চলে যেত। চার্চের সামনে ছোট্ট বাগান আর মরশুমী ফুল। চার্চ লাগোয়া ছোট্ট স্কুলে কাঠের বেঞ্চ, বোর্ড আর ফাদার। সাদা দাড়ির সেই বৃদ্ধ মানুষটি! একগাল হেসে বাড়িয়ে দেওয়া দু’হাত….
-মাই চাইল্ড!!
-ওহ্! ফাদার!
-ইয়েস মাই চাইল্ড, হোলি বাইবেল থেকে আজ তোমাদের শোনাবো…
এরপর প্রার্থনা।
একসঙ্গে মাথা নুইয়ে এক সুরে…

-খুট্!
কিসের একটা শব্দ!
ইঁদুর নাকি? না না এঘরে তো সেসব নেই!

আবার কলম তোলে আমানিশা। হ্যাঁ, ও একজন লিখিয়ে। মানে, গল্প লিখিয়ে। একটি পত্রিকার সম্পাদিকা। আজ একটি ফরমায়েসি গল্প লিখতে বসে নিজের স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ছিলো। লিখছে সেটাই। ইচ্ছে করেই আজ লেখার টেবিলের চারপাশটা অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে। জীবনে এমন কিছু ঘটনা, অন্ধকারের স্মৃতি… আঁধারে ডুবে যেতে যেতেই লিখতে ইচ্ছে করে যে!

-খুট্ খাট্!

ওই! আবার কিসের শব্দ!

কিছু না। মাথা নামিয়ে আবার টেবিলে মুখ গোঁজে। লক্ষ্যও করে না, টেবিলের পেছনে, দেওয়ালে ফুটে উঠেছে একটা আবছা ছায়া…মাথায় টুপি আর কোটের আদল….

ফাদার বড্ড ভালোমানুষ ছিলেন। বিশ্বাস করতেন সব্বাইকে। সবাই হোলি বাইবেল পড়বে। সবাই তাঁর ডিয়ার চাইল্ড।
গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় তাঁকে ঘুরতে দেখতো আমানিশা, অনেক সময় তাঁর সঙ্গে যেতো তারা চারজনই। এই গ্রুপটাকে সবাই চিনতো, ভালোবাসত। আর, কে জানতো, সেটাই হবে কাল!!
দিনগুলো কাটছিলো বেশ! দুর্দান্ত শৈশব-মাধুর্যে।
একদিন….
ছোট্ট ধুলোমাখা পাথুরে রাস্তা বেয়ে উড়ে এলো এক জিপ। শহুরে চারটি মানুষ লাফ দিয়ে নামলো। তাদের সামনেই। ফাদার দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-ইয়েস?
-আপনি এই গ্রামের বাসিন্দা? রুক্ষ লোকটি জিজ্ঞেস করে। সঙ্গীরা ততোধিক রুক্ষ। কেমন একটা দৃষ্টি মেলে দেখছিলো তাদের চারটি শিশু মুখ। মুখ? না, শরীর। এখনও মনে পড়লে কেঁপে ওঠে। সেদিনের দৃষ্টিতে মিশেছিল লোভ, কাম। তখন বোঝার বয়স হয়নি। এখন বোঝে।

দৃপ্ত ভঙ্গিতে ফাদার ওদের আড়াল করে দাঁড়ালো।
-ইয়েস মাই চাইল্ড, আমি ওই চার্চে থাকি। এরা আমার ডটারস্।
হোয়্যার আর ইউ কামিং ফ্রম?
-ডটারস্!!
হা-হা হেসে ওঠা মুখগুলো যেন জান্তব পশু!
আমরা শহরের লোক। এখানে ঘুরতে এসেছি। বলল, দলনেতা।
-ওকে, এনজয় ইওরসেল্ফ।
ফাদার পেছন ফিরে তাদের নিয়ে হাঁটা দেয়।
চলতে চলতে পেছন ফিরে দেখে আমানিশা।
লোকগুলো একইভাবে দাঁড়িয়ে!

চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র আমানিশারই ছিল দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি, পাশের গ্রামে। বাকিরা অনাথ।
ঘটনার দিন, সে ছিল সেই আত্মীয়ের বাড়িতে। ঘটনা বা দুর্ঘটনা!

কলমটা কামড়ায় আমানিশা।
দেওয়ালের ছায়াটা আরও বড়ো!
অথচ, লেখিকা খেয়াল করছে না, একলা ঘরে সে একা নয়, আছে আরও একজন। তার নৈকট্য অনুভব করেনি তখনও।

সেই দিনটায় সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ ছিল, এটুকু স্পষ্ট মনে আছে। সে লিরা, মায়া আর তনহিকে টা-টা করে ফাদারের ছোট্ট স্কুটারে চেপে চলে এসেছিল সকালেই। তার মামার বাড়ি। সারাদিন সেখানে। রাত বাড়লে ফাদারের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু ফাদার আর আসে না…মামী তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে। বলে, সকালে ফিরিস’খন।
মনটা কিন্তু কেমন যেন ব্যাকুল হয়েছিলো।
অনেক রাতে উত্তেজিত আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। টুকরো টুকরো কথা…শুধু এটুকু শুনেছিলো, ফাদার আর নেই, চার্চ পুড়ে গিয়েছে বিধ্বংসী আগুনে। কে বা কারা লাগিয়েছে, জানা নেই।
হায় ভগবান!
ফাদার আর নেই!!
কাঁদতে কাঁদতে বিছানা ভেজায় ছোট্ট আমানিশা।

আজ এতদিন পরে ঘটনাটা যেন এখনও তাজা, মনে পড়ে অথচ সঠিক কারণ কিছুই জানতে পারে নি। শুধু এটুকু শুনেছিল, কেউ বা কারা ফাদার আর তার তিনবন্ধুসহ চার্চ পুড়িয়ে ফেলেছে! ঘটনার এক সপ্তাহ পরে পুলিশি তদন্তের ঝামেলা মিটিয়ে মামা তাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সেই হোস্টেলেই বাকি পড়াশোনা এবং বৃত্তি পেয়ে উন্নতি। কলেজ, আরও উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি।
লেখার ঝোঁকে হাই ওঠে, একটু কেঁপেও ওঠে আমানিশা। ক্লান্ত মাথা টেবিলে ঠেকাতেই চোখ বুজে আসে। কিন্তু দুঃখের স্মৃতিটুকু নানা অপচ্ছায়া তৈরি করে আধা ঘুমে আধা জাগরণে….কখন যেন অশ্রুধারা নীরবে নিঃসৃত হয়ে লেখার কাগজ ভিজিয়ে চলে….

অন্তরালের কালো ছায়া এখন টেবিলের এপাশে, তার সঙ্গে জুড়ছে এক, দুই, তিন, তিনটে ছোটো মাথা……বাতি নিভেছে, মেঘের ফাঁকে একটুকরো ময়লা চাঁদ…অল্প আবছা আলোয় কলমটা সোজা চলে কাগজের ওপর….খস্ খস্ খস্….

ভোরের ত্যাড়ছা আলোটা সোজা মুখে এসে বেঁধে…ঘুম ভাঙে।
একি! লেখার টেবলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো? আর চোখও যে টানছে! ঘুমিয়ে কাঁদলে এমনটা হয়।

লেখার কাগজগুলো গোছাতে গিয়ে আরেকবার চমকে যায়! এই হাতের লেখা….তার নয়!! বড্ড চেনা…গোটা গোটা সমান মাপের ইংরিজি হরফে…

“স্বীকারোক্তি”
আমি, ফাদার বোমেলো, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আজ থেকে বিশ বছর আগে আমার কর্মস্হল যে চার্চে, সেই চার্চে ক্রিসমাস ইভে ছোটো ছোটো তিনটি অনাথ শিশুকে একলা রেখে চতুর্থ শিশুটিকে নিয়ে গিয়েছিলাম পাশের গ্রামে। সেই সুযোগে চারজন নররাক্ষস হামলা চালায়…শিশুদের রেহাই দেয় নি তারা। তাদের অপকর্ম শেষ হবার আগেই আমি ফিরে এসেছিলাম। ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম সেই রক্তাক্ত প্রাণগুলিকে….পারিনি…ধিক্বার জানাই নিজেকে…আমাকে প্রচন্ড আহত অবস্থায় ফেলে রেখে ওরা পেট্রোল ছড়ালো আর জ্বালিয়ে দিল আগুন….
শরীর পুড়ে গেল, কিন্তু আত্মা? তার যে শান্তি নেই…বিনাশ নেই…
আজ এতদিন পরে লিখছি সেই ঘটনা ……দোষীদের শাস্তি হয়নি….সর্বশক্তিমান নিজেই তাদের ভাগ্য লিখবেন…আমরা শান্তি চাই…শান্তি দাও প্রভু…

AMEN!!

থরথর করে কাঁপে হাত, কখন যেন সকাল হয়ে গিয়েছে….চার্চের প্রথম প্রার্থনার ঘন্টা……বড়দিনের শুরু যে আজ!
আজ যে যীশুদিবস!
একলা ঘরে সকালটা বড্ড করুণ লাগে আমানিশার।

(সমাপ্ত)

সত্ত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *