ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (সপ্তম পর্ব) সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (সপ্তম পর্ব)

সায়ন্তন ধর

বরাবর দেখেছি আমার অফিসের শিডিউলের সাথে কিছু না কিছু ওভারল্যাপ করে। সেবার আমার বিএড এর পরীক্ষা ছিল। বিএড এর জন্য জলশহর থেকে বীরভূমে গেলাম। পরীক্ষা শেষে মাইথন-পাঞ্চেৎ আর শান্তিনিকেতন ঘুরেছিলাম তবে সেসব ভ্রমণকথা অন্য কোনদিন বলব। এরপর একটা কাজ থাকায় কলকাতা যেতে হয়েছিল। কলকাতা অর্থাৎ চিৎপুর স্টেশন থেকে কাজিরাঙা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। এদিকে আমার যে স্থানীয় কলিগদাদা, তাঁরও আসল বাড়ি কলকাতায়। তিনিও বাড়িতেই ছিলেন। তাই একই সাথে একই ট্রেনে কলকাতা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েছিল। প্রায় একদিনের জার্নি শেষে ভাগীরথী-হুগলীর তীর থেকে চলে এলাম ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। মাঝে আমার শহরে সিগন্যাল না পেয়ে কিছুক্ষণ দাড়ালো এই ট্রেন। কিন্তু আমার তো বাড়ি ফিরলে চলবে না। যাই হোক, সময়টা জুলাই মাস। রাত থেকে টিপির টিপির বৃষ্টি। ভোরে কোনমতে ওলা বুক করে গন্তব্যে পৌছালাম। গন্তব্য এবার ডন বস্কো ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট। গুয়াহাটি শহরের একপ্রান্তে যে ওরকম পাহাড় থাকতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। রাঙামাটির ছোটো পাহাড়ের উপর পুরো ইনস্টিটিউটটা। একের পর এক বিল্ডিং পেরিয়ে লিফ্টে করে নির্ধারিত বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় পৌঁছালাম। প্রতি তলায় বেশ কিছুটা ফাঁকা ছাদ রয়েছে যা লাল সাদা রুফ টাইলসে মোড়া। আর সুদৃশ্য রিও, পর্তুলক্কা, বোগেনভেলিয়া ও পাতাবাহারে সুসজ্জিত। আমাদের রুমের ঠিক বাইরেই তেমন একটি ছাদ, যেখান থেকে একটা লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কৌতুহল বশত সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। একেবারে ধারে এসে তো চক্ষু ছানাবড়া। তখনও ইলশেগুঁড়ি হচ্ছে। আর সামনে যেন বিশাল সমুদ্র, আসলে ভারতের সর্বাপেক্ষা বেশি জলবহনকারী ব্রহ্মপুত্র নদ। দুকুল ছাপিয়ে জল। মাঝে একফালি চড় কোনরকমে জেগে রয়েছে। আকাশে পুঞ্জীভূত কিউমুলোনিম্বাস মেঘেরা যেন জলের সাথে তাল মিলিয়ে ফুঁসছে। অগত্যা লিখেই ফেললাম কয়েক লাইন –
ঐ দেখ সবে, ফুসিছে আজিকে
ব্রহ্মপুত্র নদ-
ভয়াল রূপেতে ভাঙিছে দু্’ধার
করিছে জীবেরে বধ।
কাজিরাঙা হতে রাজধানী –
সকলি জলের তলায়
ক্ষমা করো ওগো প্রকৃতি মাতা-
সৃষ্টি যে নাশ হয়।
পাহাড়ের পাদদেশে রাস্তা। রাস্তা ও নদীর মাঝে রয়েছে এক বিলাসবহুল বাড়ি। তার নিজস্ব সুইমিংপুল ও রয়েছে। নদীর তীরে দেখা মিলল বিলম্বিত সময়ের কিছু গুলমোহরের সাথে। এবারও আমাদের অফিসের মিটিং রয়েছে, তবে কাজ সব গুছিয়েই এসেছি এবার। তাই এত সুন্দর একটা জায়গা ঘুরে দেখার সময় পেলাম অনেকটা। আমি লঙ্কা খেতে ভালোবাসি বলে আমার নাগাল্যান্ডের দুই কলিগবন্ধু ওদের ওখানকার তথা ভারতের সবচেয়ে ঝাল লঙ্কা ভূত জলোকিয়ার আচার নিয়ে এসেছে আমাকে দেবে বলে। লাঞ্চে ওদের সবার সাথে ভাগ করে তার স্বাদ নিলাম। ভূত জলোকিয়া আজকাল আমাদের এদিকেও হয় ঠিকই, তবে সঠিক আবহাওয়ার অভাবে অতটা ঝাল হয়না। পরদিনও একই আবহাওয়া। সবুজ পাহাড়ে পেজা তুলোর মত মেঘের আনাগোনা। ছাদে দাড়ালে গাল ভিজিয়ে দিয়ে যাবে যেন। ওই ইনস্টিটিউটের কনফারেন্স রুমেই হবে মিটিং। লাঞ্চে তৎসংলগ্ন ছাদে এলাম। গান্ধীজির একটা স্ট্যাচু আছে সেখানে। আর ব্রহ্মপুত্রকে যেন আরও কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। দিগন্ত বলে কিছু নেই, আকাশ ও নদীর জল সবই স্লেটরঙা। খুব ইচ্ছা ছিল ব্রহ্মপুত্রের তীরে যাব। কিন্তু বৃষ্টির থামার কোন লক্ষণই নেই। তাছাড়া ওই সময়ে নদ ভীষণই ভয়ঙ্কর থাকে তাই মিটিং এর পর ঘরে বসে আর কলিগবন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরেই কাটিয়ে দিলাম। একটু আধটু ঘুরে দেখলাম ইনস্টিটিউটের আনাচ কানাচ। প্রভু যীশুর সান্নিধ্যে পশুদের নির্ভিক বিচরণের স্ট্যাচুগুলি ভীষণ ভালো লাগলো। প্রথম দু’দিন বাইরে তেমন না বেরোলেও অ্যাডভেঞ্চারের সাধ অবশ্য পেয়েছিলাম পরে, তবে সেটা এই পর্বে নয়, পরের পর্বে বলবো। ততক্ষণ … স্টে টিউনড।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *