মিরুজিন আলো / কলমে –বিজয়া দেব
![](https://www.dinajpurdaily.com/wp-content/uploads/2021/03/photo-1586791965591-15d8892f6dd6.jpg)
মিরুজিন আলো / কলমে –বিজয়া দেব
দুই
দেবাংশী যখন ফিরল তখন রাত আটটা। বাড়িতে আলো জ্বেলে বসে আছে জগবন্ধু। জগবন্ধু রায়। জগবন্ধুর বোধের জগতটা একটুখানি ভোঁতা। জয়মাল্য যখন তাকে ছেড়ে চলে গেল, জুহিকে নিয়ে দেবাংশী যখন একেবারে একা, সেই সময়ে পার্কে এক সন্ধ্যায় জগবন্ধু বসেছিল একা, একপাশে গাছের ধারে।দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ভারি বিধ্বস্ত। চাউনির উদভ্রান্তি দেখে দেবাংশী কাছে গিয়েছিল। হ্যাঁ, জগবন্ধু পরিষ্কার করে কিছুই বলতে পারছে না তখন, শুধু বলছে – খেতে চাই। বড্ড খিদে। আগুপিছু না ভেবে লোকটাকে বাড়িতে এনে তুলেছিল দেবাংশী। জুহি তো খুব খুশি। নতুন মানুষ দেখে সে হাসল, খুশি হয়ে জগবন্ধুর চারপাশে ঘুরঘুর করছে শুধু। জগবন্ধুর মুখেও হাসি। একটা মুশকিল শুধু জগবন্ধু আরশোলা টিকটিকি বড্ড ভয় পায়। তার দেখাদেখি জুহিও ভয় পায়। জগবন্ধু অন্ধকারকেও বড্ড ভয় পায়। তার দেখাদেখি জুহিও ভয় পায়। তাই জগবন্ধু সন্ধ্যে নামার আগেই আলো জ্বেলে বসে থাকে। অন্ধকারে সে নাকি কীসব দেখে-যা আলোর জীব নয়। ঐ জীবগুলোর সারাদেহ শুঁয়োপোকার মত – আরশোলার চোখের মত… সে যে কী ভয়ানক, নিদারুণ, তা সে বলে বোঝাতে পারবে না। তবে ছবি এঁকে দেখাতে পারে। দেবাংশীকে বলে – আমাকে চকখড়ি এনে দিতে পারো? আমি মেঝেতে ছবি এঁকে দেখাব। দেবাংশী কৌতূহলী হয়ে এনে দিয়েছিল চকখড়ি। এঁকেছিল জগবন্ধু এক অদ্ভুত প্রাণী, অচেনা অদেখা।
দেবাংশী জানে এখন জুহি লিখছে আর জগবন্ধু বলে যাচ্ছে। এখানেই জুহির যাবতীয় মগ্নতা ভাললাগা। রায়কাকা তার বড় কাছের। এটা ওটা প্রশ্ন করছে আর লিখছে। এক অদৃশ্য জগতে বাস করে জুহি ও জগবন্ধু। জগবন্ধু বলে আমাদের ওখানে বড় আলো মা। তুমিও এসো। একথা শুনলে জুহি চেঁচিয়ে ওঠে বলে – না আআ। জগবন্ধু চুপ হয়ে যায়। ওদের ওই আলোকময় জগতে দেবাংশীর অস্তিত্ব নেই। দেবাংশী সরে আসে। সাহস করে সে জুহির কাছাকাছি যেতেই পারে না। সেই একঘেয়ে রুটিনমাফিক কিছু প্রশ্ন, কিছু খোঁজখবর – ও খেয়েছে কিনা, শরীর ঠিক আছে তো, টাকাপয়সার দরকার? ট্যুইশান বাড়াতে হবে? এসবের বাইরে কোথাও পা ফেলার জায়গা খুঁজে পায় না দেবাংশী। অথচ নিজের ভেতর একটা পরিবর্তন আসছে। জুহির কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছেটা বাড়ছে। সে ছুঁতে পারছে না মেয়েকে। এই অক্ষমতার যন্ত্রণা আছে, আগে সে তেমন টের পায়নি। এখন মনে হয় এই কাছে যেতে না পারার পরিসরটা যত বড় হচ্ছে নিজেকে ততটাই বোকা বোকা অপদার্থ মনে হচ্ছে। ঐ দেয়ালটা আর ভাঙ্গা যাবে না? পুরনো দেয়াল তো ভঙ্গুর হয়, নোনা ধরে, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে? হ্যাঁ ভুল হয়েছে। ‘আত্মজা’ শব্দটির অর্থ বুঝি পরিষ্কার ছিল না তার কাছে। তার বাইরের পৃথিবীর ব্যাপ্তি তার কাছেই নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কেন মনে হচ্ছে তার একান্ত গোপন আমিটার ভিত হলো জুহি। আর কেউ নয়, কিছু নয়।
রাতে বিছানায় শুয়ে পড়ার পর মনে হয একবার জুহির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে ঘুমোলে মেয়েটাকে কেমন লাগে? কিন্তু না, যাওয়া হয় না। যেতে গিয়ে পা আটকে যায়। অদ্ভুত এক অস্বস্তি। তার বাড়িতে থাকা বা না থাকায় হয়ত জুহির কিছু যায় আসে না। মেয়েটি অসম্ভব কৌতূহলী তার বাবার অজানা যাপনের গল্পে। সে ঐ গল্পে ঢুকতে চাইছে, জানে দেবাংশী। জগবন্ধু বলে। যখন জুহি বাড়ি নেই তখন একটু একটু করে জিজ্ঞেস করে দেবাংশী। জানতে চায় মেয়েকে। জুহিকে বলতে চায় মিথ্যে কৌতূহল তোর জুহি। কোথাও কোনও গল্প নেই রে আর। নিটোল গল্প সব মরে হেজে গেছে। যা পাবি তা খন্ডচিত্র। টুকরো টুকরো, কোনও সূত্র ফেলে যাচ্ছে না এই খন্ডকাল। জন্মাচ্ছে ফের বিলীন হয়ে যাচ্ছে। খন্ডচিত্রে তোর মন কি ভরবে? অচেনা অদেখা কিছু কৌতূহল উদ্রেক করে। এর বেশি কিছু নয়।
আজকাল দেবাংশীর ঘুমঘোরে মা আসে, সেই দিনগুলো আসে, সেই লালরঙা বাসটি আসে, তিনটি টিকিট কাউন্টারে সার সার বসে থাকা সেই তিনজন লোক আসে। একজন প্রৌঢ়, দুজন যুবকবয়েসি। সেই প্রথম জীবন, সেই প্রথম যৌবন, ভোর ভোর বাস ধরতে যাওয়া। ভোরের আলো ফুটেছে, তবে টিকিট ঘরের ভেতর আবছা আঁধার, তাই হলুদ বাল্ব জ্বলে।
একদিন প্রৌঢ় টিকিটবাবু জিজ্ঞেস করে – এত সকাল সকাল কোথায় যাওয়া হয়?
-চাকুরি।
-কীসে?
-রাজ্য সরকারের করণিক।
-বেশ। খুব ভালো। আমিও ঐরকম অল্পবয়েসে চাকুরিতে ঢুকেছি। কিন্তু এই ঘরে অথবা এইরকম ঘরে কেটে গেল কাল। দীর্ঘকাল। বদলি হয়েছে ঢের কিন্তু প্রমোশন হল না। গোল গোল চশমার ভেতর ঝাপসা চোখের পাঠ নেওয়া যায় না।
-একটা রোবোটিক লাইফ, বুঝলেন? নতুন চাকুরির চেষ্টা করবেন, বুঝলেন? হাল ছাড়বেন না।
সেইসময় বাড়ির জন্যে খুব মন কেমন করত । একটা গঞ্জ এলাকায় চাকুরি। সদ্য পাশ করে বেরিয়ে জোটে গেল চাকুরি। খুব দরকারও ছিল। বাবা তখন অবসরে। ছোট ভাইয়ের ডাক্তারি পড়া। মা – র চিঠি আসত। কত খুঁটিনাটি – হ্যাঁ রে দেবি, বাগানে অনেক লিলি ফুটেছে। মাথা গোল কাঁচালঙ্কার গাছে ছ’টা কাঁচালঙ্কা। সাদা বেড়ালের বাচ্ছা নিয়ে এসেছে তোর বাবা। এইটুকুনি। তুলতুলে। গতকাল পায়রার মাংস হয়েছিল। পুষিটা খায় নি জানিস। শুধু দুধ আর কিছু না। ঠিক আছে, বড় হলে খাবে।
একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকত দেবাংশী, ঘর ভাগাভাগি করে তিনজনা- দেবাংশী, মঙ্গলা, তিলোত্তমা। এখন এতবছর পর সবাই এক গ্রুপে। হোআটস অ্যাপ গ্রুপ। ছিপছিপে মঙ্গলা এখন ভারিক্কী। তিলোত্তমা বড় চাকুরে বিয়ে করে বিদেশে।
বাস করে বাড়ি ফেরা হত। সেখানেই দেখা জয়মাল্যর সঙ্গে এক নিভু নিভু সন্ধ্যায়। একটা দুর্বল ব্রিজ, হেঁটে ফিরতে হয় বাস থেকে নেমে। নিচে বয়ে যাচ্ছে নদীর তিরতিরে জলরেখা, সন্ধ্যার আলোয় খানিকটা ঝিকমিকে, খানিকটা আঁধারে মেশা। পেছন থেকে কেউ বলল – এই যে? শুনছেন?
*****************************************
জুহির ঘরে দরজা খোলা। এখনও ঘুমোয়নি? খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠল দেবাংশী। পা পা করে এগোল, এবার একেবারে জুহির দরজায়। জগবন্ধু মেঝেতে বসে হাত নেড়ে কীসব বলছে আর জুহি কীসব লিখছে। কি লিখছে মেয়েটা? এ কী উদ্ভুটে অভ্যেস? পায়ের আওয়াজ পেয়েছে জুহি। ফিরে তাকাল। দেবাংশীকে দেখে অদ্ভুত পাথুরে চাউনি। দেবাংশী বলল – রাত অনেক হল। ঘুমোবি না মা?
বলে চমকে উঠল। নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকল। এভাবে মা বলত দেবাংশীকে। এভাবেই অতীত জেগে ওঠে? বর্তমানকে আলো দেখায়? দেবাংশী একটু লজ্জিত হল বুঝি। জুহি এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে মঙ্গলগ্রহের জীব।
জগবন্ধু একমুখ বোকাটে হাসল। চওড়া হাসি। তারপর হাতজোড় করে নমস্কার করে বলে উঠল – মা মা মাগো।
(ক্রমশ)