অন্য মন,অন্য হৃদয় ✒️✒️ মীনা দে

অন্য মন,অন্য হৃদয়
মীনা দে

অনেক বড়ো বড়ো লেখকেরা আত্মজীবনী লেখেন। আমরা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি তাদের জীবন সম্পর্কে। আমারও খুব ইচ্ছে করে আত্মজীবনী লিখতে, ঠিক আত্ম জীবনী নয় কিছু না বলা কথা বলা যেতে পারে। যা লিখে এবং কিছু কাছের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারলে একটা অদ্ভুৎ আত্মতৃপ্তির স্বাদ পাওয়া যায়।

ছোটবেলায় সবাই বলত আমি নাকি একদম আমার বাবার মতো দেখতে। কেউ কেউ বলত একদম বাপের মুখ বসানো। আমি তখন বারবার আয়নার সামনে নিজেকে দেখতাম আর মেলাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কিছুতেই কোথাও কোনো মিল খুঁজে পেতাম না। তারা এও বলতো পিতৃমুখী কন্যা সুখী। বুঝতাম না সেই সুখটা কি। ঠিক কোন সময়ে সেটা আসবে। তখন তো সুখীই ছিলাম খুব সুখী। মা ছিল বন্ধুর মতো একেবারে। বাবা একটু গম্ভীর প্রকৃতির কম কথা বলা মানুষ। কিন্তু স্নেহ ভালোবাসার এতটুকুও অভাব বোধ করিনি। পরবর্তী জীবনে সুখ , অসুখ, স্বভাব অভাব,দম্ভ, ব্যথা ‘ বেদনা সব কিছুর মধ্যেই সুখ খুঁজতে চেয়েছি। বেশীর ভাগ সময়েই হতাশ হয়েছি। কখনও কখনও আবার আচম্বিতে এত পেয়েছি যে ধরে রাখার জায়গা হয়নি। লেবু বেশী কচলালে তেতো হয়ে যায়।
ফিরে আসি প্রথম দিকের কথায়। কৈশোর পেরিয়ে যখন যৌবনে প্রবেশ করলাম, মনটাকে অনুমতি দিয়ে ফেললাম সে যেখানে ইচ্ছে যেতে যায় যাক না। পৃথিবীটা কত রঙিন,কোন রাজনীতির কথা বা কোন গুরুগম্ভীর আলোচনা ভালো লাগতো না। তখন যা দেখি, যাকে দেখি যা শুনি, তার মধ্যে যদি ভালোলাগার মাত্রাটা বেশী থাকে তবে তাকেই ভালোবেসে ফেলি। মনপাখিটার গায়ে তখন হাজার রঙের পাখনা। একটা বিরাট রঙিন কল্পনার জগৎ। মনপাখি সেই রঙিন পাখনা মেলে উড়ে চলে কোথায় কোথায়। অবাস্তবই তার বেশী পছন্দ।
দেওঘর থেকে কলকাতা এলাম কলেজে পড়ব বলে। ভর্তি হলাম বিদ্যাসাগর কলেজের মর্নিংএ যেটা মেয়েদের জন্য ছিল। সেই সময়টা ,ওহ্ কি যে ভালোলাগা! নিজেকে,হ্যাঁ নিজেকে। ওই সময়টাতেই বোধহয় মানুষ নিজেকে সবথেকে বেশী ভালোবাসে। সুখ, তাও ওই সময়টাকে ধরেই এসেছিল জীবনে। জীবনের সবথেকে সুখের দিনগুলো রঙিন দিনগুলো ওই সময়টাকে ঘিরেই । তখনকার গান শোনা তখনকার সিনেমা দেখা, উপন্যাস পড়ার যে আনন্দ, তা একেবারে নির্ভেজাল আনন্দ। পুরোপুরি ডুবে থাকা। সে আনন্দ উদ্দীপনা বলে বোঝানো যাবে না।
প্রথম দেখলাম উত্তম সুচিত্রার ছবি। যত দেখি তত ভালোবেসে ফেলি উত্তম কুমার নামের ওই পরম আকর্ষণীয় চরম ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষটাকে। যদিও তাকে মোহই বলা হয়,কিন্তু ওই মানুষটাকে নিয়ে তখন কল্পনার জগৎ তোলপাড় হতো। একটা মন ভালো করা অনুভূতি কাজ করত, যা বিশ্ব সংসার ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। একবার বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে মহাজাতি সদনে উত্তমকুমারের একটা শো দেখতে গিয়ে ছিলাম আমার এখন যে জীবন সঙ্গী তার সাথে। ওহ্ সেদিন কার সাথে যাচ্ছি সে আনন্দ দশগুণ ছাপিয়ে গিয়েছিল কাকে দেখতে যাচ্ছি। যখন উত্তম কুমার স্টেজে এলেন তখনকার মনের অবস্থা ব্যক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। ভুলে গিয়েছিলাম আমি একটা বিরাট হলে বসে আছি, ভুলে গিয়ে ছিলাম আমি কার পাশে বসে আছি। শুধু উত্তমময় হয়ে চিত্রার্পিতের ন্যায় বসে ছিলাম। বুকের ভেতর হাজার হাতুড়ি পেটার শব্দ। সে রাত্রে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ভালোবাসা শুরু হয়েছে আর কিছুদিন পর থেকে। সেটা তো আজও বহমান।
আর একজন মানুষ সেই সময় মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিচরণ করতেন। সেটা উত্তমের আগে। তিনি আমাদের ফিলজফির প্রফেসার ছিলেন। তখন তিনি এম ডি বলেই বেশী পরিচিত। পুরো নামটা এখন মনে নেই। কিন্তু চেহারা বেশ মনে আছে। পুরূষ মানুষের এত রূপ! আমি অবাক হয়ে দেখতাম। এদেরই বোধহয় বলা হয় দেবদূত । অসম্ভব জেনেও মন তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করল। খুবই ছেলেমানুষি কিন্তু কি করব যে বয়সের যা ধর্ম। বেশ মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে ছিলাম। ক্লাস নিতে নিতে দু একবার চোখাচোখি হলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম। অদ্ভূত সব কল্পনার ছবি আঁকতো মনের ক্যানভাস । তারপর কখন যে সেটা মুছে গেল তা আর মনে নেই। তারপর যে জীবনে প্রবেশ করলাম সেটাই আসল জীবন। ওই যে বললাম সুখ ,অ-সুখ ,স্বভাব,অভাব,দম্ভ, তিক্ততা, মিষ্টতা সব কিছু মিলিয়ে জীবনের রংটা ঠিক মরচে ধরা রঙের মতো ছিল।
‌‌তারপর, জীবনসুর্য যখন মধ্যগগনে তখন জীবনের গতিতে এলো নতুন এক‌ চমক। কোনো দিন যা ভাবিইনি সেই অধরা চাঁদটা যেন এলো হাতের মুঠোয়। পেলাম ফেসবুক নামক এই আশ্চর্য সুন্দর একটা জায়গা আর সেখানে পেলাম আমার আমিটাকে মেলে ধরবার সুযোগ। হোক না তা যতই অকিঞ্চিৎকর। বন্ধুর যে কোনো বয়স হয় না ফেসবুকে না আসলে সেটা অজানাই থেকে যেত। নিজেকে জানাবার নিজেকে মেলে ধরবার সুযোগটা পেলাম অনেক অপরিচিতের কাছে। অনেক কিছু শিখলাম। ভালো ভালো অভিজ্ঞতা যেমন হলো তিক্ত অভিজ্ঞতা ও তেমনি কিছু কম হলো না। তবুও যা পেলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেক অধরা জিনিস হাতে ধরিয়ে দিয়েছে এই ফেসবুক। অনেক আনন্দ অনেক খুশি যার তুলনাই হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *