সায়াহ্নের আলোয়… ✒️✒️ দুলাল কাটারী

সায়াহ্নের আলোয়…
দুলাল কাটারী

রুবেলা সেদিন রিসোর্টের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎই সফিকুলের বাড়ি ফিরে যাওয়া প্রত্যক্ষ করলো।
কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে আবারও এগিয়ে চললো।
এটা যে তাদের প্রথম দেখা তা কিন্তু নয়।বরং মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। কোনো দিন দু’একটা ভাব বিনিময়ে মিনিট খানেক সময়ও কাটে,কোনো দিন আবার সেটাও হয় না; ওই ঘাড় নেড়েই চলে যায় একে অন্যের গন্তব্যের দিকে।তবে সেদিন কেবলমাত্র রুবেলার’ই নজর পড়লো সফিকুলের দিকে। সফিকুলের নজর রিসোর্টের উন্মুক্ত গেটের দিকে একদমই গেলো না। নজরে পড়লে হয়তো এড়াতে পারতো না।আজ একটা দুটো কথা অবশ্যই হতো।কারণ কয়েক দিন আগে রুবেলার দেওয়া প্রস্তাবটা নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সফিকুল সেটা অবশ্যই জানা দরকার ছিলো রুবেলার।
এদিকে তার মা তানিয়াও বিচলিত মনে বেশ উন্মুখ হয়ে আছে ক’দিন ধরেই। সে মেয়েকে অনেক বার নিষেধ করার পরও মেয়ে যে এমন একটা প্রস্তাব সফিকুলকে দিয়ে বসবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারে নি।সফিকুলের স্ত্রী,দুই ছেলে, এক মেয়ে,এক বৌমাকে নিয়ে তার এখন ভরা সংসার।এমনকি বড়ো ছেলের তো একটা বাচ্চাও আছে।এমতাবস্থায় তার পক্ষে বিয়ে করা বা প্রেমিকাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া কতটা অসম্ভব তা রুবেলার মা তানিয়া খুব ভালো করেই জানে।সেটা লন্ডনই হোক বা ঢাকা,কলকাতা’ই হোক বা বাংলার কোনো গ্রাম ; যেখানেই হোক না কেন। কত রকমের যে বাধা আসে সেটা কি তানিয়ার অজানা? সামাজিক বাধা তো আছেই; স্ত্রী, ছেলে,মেয়ে, বৌমা সবার থেকেই বাধা আসবে। তাছাড়া বৌমার বাপের বাড়িতে তো হইহট্টগোল পড়ে যাবে।বলবে ‘তোর সাতচল্লিশ উর্ধ শ্বশুর আবারও বিয়ে…’ ছি! ছি! বলতেই কেমন মুখে বাধছে। আর ধর্ম! ধর্মের’ই বা কি হবে? ধর্ম গেলো, ধর্ম গেলো রব উঠে যাবে চারিদিকে!হোক না লন্ডন! লন্ডনে থাকলেও পরিচিত লোকজন,মানে যারা কথা শোনাবে তারা তো সব আত্মীয়’ই।সুতরাং তাদের অপমান থেকে মুক্তি কি করে পাবে সফিকুল বা তার এখনকার পরিবার; এটা রুবেলার মতো একটা বিচক্ষণ মেয়ে কিভাবে তার বিচার বিশ্লেষণ এর আতস কাচের তলায় ফেলে না দেখে, মুর্খের মতো সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলো সফিকুলকে!
এদিকে সফিকুলের মনটাও তানিয়ার কথা ভেবে মোচড় খেয়ে খেয়ে ওঠে মাঝে মাঝেই। কখনো কখনো ভাবনা গুলো সীমা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনের অলিতেগলিতে ঘুরে বেড়ায়, আবারও কখনো লন্ডন থেকে বাংলাদেশের শস্যশ্যামলা গ্রামের প্রান্তরে প্রান্তরে স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চায়। কতোই না বাল্য প্রেমের আবেগ মিশে ছিলো এই গ্রাম বাংলার প্রতিটি কোণে কোণে। হলুদ বিকেলে সর্ষে ফুলের পাপড়ির মতো মেয়েটিকে যখন আবেগি বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেত এদিক থেকে ওদিকে ; এমন কোন প্রেমিক আছে যে তার রূপের ও সৌন্দর্যের কাছে আত্মসমর্পণ না করে বাড়িতে বসে ইনডোর গেমে মজে থাকবে! যদিও তখনকার দিনে ইনডোর গেমের ততটা প্রাচুর্য ছিলো না, যতটা আজকের মোবাইলের যুগে এসেছে। এখন তো আর মনেই হয় না কেউ এভাবে পাগলের মতো প্রেমে পড়ে। দুচার লাইন কল্পনার আকাশে উড়ে যাওয়ার কথাও হয়তো এখনকার ছেলেমেয়েরা আর ভাবে না। তাছাড়া আমি এতোটা সিওরও নই কেউ আগের মতো করে প্রেমে পড়ে কিনা।কেননা এখনকার ছেলেমেয়েরা খুব চাপা স্বভাবের। ওদের যাকিছু সব ফোনেই হয়। কারো স্যাড স্ট্যাটাস দেখলে তবেই বোঝা যায় যে এতো দিনে তার কপাল পুড়েছে।
যাইহোক তানিয়া আর সফিকুলের প্রেম প্রাণবন্ত হলেও তা কিন্তু পরিনতি পায় নি। তবে পরিনতি দেওয়ার চেষ্টা যে কম করেছে তাও কিন্তু বলা যায় না। প্রথম যখন গ্রামের লোকজনের কাছে জানাজানি হলো বিষয়টা, দু’কথা চার কথা উভয়েরই অভিভাবকদের কানে ঢুকে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এটা তো আর নতুন কিছু না! তবুও সফিকুলের বাড়ির লোকজন ওদের সম্পর্কের পরিনতি দেওয়ার বিষয়ে একটু বেশিই আগ্রহী ছিলো বলা যায়।তাছাড়া বাড়ির ছেলে প্রেম হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাক এটা তো কোনো সুস্থ অভিভাবক’ই চাইবে না। কিন্তু ছেলের তেমন রোজগার নেই বলেই মেয়ের বাড়ির আপত্তিটা খুব জোরালো ছিলো। এবং পৈতৃক সম্পত্তিও নামমাত্র,কিভাবে বিবাহিত সংসার চলবে!তাই এতোটাই জোরালো আপত্তি যে তা উপেক্ষা করে সংসার পাতা সম্ভব হলো না তাদের। সুতরাং তানিয়ার জন্য দ্বিতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধ দেখা এবং তার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠলো এবং হলোও তাই।
হতভাগা সফিকুলের পক্ষে এই যাতনা যে অসহনীয় হবে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।নিজ এলাকায় প্রেম করে তাকে যদি না পাওয়া যায় তার যন্ত্রণা যে কী অসহনীয় তা বলে বোঝানো যাবে না!পাত্রী দেখতে আসা থেকে বিয়ের আয়োজন,আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা থেকে পাড়া-প্রতিবেশির উপহাস, বন্ধুবান্ধবদের রস-রসিকতা সবকিছুই পাথরের মতো সহ্য করতে হয় প্রেমিককে।প্রেমিকার কথা ততটা বলতে পারবো না, মনে হয় সে মনে মনে গুমরে মরে অথবা তার বুকফাটা রক্ত চোখ দিয়ে বর্ণহীন জল রূপে বেরিয়ে আসে।আত্মীয় স্বজনরা বলে ‘বাবা- মার ঘর ছেড়ে যাবে চিরকালের মতো, তা একটু-আধটু না কাঁদলে কী হয়! কাঁদো, কাঁদো… এই তো ক’টা দিন মোটে কাঁদবে।বাকি জীবনটা শুধুই সুখ আর সুখ।’
আসলে আমাদের সমাজে আজও মেয়েদের বিয়েতে মেয়েদের যে কতটা সম্মতি থাকে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। পাত্র পক্ষ দেখে যাওয়ার পর যদি পছন্দ হয়েছে বলে জানিয়ে দেয় তাহলেই যেন মেয়ের বাবা-মার সম্মানের বিষয়টা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।তাছাড়া কথা দেওয়ার বিষয়টিও থাকে।আর ছেলেটা যদি একটু সম্ভ্রান্ত পরিবারের হয় তাহলে তো হয়েই গেলো!বাড়ির মেয়েরা এমনকি পাড়াপড়শি মেয়েরাও এমন ভাবে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে কন্যার সুখ ভোগের বিষ টা কানে ঢালতে থাকে, তাতেই তার জীবনের প্রায় অর্ধেক সুখ ভোগ করা হয়ে যায়।
যাইহোক, কথায় আছে না মেয়েদের বিয়ে হয়; আর ছেলেরা বিয়ে করে। হোলও তাই।মেয়ের বিয়ে হলো।

যত কঠিন প্রেমিক’ই হোক না কেন এই বিশেষ দিনটিতে সে কিছু সঙ্গী খুঁজে বের করে নেয়।এবং এলাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করে। বন্ধুরা কেউ কেউ দুটো ভালো-মন্দ কথা বা মনগড়া কথা বলে বা দার্শনিক তত্ত্ব দিয়ে এই প্রেম হারানো প্রাণটিকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কেউ বা একটু আধটু মদেরও ব্যবস্থা করে দেয়। এটা চিরকালই হয়ে আসছে সুতরাং এ বিষয়ে বেশি কিছু বলবার দরকার নেই।
কিন্তু যেটা বলতেই হবে সেটা হলো সফিকুল কিন্তু কিছুতেই এলাকায় মন বসাতে পারছে না।যেটুকু সংসারের কাজে বা চাষের কাজে অংশগ্রহণ ছিলো তাও যেন অসহনীয় হয়ে উঠছে।সে যেন সব কিছুতেই তার তানিয়াকেই খুঁজে পায়। কিন্তু হায়,সে কই! সে তো স্বামীর সংসারে বাসন মাজছে, কাপড় কাচছে, রান্নাবান্না নিয়ে সুখে সংসার করছে।চাকরিওয়ালা বর পেয়েছে সুখেই বা থাকবে না কেন!
আর মনে হয় বিকেল-খেলায় মাতে না,অথবা অভিমানী হয়ে প্রেমিক সফিকুলের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে না উঠোনে পড়ন্ত বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে অব্দি।

কতদিন আর দেউলিয়া হয়ে ঘোরা যায়!কতই বা স্মৃতির যন্ত্রণাদায়ক কামড় সহ্য করা যায়!
দূর সম্পর্কের কাকুর সঙ্গে লন্ডনে কিছু একটা কাজের খোঁজে চলে গেলো সফিকুল।যাহোক একটা কিছু কাজের মধ্যে থাকলে মনটা কিছুটা ভালো থাকে। তাছাড়া তানিয়ার স্মৃতি মাখা সর্বজায়গা এবং সর্বক্ষণ সফিকুলকে অস্থির করে দিচ্ছিলো।সকালে বিকেলে সারাদিনে কতবার যে দুজন দুজনকে দেখতো, কত রাগ অভিমান লেগে ছিলো চোখের তারায় তারায়,এসব ভুলে থাকা বা এড়িয়ে থাকা কি করে সম্ভব!

এদিকে বছর ঘুরতেই তানিয়া রুবেলাকে পৃথিবীর আলো দেখালো।বাপের বাড়িতে এলো মেয়েকে নিয়ে। এখনও তার সফিকুলের কথা শুনতে ভালো লাগে। সত্যিই তো, যে ছেলেটা এতো দিন তেমন কিছুই করতো না সে এখন লন্ডনে কাজে মন দিয়েছে, বাবা-মার সংসারে টাকা পাঠাচ্ছে এমন সাফল্যের কথা শুনলে প্রেমিকার হৃদয়ে মন খারাপ করে দেওয়ার মতো ভালো লাগার সঞ্চার তো হবেই। হলেই বা প্রাক্তন! হৃদয় তো আর এতো হিসেবে বিশ্বাসী নয়!
দুজনেই দুজনের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে দুজায়গাতে।সফিকুলও বৌদির কাছে মাঝে মাঝে তানিয়ার খবর নেয় ফোনে। বৌদি জানিয়ে দেয় তানিয়া কতটা সুখে সংসার করছে।এখন সে আর একা নয়। মেয়ে রুবেলা তার সঙ্গী। তাছাড়া তিন ভাইয়ের সংসারে বড়বউ হলে কতো যে কাজের চাপ সেটা তো আর বলবার দরকার নেই।সুতরাং তার আর তানিয়ার কথা না ভাবলেও চলবে। নিজে যত তাড়াতাড়ি সংসার গুছিয়ে নিতে পারবে সেটাই সফিকুলের জন্য মঙ্গলময় হবে।না হলে সারাজীবন আইবুড়ো হয়েই থাকতে হবে।
বৌদিরা সাধারণত এরকম কথাই বলে থাকে। তবে সফিকুল কষ্ট পায়নি সেদিন। তানিয়া তার প্রথম প্রেম,
তার ভালো থাকার খবর পেলে সে খুশি হবে না এটা কী হয়!
থাক! সৃষ্টি কর্তার দোয়া তে পৃথিবীর সকল জীব সুখে থাক! এর চেয়ে সুন্দর আর কীই-বা হতে পারে।এরকমই তো প্রার্থনা আমাদের সকলের। তবুও তো খারাপ সময়ের স্বীকার হতেই হয়।কখন কিভাবে কার জীবনে খারাপ সময় আসে সে কি আমরা কেউই আগের থেকে বলতে পারি। যদি বলতে পারতাম তাহলে হয়তো সেদিন রুবেলার বাবা হানিফ অফিসে না গিয়ে শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে ঘরে বসে ছুটি কাটাতেই পারতো। তার তো এতো গুলো ছুটি সরকারের খাতায় পড়েই আছে!অথবা যে রাস্তায় প্রতি দিন যায় সে রাস্তায় না গিয়ে একটু ঘুর রাস্তাতে গেলেও পারতো। কিন্তু তা তো হলো না। এই কাজ পাগল মানুষটার অফিসে যাওয়ার পথে এ্যাকসিডেন্ট হলো।প্রত্যক্ষদর্শীরা বললো শীতের সকালে কুয়াশা ছিলো খুব। পিছনের দিক থেকে লরিটা খুব জোরে ধাক্কা মেরেছে বাইক আরোহীকে। স্পাইনাল কর্ডের উপরে দিকের অংশ ছিড়ে স্পট-ডেড।
তানিয়ার জীবনে এতো বড়ো দুর্দিন আসবে সেটা কেউ কল্পনাও করে নি।
এবার যা হয়, মেয়ে বাপের বাড়িতে কখনো থাকে তো আবারও কখনো শ্বশুর বাড়িতে থাকে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কখনো মুখ বাঁকিয়ে বসে তো বাপের বাড়ির ভাই- ভাইবৌও বলে মেয়ের তো শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তিতেই অধিকার; এখানে কেন থাকবে সে,তার কি স্বামীর কিছু নাই?বাবার এইটুকু ব্যবসায় কি এতো জনের চলে!তাছাড়া ব্যবসাতেও মন্দা চলছে এখন।একসময়কার স্বচছল পরিবারে ইদানীং রোজগারের অনেকটা ভাটা পড়েছে।ভাই এবং বাবার মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয়।কিছু দিনের মধ্যেই ভাই এর সংসার বাবার সংসার থেকে আলাদা হয়ে গেল, ব্যাবসাও ভাগাভাগি হয়ে গেল।বুড়ো হলেও বাবা তো আর মেয়েকে ফেলতে পারে না। একার দ্বারা ব্যাবসাটা ভালো না চললেও কোনো মতে সংসার টা টেনে নিয়ে যায়।তবে এসবের জন্য তানিয়া নিজেকেই দায়ী করেছে, সে যদি হতভাগী হয়ে বাপ-ভাই এর সংসারে বোঝা না হতো তাহলে হয়তো এমন টা হতো না।আর সে আছে বলেই তো ভাই -বৌ এর এতো বুক চাপা অভিমান।
এদিকে কতদিন আর এই রকম যুবতী কে একা একা দেখতে চাইবে সমাজ এই ভাবনাটাও গ্রাস করেছে বাপ- মাকে!সুতরাং পুনরায় বিয়ের কথাও উঠতে শুরু করলো।
প্রাসঙ্গিক ভাবেই সফিকুলের নামও দুএকবার যে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ সে-ই তো তার প্রকৃত এবং প্রথম প্রেমিক।
সফিকুলের মা-বাবা এই এক মেয়ের মা কে বউ করে আনতে অস্বীকার করবে এটা তো তানিয়া জানত’ই।
তবুও বারন করে নি।
সফিকুলও জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেমকে অস্বীকার করে এমন ক্ষমতা তার ছিলো না সেটা সে ভালো করেই জানতো।
অথচ বাবা-মা আগের অপমান কে স্বরণ করিয়ে দেয় বারবার এবং পরের সন্তানের বাবা ডাক শুনতে হবে এটাও মনে করিয়ে দেয় সফিকুলকে। আর নিজেদের সিদ্ধান্তেও অটল রইলো।
দিনের পর দিন তো আর যুবতী মেয়েকে একা রাখা যাবে না।কোন দিন থেকে যে সমাজ বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করবে তা কিন্তু কেউ বলতে পারে না। তাই চিন্তায় মেয়ের বাপ-মার চোখে ঘুম নেই। সুতরাং বিয়ে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।বেশ কিছু দোজবরে পাত্র দেখেও গেল। কেউই কিন্তু বাচ্চা মেয়েটির দায়িত্ব নিতে চাইলো না।তবে তানিয়া কে তাদের অপছন্দ করার ক্ষমতা একদমই নেই।এক মেয়ের মা বলে কেউই বলবে না।যেমন রূপসী। তেমনই শান্ত স্বভাবের।যেকোনো পুরুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার মতো সুস্বাস্থ। গোলগাল মুখটাতে একটা টিপ দিলেই চলে আর বিশেষ কোনো সাজগোজের দরকারই হয় না।

কিন্তু যে তানিয়া তার নাড়ি ছেঁড়া ধন রুবেলা কে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না সে কি করে তাকে ভুলে নিজের সুখের জন্য পরের ঘরে যাবে!ভাবতেই তার বুক ভেঙে সাত টুকরো হয়ে যায়।এভাবেই বছর পেরিয়ে গেল। পাত্র খোঁজাখুঁজিও চলতে রইলো। এবার এক লন্ডন বাসী বাঙালীর খোঁজ পাওয়া গেল।সেও ডিভোর্সি। প্রচুর সম্পত্তির মালিক। একপ্রকার ধনকুবের বলা যায়।তার দুপুরুষ আগের থেকেই লন্ডনের ব্যবসায়ী তারা। প্রথম বিশ্বের এই শহরটিতে যেন এই একটা-দুটো ছেলেমেয়ের মা-বাবা এই বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।যে খুশি যখন খুশি যাকে খুশি বিয়ে করতে পারে।আবারও ডিভোর্সের ব্যাপারেও এমনই সরলীকরণ। দুপক্ষ রাজি হলেই হলো। আইনের লোক ডাকো, ব্যস্ খতম করো সব!
সুতরাং আর আপত্তি থাকার কথা নয়।বিয়ে করে লন্ডনে নিয়ে চলে গেলো তানিয়া এবং তার মেয়ে রুবেলা কে।রুবেলা ভালো স্কুলে পড়াশোনা করছে এখন। মা হিসেবে তানিয়া কতটা দায়িত্বশীল সেটা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।বর ব্যবসার কাজে বাইরেই বেশিক্ষণ থাকে। মেয়েকে নিয়ে সংসারে তানিয়া, সঙ্গে থাকে বয়স্ক শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। সংসারে সব কাজেই তার অংশ গ্রহন। মেয়ের স্কুলে যাওয়া,খাওয়াদাওয়া,মেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা, শ্বশুর- শ্বাশুড়ির পরিচর্যা।বাজারে দোকানে তেমন যেতে হয় না।কাজের লোকজন এগুলো করে দেয়।স্বামী তো ব্যবসার কাজে এতো ব্যস্ত যে এক একদিন রাতে বাড়ি ফেরাও হয় না।যে দিন বাড়িতে আসে সেদিন আবার অন্য রকম হয় বাড়ির পরিবেশটা। অনেক রাতে বাড়ি ফেরে।ড্রিংক করে আসে বাইরে থেকে। বলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থাকতে গেলে,পার্টিতে অংশ নিতে গেলে নাকি এটা করতেই হয়।তাছাড়া এটা তো এখানকার কালচার।ঠিক আছে এটা কালচার হিসেবে মেনে নেওয়া যায়।কিন্তু গালাগালি আর শারিরীক অত্যাচার! এটা তো কোনো দেশেরই কালচার হতে পারে না।তাহলে সেটা কি করে সহ্য করা যায় বা মেনে নেওয়া যায়।আর এই কোটি পতি বাবুর বিভিন্ন নারী ঘটিত সমস্যা গুলোও তো সংসার কে তছনছ করে দিচ্ছে দিন দিন। তবুও তানিয়া তো ঘরপোড়া গোরু।সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। একবার স্বামী হারা হয়ে দেখেছে সে সমাজের কি নির্যাতন সহ্য করতে হয়! তাই সংসারের সব কষ্টই সহজ পাচ্য করে নিতে চায়।এরকম ভাবেই চলছে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।
তানিয়া এখন অনেকটা বড়ো। মায়ের কষ্ট গুলো বুঝতেও শিখেছে। সৎ বাবার সংসার তার কাছেও অসহনীয় হয়ে যায় মাঝেমধ্যেই।তাই পাশবিক অত্যাচার থেকে মুক্তির পথ খুঁজত দুজনেই। কিন্তু দুজন একাকী লন্ডনে সহায়সম্বল হীন হয়ে কিভাবে বাঁচবে সেটাও একটা বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন।দুএকবার আইনি সাহায্য চেয়েও তেমন কিছু হয় নি।এতো টাকাওয়ালা লোকের কি আইন কিছু করতে পারে?দিন দিন এই অসহনীয় অত্যাচার গুলো যেন বাড়তেই থাকে।
তাই আর থাকা সম্ভব নয় ভেবেই একদিন সংসার ত্যাগী হলো তানিয়া রুবেলা কে সঙ্গে নিয়ে।প্রথম বারের স্বামী যেহেতু সরকারি চাকরি করতো তাই কিছু সরকারি অর্থ সাহায্য পেয়েছিলো। আর কিছু নিজের নামে জমানো টাকাও ছিলো। তাছাড়া তানিয়া নিজেও শিক্ষিতা মেয়ে। কোনো রকম একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে।লন্ডন শহরে কাজের অভাব নেই। আর মেয়েও তো বড়ো হয়েছে। সেও শিক্ষিতা। যাহোক করে চলে যাবে দুজনের বাকি জীবনটা।এভাবেই চলছিলো তাদের জীবন। বছর কয়েকের মধ্যে রুবেলাও একটা কাজ জুটিয়ে নিলো।সকাল বেলাতেই অফিসে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে।মা সারাদিন ঘরে একাকিনী।

এদিকে সফিকুল ততদিনে বিয়ে করে দুই পুত্র এবং এক কন্যার বাবা।লন্ডনেই থাকে। ছেলেদের মধ্যে একজন এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।একজন এখনো তেমন কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়, তবে চেষ্টায় আছে।প্রতিষ্ঠিত ছেলের বিয়ে হয়েছে। মেয়ের পাত্র খোঁজাখুঁজিও চলছে।
এমতাবস্থায় সে কি করে রুবেলার মা তানিয়াকে অর্থাৎ তার প্রথম প্রেমিকাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেবে!
আর তাকে রাখবেই বা কোথায়। বৌকে বললে সে বলে ‘করতেই পারো কিন্তু এই সংসারে তুমি থাকতে পাবে না নতুবা সে নিজে সংসার পরিত্যাগ করবে।’
এতো বড়ো অধর্ম কি করে সম্ভব!এটা না মেনে নিতে পারবে তানিয়া, আর সফিকুলের তো একথা ভাবলেই ভাঙাচোরা বুকটা আবারও খচ্ খচ্ করে উঠে; কাচ ভাঙার মতো ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায়।
তবু রুবেলা অনুরোধ করেছে সফিকুলকে এই বলে যে, এই বয়সে তার মাকে খুব একাকীত্ব গ্রাস করেছে।তাকে বাচাঁতে গেলে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন।রুবেলার সারাদিন তো অফিসেই কেটে যায়।মা একা রুমে বন্দিনী হয়ে দিন কাটায়।তার কোনো কিছুতেই মন স্থির হয় না।এই শহরের ইট পাথরের সঙ্গে আর কতটুকুই বা সময় কাটানো যায়।মাঝে মধ্যেই এই পঁয়তাল্লিশ বছরের শরীরটা কে বিভিন্ন রোগ আক্রমন করে। তাই সফিকুল যদি এই পড়ন্ত বেলার নৌকায় পাড়ের মাঝি হয়ে তানিয়ার জীবনে আসে তাহলে সে হয়তো এই জীবনটার বাকি অংশ টুকু কাটিয়ে দিতে পারবে অনায়াসেই।সফিকুল যদি তার নিজের সংসার সামলেও রুবেলার মাকে একটু সময় বা সাহচর্য দেয় তাহলে এই নিভু নিভু প্রদীপ কিছুটা তেলের জোগান পাবে। হয়তো বা রুবেলাকে আরো কিছু দিন আলোকিত করে রাখতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *