মিরুজিন আলো ✒️✒️ বিজয়া দেব

পর্ব ছয়
মিরুজিন আলো
বিজয়া দেব

পারুল রাতে এলো, এলো লোকেশ, যে জগুর মা নয়নাকে বাড়ি যেতে সাহায্য করেছিল। এদের কথাগুলো এ বাড়ির মা – এর আদরযত্নে চাপা পড়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। মা সব বোঝে, বোঝে তার কষ্ট। জুহি বোঝে না। তাকে ভালবাসে, তবে তার অতীত সবটুকু জানতে চায়।
জগু সে, তার মা নয়না তার নাম রেখেছিল জগবন্ধু। তারামাসি, মানে মহল্লার যে মাসিটা মাকে খুব ভালবাসত, সে নাকি বলেছিল – ওসব নাম রেখে কি করবি? জগু বলেই ডাক। ওসব পোশাকি নাম আমাদের কি সাজে? কী কাজ করবে দ্যাখ! জগতের বন্ধু হওয়ার কাজ করার সুযোগ পেলে তো! ওসব নাম ঠাকুর দেবতাকেই সাজে, বুঝলি? তবু মা ইশকুলে জগবন্ধু নামটি লিখিয়েছিল। সে আর জগতের বন্ধু হবে কোথা থেকে! জগতের কেউ যদি তার বন্ধু হত তাহলে সে হয়ত বেঁচে যেত। তাই বা কোথায় হল! সর্বত্র তাকে দূর ছাই শুনতে হয়েছে। তার মাঝেই আছে লোকেশ আছে পারুল। এখন তার চারপাশে লোকেশের ছায়া। বলছে – দুনিয়ায় মানুষেরা আসে, কেউ দুনিয়াটাকে কত সুন্দর করে দেখতে পারে, দেখার সুযোগ পায়, আর কেউ অন্ধকোণে আটকে থাকে। দুনিয়াটা কারো কারো জন্যে তার আলোহাওয়ার খোলা দরজাটার আগল বন্ধ করে রেখে দেয়। তাকে বলে – এসব তোর জন্যে নয়। তোর জন্যে লাথিঝ্যাঁটা, তোর জন্যে গলিঘুঁজি। রাজপথ তোর জন্যে নয়, তোর জন্যে হৈ হল্লা, তোর জন্যে মোদো মাতাল। চাঁদনি রাত তোর জন্যে নয়, তোর জন্যে তোষামুদি, তোর জন্যে কাঁচা মেয়েদের পথ ভোলানো।
জগু, তোর মা-কে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। নযনা যখন সময় পেত পেছনের জলার ওপরে যে ব্রিজটা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতো আমাকে নিয়ে। কাঁদত আর বলত – আমি গাঁয়ে ফিরে যেতে চাই লোকেশদা। বাবা মা-র কাছে যেতে চাই। আমার বাবা মা আমাকে হারিয়ে হয়ত শোকে পাগল হয়ে গেছে। আর ছোট ভাইটা? সে তো দিদি ছাড়া কিছুই বুঝত না। লোকেশদা, আমাকে পালাতে হবে, যে করেই হোক। আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছি  – ওখানে গেলেই কি আর আগের জায়গা ফিরে পাবি? আগের মত কি আর সবকিছু থাকবে? কিন্তু না। সে কিছু বুঝতে চাইত না। তাকে একদিন গভীর রাতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলাম। ঐ পানের দোকানি হারু দেখে ফেলেছিল। তখন তোর মায়ের বাবুদের কাছে খুব কদর। পরদিন থেকে যখন আর তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, চারদিকে খোঁজ খোঁজ পড়েছে তখন হারু আমার কাছে মোটা টাকা চাইল। নাহলে সে সব বলে দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল। ঐ যে কী বলে ব্ল্যাকমেল না কি তাই করছিল। হাজার টাকা দিতে হবে নাহলে সে সত্যি কথাটা বলে দেবে। পারলাম না দিতে সুতরাং বলে দিল সব। তারপর শুরু হল মার। সে কি মার। হঠাৎ বুঝলাম আমার বায়ুদেহ ঐ ব্রিজের ওপরে পলকা হয়ে উড়ছে। দুদিন পর দেখি তোর মা এসে মহল্লায় ঢুকছে। ভাবলাম, না পারলাম নয়নাকে বাঁচাতে না পারলাম নিজে বাঁচতে। তবে একটা কালো জীবন ছিল তার থেকে অবশ্যি রেহাই পেলাম।
লোকেশ চলে গেল। মানে এক পেলব আলোর ভেতর মিলিয়ে গেল।
এবার জগু দেখল পারুল এসে দাঁড়িয়েছে। হালকা আবছা আলোয় তার অবয়ব এক অস্পষ্ট মেদুর আলোময় বৃত্ত তৈরি করেছে। জগু লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
পারুল বলল – কেমন আছো জগুদা? এরা তোমায় ভালবাসে? ঐ জুহি? ঐ দেবাংশী? আমি তো ছায়াশরীরে তোমার কাছাকাছি থাকি। তোমাকে নিয়ে বড় চিন্তা আমার। এভাবে বেঁচে কী লাভ বলো জগুদা? তার চাইতে এখানে চলে এসো। এখানে তোমাদের ঐ কষ্টের বেঁচে থাকার লড়াই নেই। কারোর মুখোমুখি জবাব দেবার নেই। অত কৈফিয়ৎ দেবারও কিছু নেই। চলে এসো জগুদা।
জগু দেখছে এক পেলব আলোর ভেতর ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে পারুল। হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঐ আলোর বৃত্তে ঢুকতে চাইল জগু, কিন্ত পারল না, শক্ত কিছুর ঠুকে গেল মাথা। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে দেখল ভোর হয়ে আসছে। খাটের বাজুতে তার মাথা ঠুকে গেছে।
পাখিদের কাকলি শোনা যাচ্ছে। আঁধার কেটে স্বচ্ছ প্রকৃতির প্রকাশ তাকে যেন বলছে – এসব কিছু তোমার, তোমারই। শুধু তোমাকে নিতে জানতে হবে। সব বাঁধন কেটে নিজেকেই বেরোতে হবে।
ঘুম ভাঙ্গল জগুর।কিন্তু মনে হল যারা এসেছিল তারা মোটেই স্বপ্ন নয় – তারা আছে খুব কাছাকাছি। লোকেশ তাকে দেখছে। পারুল তাকে ডাকছে। তাকে কাছে পেতে চাইছে। তবে এই পেলব প্রাকৃতিক আলোর ডাক আরো জোরালো।
দরজা খুলে বাগানে ঢুকল জগু। তার হাতে লাগানো গাছগুলোর পাতায় পাতায় শিশিরবিন্দু ঝলমল করছে। কিছু শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে। একটা বুলবুলি বসেছে সামনের গাছটির নিচুডালে। খুরপি হাতে নিয়ে মাটি কোপাতে থাকে জগু। হাতে মাটির গন্ধ মাখে, হাতে মাখে শিশিরের সজীবতা। ফিসফিস করে বলে – রাগ করিস না পারুল।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *