#ফেসবুক কবিতার ভবিষৎ ✒️✒️তাপস

#ফেসবুক কবিতার ভবিষৎ
✒️✒️তাপস
এখন জালময় পৃথিবী। জ্বালাময়ও বটে। অন্তর্জাল অর্থাৎ ইন্টারনেট আর শব্দজাল আজকাল মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। লোকের এখন সময় কম অথবা ধৈর্য কম। ফেসবুকে কথায় কথায় চমৎকার, অনবদ্য শব্দের স্রোত।
ধরুন কবিতা পোস্ট করলেও চমৎকার, শরীর খারাপের কথা পোস্ট করলেও চমৎকার। উপরে কি লেখা আছে পড়ার দরকার নেই,ইচ্ছেও নেই, ছাই-পাশ সব কিছুতেই বেশ চমৎকার। চমৎকার এই ভার্চুয়াল দুনিয়া। শুধু চমৎকার শব্দ বেঁচে থাকে তার চমৎকারিত্ব নিয়ে। ফেসবুকে এখন আবার প্রবল সংস্কৃতির চল হয়েছে। সবাই কবিতা লিখছে, গল্প লিখছে, গান করছে, নাচ করছে। সব প্রতিভা ফটাফট ফেসবুকের দেয়ালে ঘুঁটের মতো সাঁটিয়ে দিচ্ছে, সঙ্গে একটা ছবি। বিগতযৌবনা নারী এমন কায়দায় ছবি দিচ্ছে যে বছর পঁচিশের যুবক পর্যন্ত নড়েচড়ে বসছে। যে নারী এবং নাড়ির পার্থক্য বুঝতে পারে না, সেও প্রকাশককে টাকা দিয়ে বই বের করে ফেলেছে। কোনসময়ে নাম হয়েছিল এমন লেখককে ধরে বই-প্রকাশ অনুষ্ঠান, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট। মহিলা কবি হলে তিনশো like, পুরুষ হলে দেড়শো। ওই বই কে কিনবে ?? কেউ না !! Boss কে উপহার দেওয়া হবে, শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়িতে হাসি হাসি মুখ করে দেওয়া হবে, দু’চারটে পাড়ার বন্ধু-বান্ধবকেও দেয়া যেতে পারে। তারপর পড়ে থাকল সত্তরটা বই। আরশোলার বাসা, পিঁপড়ের ডিম পাড়ার জন্য। ধূলো জমে কবি আর কবিতা দুটোই লোপাট। কিন্তু যে করে হোক, বিখ্যাত হতে হবে। কথায় বলে লেখাপড়া। এঁরা শুধুই লেখেন, পড়েন না। পড়বে মূর্খরা, আমি তো জন্ম-প্রতিভা এরকম একটা ব্যাপার। প্রতিভা হাঁড়ি চাপা দেওয়া ছিল, ফেসবুক এসে ঢাকনা খুলে দিয়েছে। প্রতিদিন প্রতিভা উপচে-উপচে বেরিয়ে আসছে। উপচে বেরিয়ে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সুগন্ধ অল্প, দুর্গন্ধই বেশি। স্বামীজী বলে গিয়েছিলেন – ” চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয় না। ” স্বামীজী এখন পোস্টার হয়ে গেছেন। সামনে তাঁর বাণী আর পিছনে কাট-মানি। সবাই সবকিছু পারে না, এটা কেউ মানতে পারছে না। ঘোষ-গিন্নি কবিতা লিখে কবি হয়ে গেছে সেটা বোসবাবু মানবে কেন ?? তিনিও লিখতে বসলেন। কিছু হচ্ছে না, তাতে কি সমস্যা?? জাল ছড়িয়ে কবিতা নিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দাও। মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কা তো থাকবেই। একজন কবিতা ঝাড়তে গিয়ে রবি-দাদুর কবিতাই ঝেড়ে দিলে, কি কেচ্ছা। ঝাড়তে ঝাড়তে কবির স্বরচিত রবীন্দ্র-কবিতা – ” মাঝে মাঝে তব দেখা পাই।” গুরু, তোমার দেখা না পেলেই ভালো হত, তাহলে কবিগুরুকে পেতাম। সৃজন করা অত সহজ কাজ নয়, তাতে মগ্নতা লাগে, ধৈর্য লাগে, শ্রম লাগে। কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না, এটা ভারি সহজ সত্য। সস্তায় কিস্তিমাত করতে গেলে খিস্তি ছাড়া কিছুই জুটবে না। অবশ্য ফেসবুকে কেউ কাউকে গালি দিতে চায় না। আমি তোমার পিঠ চুলকাবো, তার বদলে তুমি আমার পিঠ চুলকাবে। তুমি চমৎকার লিখলে আমি অসাধারণ লিখবো। গ্রুপ থেকে সন্মাননা দেওয়া হবে, সেই সন্মাননা আবার ফেসবুকের ওয়ালে ছাপা হবে, সবাই লিখবে অভিনন্দন। মাঝে মাঝে খুচরো কিছু কবি-সম্মেলনে যোগদান। পিছনে বসে ফ্রিতে চা- বিস্কুট প্যাদানো। কোন বিশিষ্ট কবি সেই সম্মেলনে উপস্থিত হলে তাঁর সাথে সেলফি। আবার সেই ছবি ফেসবুকে পটাপট সাঁটিয়ে দিলেই মন্তব্যের ঝোড়ো হাওয়া। কবি-পক্ষ সম্পূর্ণ। আবার কবি হলেএকটু আধটু চরিত্রহীন না হলে চলে না। এদিকে ওদিকে বিপরীত লিঙ্গকে মেসেঞ্জারে টুক করে hi লেখা। ওদিক থেকে উত্তর পেলেই ” আমাদের যাত্রা হলো শুরু “। কিন্তু এই যাত্রা তো গন্তব্যহীন। সম্পর্কের গাড়ি খাদে পড়লেই দোষারোপ শুরু। তখন কামড়া-কামড়ির বহর দেখলে রাস্তার কুকুর পর্যন্ত ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাবে। কবির লড়াই তখন খেউরে পরিণত। কবিতা চুলোয় যাক, কলতলার ঝগড়া শেষে কবি আর কবিতার প্রাপ্তি শূণ্য।
শহরে শান্ত সন্ধ্যা নামে। সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় কোন এক প্রতিভাবান কবি জানলা ধারে বসে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে কবিতার খাতা। তাঁর ছেঁড়া কবিতাগুচ্ছ জড়িয়ে যায় ট্রামের চলন্ত চাকায়।
✍️ তাপস