ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (ত্রয়োদশ পর্ব) সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (ত্রয়োদশ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

মহাসপ্তমীর দিন, নিজের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে বসে মনে পড়ছিল সেই একাদশ শ্রেণীর কথা। সপ্তমীর সকালে অঙ্ক স্যারের কাছে টিউশন ছিল। আমরা সকলে পুজোর জামা পরে গিয়েছিলাম। ওই দিন পড়তে একটুও বিরক্ত লাগেনি, বরং একটা অন্যরকম আনন্দ হয়েছিল। নতুন কাপড়ের গন্ধে ঘরে যেন পুজো পুজো গন্ধ। এদিনও তেমনই, মন খারাপের লেশমাত্র ছিল না। মিটিং ও শেষ হয়েছে আগের দিনই। কলিগ দাদার সাথে বেরিয়ে পড়লাম গনেশগুড়ি নামক স্থানের উদ্দেশ্যে। খোদ রাজধানী দিসপুরের একটা জায়গা হলো গনেশগুড়ি। ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলেছি। দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে সেখানেই। নর্থ-ইস্টের বিখ্যাত লঙ্কা ভূত জলোকিয়া। অসমীয়া ভাষায় জলোকিয়া অর্থ লঙ্কা। ইংরেজিতে যদিও ভূত কথাটির প্রতিশব্দ ঘোস্ট ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু ভূত কথাটি আদতে ভূটান শব্দটির অপভ্রংশ। ক্যাপসিকাম চাইনেন্স ও ক্যাপসিকাম ফ্রুটেসেন্স এই দুটি লঙ্কার সংকরায়নে এই লঙ্কাটির সৃষ্টি। ২০০৭ এ লঙ্কাটি সবচেয়ে বেশি ঝাল লঙ্কা হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছিল। তবে বর্তমানে তার স্থান বিশ্বে তৃতীয়, ক্যারোলিনা রিপার ও ত্রিনিদাদ স্করপিয়ন বুচ টি পেপার এর পর। লঙ্কার ঝাল এর পরিমাণ বোঝাতে এর স্কোভাইল স্কেল বিবেচনা করা হয়। ভূত জলোকিয়ার ক্ষেত্রে যা 1,001,304 SHU… দাদা দরদাম করে কিছু এই লঙ্কা কিনলো। আমি ততক্ষণে দেখতে লাগলাম আর কি কি আছে দোকানীর পসরায়। ছোট্ট সাদা বেগুন, সাধারণ লঙ্কা, আমলকী, কলা, আনারস, শশা, রসুন, আদা, ফুলকপি, চালতায় সেজে উঠেছে দোকান। পরের দোকান শুধুই শাকের। ঢেকি শাক, আমেরিকান পালং, কলমী, রসন শাক, কুলেখাঁড়া, কচুশাক, পুদিনা পাতায় সবুজে সবুজ। পরের দোকানে হরেক রকম জিনিস। শিউলি ফুল, বক ফুল, কলা ফুল থুড়ি, ফুল বলতে বলতে কলা ফুলের যে আর একটা নাম আছে সেটাই বলিনি, মোচা। এর সাথেই দেখলাম কিছু কালো কালো শুকিয়ে রাখা জিনিস। জিজ্ঞেস করলে বললো টেঙা। অসমীয়া ভাষায় টেঙা মানে টক। এখন কিসের টক তা আর বলছে না। বুঝলাম ওরা সব টককেই টেঙা বলেই ক্রয় বিক্রয় করে। তবে কেঁটে শুকিয়ে রাখা ওই বস্তু গুলো সম্ভবতঃ চালতাই হবে। অর্থাৎ অসমীয়াতে ‘ঔ টেঙা’। এরপর আর একটু এগোতেই কানে এলো ঢাকের বাদ্যি। দিসপুর বারোয়ারী পূজা সমিতি ও জ্যোতি কলা কেন্দ্রের পুজো দেখে মনে হলো যেন কোন এক বনেদি পরিবারের পুজো। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে চলে এলাম একটা জামাকাপড়ের দোকানে। দাদা দুই সেট মেখলা কিনলো বৌদি ও ছোট্ট কুর্চির জন্য। তারপর একটা গয়নার দোকানে গিয়ে ম্যাচিং গয়না কিনে ফেরার বাস ধরলাম। খেতে হতো, কিন্তু ভালো খাওয়ার দোকান পাচ্ছিলাম না। অগত্যা বাসে চেপে বসা। এদিকে কিছু দূর যেতেই বুঝতে পারলাম ভুল ডিরেকশনের গাড়িতে উঠেছি। নেমে গেলাম। কিছুটা হাঁটা ছাড়া গতি নেই। আমি দাদাকে বললাম যে নিশ্চয়ই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। চারপাশে খেয়াল রাখতে হবে খাওয়ার হোটেল চোখে পড়তে পারে। যেমন মনে করা তেমনই হলো। রাজমহল ভোজনালয় চোখে পড়লো। ওই ভর দুপুরেও বেশ ভীড়। পুরো প্যাক্ট আপ দোকানঘর। বাইরে চেয়ারে অপেক্ষায় আরও অনেকে। আমরাও একটু অপেক্ষা করলাম। বুঝলাম বেশ ভালো দোকান না হলে এত ভীড় হওয়ার কথা নয়। অসমীয়া থালির সাথে হাঁসের মাংস সহযোগে অসাধারণ লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে এলাম। দেখা গেলো আর কিছুটা হাঁটলেই গেস্টহাউসে পৌঁছানো সম্ভব। তাই অন্য যানবাহনের আশা না করে এগিয়ে চললাম। তাজ ভিভান্তা হোটেলের পর কাঠের ওভারব্রীজটি অতিক্রম করলাম। করে ফেললাম একটা ছোট্ট ভিডিওশ্যুট। “হাম জো চলনে লাগে/ চলনে লাগে হ্যায় ইয়ে রাস্তে/ আ হা হা/ … মঞ্জিল সে বেহতার/ লগ্নে লগে…” ফেরার পথে চোখে পড়লো ছোট ছোট কাচের বাউলে রঙীন মাছেদের দিয়ে পসরা সাজিয়েছে এক দোকানী। গরম সেই দুপুরে তা দেখে যেন মনে এক শীতল স্পর্শ পেলাম। এরপর রুমে একটু রেস্ট নিয়ে সেই সময়ের সম্মুখীন হলাম যখন কলিগ দাদাও ফিরে যাবে তার বাড়ি। আমি রয়ে গেলাম। কিছু কাজ তখনও রয়েছে বাকি। পরদিন অর্থাৎ অষ্টমীর সকালে বেরিয়ে পড়লাম অফিসের উদ্দেশ্যে। সাড়ে ন’টায় পৌঁছতে হবে। অফিসের প্রায় সবাই ছুটিতে। কেউ বা ফিল্ডে ব্যস্ত। এক কলিগবন্ধু এলো মঙ্গলদৈ থেকে। ওর সাথে হারবেরিয়ামের কাজ করতে করতে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। লাঞ্চের সময় ওর স্কুটিতে করেই গেলাম নিকটস্থ রেস্তোরাঁয়। চিকেন ধোসা কোনদিন খাইনি তাই সেটাই অর্ডার করে দিলাম। বেশ ভালো লাগলো। তারপর আবার পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। প্রথম দিন, তাই আসার সময় উবের বুক করেছিলাম। যাওয়ার সময় কলিগ বন্ধু পৌঁছে দিল জয়গুরু বাস স্টপে। সেখান থেকে অটোতে করে জালুকবাড়ি। সেখান থেকে বাসে করে খানাপাড়ায় ফেরা। খানাপাড়া থেকে জয়গুরু ২৫ কিলোমিটার হলেও বাসের ভাড়া ৫০ টাকা। যানবাহনের ভাড়া খুবই বেশি এই রুটে। পরদিন অর্থাৎ নবমীর দিন আবারও অফিস। এবারে কিছুটা চেনা হয়ে যাওয়ায় বাসে করেই পাড়ি দিলাম। জালুকবাড়ি থেকে অটো নামিয়ে দিল জয়গুরুতে। তারপর বাকি পথটা অর্থাৎ জয়গুরু থেকে আইআইটি গেট ও সেখান থেকে আমার অফিস প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে গেলাম। তার ফলে যে অপূর্ব সৌন্দর্যের সাক্ষী থাকলাম সেসব ধরা থাকলো ক্যামেরার ভিডিওতে। অফিসিয়াল কাজ শেষে কলিগবন্ধুর সাথে ফিরছি। ফিরতি পথেও ভিডিওগ্রাফী চলছে। আগিয়াঠোরি স্টেশনের ফ্লাইওভারের ওপর উঠতেই সোনা রোদ এসে লাগলো চোখে। কলিগ বন্ধু নিজে থেকেই আমার ছবি তুলে দিল। একটা ট্রেন চলে গেল হুইস্‌ল্ বাজিয়ে। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মামণিকে একটা ভিডিও প্রেজেন্ট করতে হবে। আর তার জন্য আজকের দিনটি সেরা। জয়গুরু থেকে খানাপাড়ার ডাইরেক্ট বাস পেয়ে গিয়েও নেমে পড়লাম ব্রহ্মপুত্র ব্রীজের এপারে। তখন অস্তমিত সূর্য খেলে বেড়াচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের জলে। দুই কিলোমিটার ভিডিও করতে করতে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কত নৌকো এলো গেলো… ব্রহ্মপুত্র শান্ত হলো। গায়ক পাপনের “নমামী ব্রহ্মপুত্র” সুরে পরে সাজাতে হবে সেই ভিডিও। আরও দুই কিলোমিটার হেঁটে জালুকবাড়ি পৌঁছালাম। সেখান থেকে বাসে খানাপাড়া। দশমীতে ছুটি। মনে মনে প্ল্যান করছি মেঘালয়ের উমিয়াম লেক ঘুরে আসবো। আগে দূর থেকে দেখলেও ঘোরা হয়নি। মাত্র ৭০ কিলোমিটার পথ। একটু খোঁজখবরও নিয়ে এলাম। কিন্তু বাড়িতে জানাতেই মা বারণ করলো, বাধ্য ছেলের মত শুনলাম। অগত্যা সারাদিন গেস্ট হাউসের বাইরে বের হইনি। শহরের মধ্যেও ঘোরা যেতে পারতো গুয়াহাটি চিড়িয়াখানা। কিন্তু জ্যামের কথা চিন্তা করে সেটা থেকে বিরত থেকেছি। আসা যাওয়ার পথে চোখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক ভ্রমণে এসে দেখা বালাজী মন্দির। সন্ধ্যায় ঠিক করলাম কাঠের ওভারব্রীজেই সময় কাটাবো। এর আগেরদিন দিনের আলোয় ভিডিও করেছিলাম। যেমন ভাবা চলে এলাম সেখানে। ভিডিও করতে করতে মনে হচ্ছিল… “আজ কি রাত, হোনা হ্যায় ক্যা… পানা হ্যায় ক্যা… খোনা হ্যায় ক্যা…” একদম একটা স্বপ্নের মতো রাত… একটু পরেই বিসর্জনের সুর বাজিয়ে মা দুর্গা ফিরছেন কৈলাশে। এক ট্রাক ভর্তি লোক। দেখা হয়ে গেল বিভুঁইয়ে আমার দ্বিতীয় দুর্গা প্রতিমা। “আসবে আবার মা বছর পরে/ দুচোখ তবু হায় জলে ভরে/ আসবে মা লক্ষ্মী কদিন পরে/ মন যে তবু হায় কেমন করে…” সত্যিই মন খারাপ আর স্বপ্ন রাতের অনুভূতি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। আরও দুদিন থাকবো এখানে। সে গল্প না হয় অন্য পর্বে করবো।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *