ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (নবম পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (নবম পর্ব)

সায়ন্তন ধর

এবার আসি সেই ঘটনায়, যে বর্ণনা দিয়ে আমি ‘ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে’ শুরু করেছিলাম। আগেই বলেছি এবার আমার কলিগ দাদা তার পরিবার নিয়ে এসেছে। তার মেয়ে আর আমার চাকরি প্রায় সমবয়সী। ছোট্ট কুর্চির সাথে ট্রেনে সময়টা বেশ কেটেছিল। ও যখন হলো, তারপর প্রথমবার ওকে দেখার সময় আমি আর আমার সিকিমের এক কলিগবন্ধু মিলে যে জামাটা উপহার দিয়েছিলাম, সেটাই পরেছিল। যাইহোক ওরা তো আইআইটির গেস্টহাউসে থাকবে, এদিকে আমি আদাবাড়িতে একটা হোটেলে। শরতের সিরাস মেঘের স্তরে আগুন ধরিয়ে সূর্যদেবের উদয় হলো। হোটেলের রিসেপশনে একফালি সোফায় বসে অপেক্ষা করছি। সকাল আটটায় অবশেষে রুম পেলাম। আসামের এক কলিগবন্ধুর সাথে আমার রুম শেয়ার করার কথা। সে এসে পৌঁছালো দুপুর নাগাদ। আমি প্রতিবারই গুয়াহাটিতে অফিসিয়াল মিটিং এই এসেছি, তবে এবার মিটিং এর সাথে সাথেই একটা ডিপার্টমেন্টাল ইন্টারভিউও ছিলো। সেজন্য সবাই একটু প্রিপারেশনে ব্যস্ত। পরের দিন ভালোয় ভালোয় ইন্টারভিউ পর্ব মিটে গেল। স্বয়ং ডিরেক্টরের সাথে পরিচয় হল। এরপর একটু অফিসে গেলাম। কিছু অফিসিয়াল কাজ করে চলে এলাম হোটেলে। এর মধ্যে আমার রুমমেট একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে। হাতমুখ ধুতে গিয়ে মোবাইল জলে পড়ে যায়। কিছুতেই অন না হওয়ায় শেষে এসি অন করে সেখানে রেখে দেয় ফোনটাকে। সে ফোন তো অন হলোই না উল্টে আমার টেনশন হচ্ছিল কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। যাইহোক তেমন কিছু হয়নি। ডিনার শেষে ব্যালকনিতে এসে বসলাম। ওই হোটেলেই বেশিরভাগ কলিগরা ছিল। তাদের অনেকেই ব্যালকনিতে ছিল। ব্যালকনির রেলিং বলতে ১০ মিলিমিটারের স্বচ্ছ কাঁচ। সেই বিস্তৃত অংশ দিয়ে রাতের আসাম ট্রাঙ্ক রোড ঝলমল করছে। অনবরত গাড়ি যাতায়াত করছে। বড় বড় বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং গুলো মায়াবী করে রেখেছে সমস্ত অঞ্চলটিকে। গল্প করতে করতে আর রাতের এ দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় দুটো বেজে গেলো। সবার চোখেই ঘুম। একে একে সবাই ঘুমোতে চলে গেলাম শুধু আলোর রোশনাইএ জেগে রইলো আসাম ট্রাঙ্ক রোড। পরদিন মিটিং ছিল, হোটেল থেকে সবাই বেরিয়ে আইআইটি তে এলাম। আইআইটি গেস্টহাউসে ব্রেকফাস্ট সেরে গতবার যেখানে ফোটোশুট করেছিলাম, সেখানে এলাম বাকিদের নিয়ে। ওদের কিছু ছবি তুলে দিলাম। কনফারেন্স রুমেও পৌঁছে গেলাম একটু তাড়াতাড়ি। সেখানেও একপ্রস্থ ফর্মালভাবে ফোটোশুট করলাম। লাঞ্চে গাড়ি করে একটু দূরে যাওয়া হয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে মিটিং শেষে কুর্চি সবার সাথে পরিচিত হলো। এত আঙ্কল আন্টি পেয়ে তার খুশি দেখে কে! সেদিন রাতেই আমাদের ট্রেন, আবার সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। কলিগদাদা আইআইটি থেকে ওলা নিয়ে এলে বাকিদের বিদায় জানিয়ে আমি রওনা দিলাম। গাড়িতে দাদা একটা দুঃসংবাদ দিলো, তাড়াহুড়ো করে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে জেবিএল এর ব্লুটুথ স্পিকারটা নাকি ট্রেনেই ছেড়ে এসেছে। আমি বললাম যে এভাবে যেন আর তাড়াহুড়ো না করে। কারন আমার চোখে তখন এমন একটা ব্যাপার পড়েছিল যেটা অত্যন্ত ফ্যাটাল হতে পারতো। আচমকা গুয়াহাটির পরিবর্তে কামাক্ষ্যা স্টেশনে নামতে বলায় বৌদি একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কুর্চিকে নিয়ে আর লাগেজ নিয়ে নামার আগেই ট্রেন প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। যাইহোক ভুলগুলো হালকার ওপর দিয়ে গেলে একদিকে ভালোই, ভুল শুধরে নেয়ার দ্বিতীয় চান্স দেয় জীবন। যাইহোক এসব কথা বলতে বলতেই গুয়াহাটির কুখ্যাত জ্যাম কাটিয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। তারপর আবার একপ্রস্থ কুর্চির সাথে সময় কাটালাম। কুর্চির এই নামটা আমার মায়ের দেওয়া। আমাদের কলিগবন্ধুরা বিভিন্ন স্টেটে ছড়িয়ে থাকার জন্য ওর অনেকগুলো নাম হয়েছে। যেমন ওর মেঘালয়ের আন্টির দেওয়া নাম অ্যামাণ্ডা। যার অর্থ হল ভালোবাসার যোগ্য। আর কুর্চি একটা ফুল। কুর্চি ঘুমিয়ে গেলে নিস্তব্ধতাকে ভাঙার দায়িত্ব নিল ট্রেনের চাকা। আস্তে আস্তে নিভে গেলো সব বাতি। আমি এই সময়টার অপেক্ষা করি ট্রেনে উঠলে। তখন বাইরের দৃশ্য কাঁচের জানালা ভেদ করে আমার রেটিনায় ধরা দেয়। সাথে চাঁদ যদি যাত্রাপথের সঙ্গী হতে হতে কম্পার্টমেন্টে জ্যোৎস্না ঢালে তাহলে তো কথাই নেই। ঠিক তেমন একটা পরিবেশেই আমি কল্পনায় ভাসলাম।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *