# যমুনা # – ২
সচ্চিদানন্দ বাবুর স্ত্রী মণিকা দেবী, সংসারের সমস্ত কাজকর্ম ও খাওয়া দাওয়ার শেষে সবে একটু বিশ্রামের আয়োজন করছেন। সেই সময় শত ছিন্ন ময়লা একটি ফ্রক পরা কিশোরীকে নিয়ে গৃহে হাজির হলেন মাস্টার মশাই। মণিকা দেবী যমুনাকে একটু সময় পর্যবেক্ষণ করার পর বিরক্তি সহকারে বলে উঠলেন – এটা আবার কাকে ধরে নিয়ে এসেছ?
জেঠিমার এ আচরণে রাগের বদলে যমুনার মুখে দুষ্টুমির মুচকি হাসি খেলে গেল। সে নিজেই আপন পরিচয় দিয়ে বলল – আমি যমুনা গো। হই সেই উ পাড়ায় থাকি। দূরের বাগদি পাড়ার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাল। তুমি নাকি আচার খায়াবি? কুথায়, দ্যাও। মণিকা দেবী স্বামীর দিকে বিস্মিত হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। সেই দৃষ্টিই অনেক কথা বলে দেয়। ওদিকে সচ্চিদানন্দ বাবুর দুই মেয়েও কৌতুহলী দৃষ্টিতে যমুনাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। সত্যিই তাদের সকলের কাছে যমুনা কৌতুহল জাগ্রত করার পক্ষে যথেষ্ট। এই বয়সের কোনও দরিদ্র মেয়েকেও এমন শত ছিন্ন বস্ত্রে তারা কখনও দেখেনি। সকলেই কোন একটি গৃহস্থ বাড়ির পরিচারিকার কাজ করে। ফলে নিজেদের একটু পরিষ্কার তো রাখতেই হয়, আর সাজ পোষাক সম্পর্কেও তারা কিছুটা সচেতন হয়। কিন্তু এ কে? একে বাবা কেনই বা বাড়িতে হঠাৎ করে নিয়ে এসেছে? আর অসময়ে মায়ের নিজস্ব সম্পত্তি আচার, যা অনেক সাধ্য সাধনা করে তাদের ভাগ্যে জোটে, তার উপর অবলীলাক্রমে অধিকার জাহির করছে!

সবকিছু বুঝে মাস্টার মশাই যমুনাকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে সংক্ষেপে যমুনার বিষয়ে সমস্ত জানালেন। মণিকা দেবীর প্রথমেই আপত্তি – ওই নোংরা গন্ধ সহ জামা পরে ও ঘরে ঢুকবে না।
মাস্টার মশাই – ওই একটাই জামা কাপড় পরে ওরা স্কুল বাড়িতে সবাই আছে। এর থেকে ভালো কোনো পোষাক কারুর নেই। বর্ষায় না পারছে কেউ জামা কাপড় কাচতে, সেছাড়া ওই পাড়া অত্যন্ত দরিদ্র। ওরা ওভাবেই থাকে।
তখন মণিকা দেবী করুণ মুখে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করলেন – তোদের কোনো পুরনো জামা থাকে তো দে না।
বড় মেয়ে স্নেহার স্বাস্থ্য বেশ ভালো। আর বয়সেও সে যমুনার থেকে বড়। ফলে তার জামা যমুনার গায়ে ফিট করবে না। ছোট মেয়ে মাধুরী তার পুরনো ভালো জামাগুলো গরীব বন্ধুদের দেওয়ার জন্য জমিয়ে রাখে। বাড়ির সকলের দৃষ্টি এখন মাধুরীর দিকে। দেওয়ার মতো একটাই খুব সুন্দর নীল রঙের জামা আছে। দীর্ঘ দু’বছর ধরে বাড়িতে পরলেও তা এখনও নতুন জামার মতোই আছে। সেটা সে তার এক প্রিয় গরীব বান্ধবীর কথা মনে করেই যত্ন সহকারে রেখেছিল। আরো কিছু দিন নিজে পরার ইচ্ছাও তার ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিই বা করার আছে? মনের কোণে একটু কষ্ট সহকারেই প্রিয় জামাটি বের করে যমুনাকে দিয়ে দিল। ছোটবেলা থেকেই মাধুরী বাবার কাছে শিখেছে, গরীব মানুষকে দিতে হয়। তাদের থেকে অনেক গরীব ছেলে মেয়ে আছে। সেছাড়া নিজেও সমাজে মিশতে গিয়ে দেখেছে, তার সমবয়স্ক গরীব মেয়ে গুলিকে।

ওদিকে মণিকা দেবী যমুনাকে নিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাবান মাখিয়ে স্নান করাতে। শেখানে যমুনা আর মণিকা দেবীতে এক কান্ড বেধে গেল। যমুনা কিছুতেই গায়ে সবান মাখবে না। মণিকা দেবী প্রচুর বোঝানোর চেষ্টা করে চললেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে। আর যতই তিনি বোঝান, ততই যমুনা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকে – এ কি আনি (রানী) হবু নাকি? সাবুন মেকে কি কইলা ফস্যা হয়? তুমাদের মতুন ক্যামনে আমি হবু? মণিকা দেবীর দুই মেয়ে বেশ মজা সহকারে যমুনার কীর্তি দেখতে লাগল। মণিকা দেবীও ছাড়ার পাত্রী নন। শেষ পর্যন্ত ঘষা মাজা করে, যমুনাকে নতুন জামা পরিয়ে দিয়ে তারপর আচার বের করলেন। মাস্টার মশাই ততক্ষণে যমুনাকে রেখে নিজের কাজে উধাও।

এরপর থেকে যমুনা মাস্টার মশায়ের বাড়িতেই পরিচারিকার কাজটি পেল। পূর্বে যে কাজ করত, তাকে বুঝিয়ে বলা হল, যে সে চাইলে অন্য বাড়িতে কাজ পেয়ে যাবে। কিন্তু এই মেয়েকে তো কেউ কাজে রাখবে না। ফলে আগাম কিছু টাকা নিয়ে পূর্বের পরিচারিকা অন্য বাড়িতে কাজ দেখে নিল। কিন্তু যমুনার তো গৃহ পরিচারিকার কাজের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। সাধারণত ভদ্র পাড়ার কাছাকাছি এলাকা থেকেই কাজের লোকেরা আসত। ফলে ভদ্র সমাজের আচার ব্যবহার ও ভাষার সঙ্গে ওরা ছোটবেলা থেকেই পরিচিত হয়ে উঠত। আর বছর দশেক বয়স থেকেই মায়ের সঙ্গে কাজের বাড়িতে গিয়ে ভদ্র বাড়ির গৃহকর্মে দক্ষতা অর্জন করতে থাকত। অতটা ভেতরের পাড়া থেকে কেউ কাজের লোক রাখত না। ভদ্র সমাজের সঙ্গে যমুনাদের পরিচয় শুধুই চোখের দেখায়। ফলে যমুনাকে দিয়ে কাজ করাতে গিয়ে প্রতি পদে পদে মণিকা দেবীকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হল। আর তিনি স্বামীকে সেজন্য দায়ী করে যখন তখন রাগ প্রকাশ করতে লাগলেন। যমুনা কোনদিন সানের মেঝে মোছেনি। ফলে মাটির ঘর নিকানোর পদ্ধতিতে সে ঘর মুছতে যায়। তাই দেখে মণিকা দেবী তাকে সঠিক পদ্ধতি শেখাতে গেলে হঠাৎ রেগে গিয়ে যমুনা তার বাবা মার উদ্দেশ্যে অশ্লীল গালাগালি সহকারে বলে ওঠে – কম্ম করার ক্ষমুতা ছ্যালু না তো জম্মু দেছেলু ক্যানে? ভাড়া বাড়িতে আশপাশের ঘর থেকে খারাপ গালাগালি ও বাবা মার উদ্দেশ্যে এই ভাষা প্রয়োগ শুনে গৃহকর্ত্রী ও যমুনার সমবয়স্ক কাজের মেয়েগুলি ছুটে আসত। ভদ্র সমাজে অশালীন গালাগালির প্রতিবাদ করত তারা। এখানে এসব চলবে না, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিত। যমুনা শ্রেণী বৈষম্যের জন্য ভদ্র সমাজের সকলকেই গালাগালি করতে থাকলে, মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব পড়ল মণিকা দেবীর ছোট মেয়ে মাধুরীর উপর। সে তখন শ্রেণী বৈষম্য দূর করার জন্য যমুনার সঙ্গে কাজে হাত লাগালো। বাসন মাজা, ঘর মোছা ইত্যাদি মাধুরী নিজের হাতে করে যমুনাকে শেখাতে লাগল। যমুনা তাতে একটু খুশি হল। মাধুরী ও যমুনাতে একটু ভাবই হয়ে গেল। মাধুরী যমুনার প্রতি ক্রমশ সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল। সচ্চিদানন্দ বাবুও যমুনাকে যথা সম্ভব খুশি রাখার চেষ্টা করলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া, কাজকর্ম ও মাধুরীর সঙ্গে গল্প করে যমুনা বাড়ি চলে যেত। বন্যা পরিস্থিতি ততদিনে দূর হয়েছে।

কিন্তু মাধুরীর অন্য গরীব বন্ধুরা, আশপাশের ভাড়া বাড়ির কাজের মেয়েরা তাবলে যমুনাকে পছন্দ করে উঠতে পারল না। তারা যমুনার ভাষা নিয়ে তাকে বিদ্রুপ করত। পাশেই কুমোর বাড়ির যুবকদের খারাপ চাউনি দেখলে যমুনা গালাগালি দিয়ে গোলমাল বাধিয়ে দিত। এই সব কিছুরই মীমাংসা যমুনার থেকে বয়সে ছোট মাধুরীকেই করতে হতো। কারণ মাধুরীর বাবা যমুনার দায়িত্ব মাধুরীর উপরই দিয়েছিলেন।

ধীরে ধীরে বছর কাটল। যমুনা নিজস্ব চরিত্র বজায় রেখেই গৃহকর্ম ও ভদ্র সমাজের আচার ব্যবহার রপ্ত করে ফেলল। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিজস্ব ভাষা ত্যাগ করল না। আর ওর ওই ভাষা শুনতে শুনতে একসময় সকলেই অভ্যস্ত হয়ে গেল। আরো দিন যায়। যমুনা বড় হয়ে ওঠে। একসময় নিজেই শাড়ি পরা শুরু করে। বোঝা যায় এবার তার বিয়ের সময় এসেছে। চিন্তিত মাস্টার মশাই যমুনার বাবা মা ও পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। যমুনার ন্যায় দরিদ্র ঘরের মেয়ের চাহিদা বলতে তো পেট ভরে খাওয়া টুকু ছাড়া আর কিছু নেই। ফলে বিয়ের বিষয়ে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হল না সচ্চিদানন্দ বাবুকে। ওদের পাড়ারই এক খেটে খাওয়া যুবকের সঙ্গে সকলে বিয়ের
স্থির করল। সচ্চিদানন্দ বাবু শুধু দেখলেন, যুবকটির শরীর স্বাস্থ্য খেটে খাওয়ার মতো কিনা ও তার মদ্যপানের বদভ্যাস আছে কিনা। সেদিক থেকে উত্তীর্ণ হওয়ায় ওখানেই যমুনার বিয়ে স্থির হল। বিয়েতে ওদের কিছু পাড়া প্রতিবেশী ও পার্টি কর্মী সহ সচ্চিদানন্দ বাবু নিমন্ত্রিত হলেন। সকলে চাঁদা তুলেই বিয়ের ব্যয় ভার বহন করল।

মণিকা দেবী নিজে এসে তার বিয়ের বেণারসী ও কানের এক জোড়া সোনার দুল, দু’হাতে দু’গাছি সোনার চুড়ি পরিয়ে দিয়ে গেলেন। কনের সাজে যমুনার কৃষ্ণ বর্ণ মুখে লাজুক হাসির রেখা তাকে অপূর্ব করে তুলল। যমুনা মাস্টার মশাই ও মণিকা দেবীকে প্রণাম করল। মাধুরী স্নেহারাও দেখতে এসেছিল সেদিন। যমুনাকে দেখে সকলের মন ভরে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানে সচ্চিদানন্দ বাবুই রইলেন। তার পরিবার যমুনাকে দেখে বাড়ি ফিরে গেল। মণিকা দেবীর চোখ থেকে দু এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল, যার কারণ তার দুই মেয়ে কেউই বুঝে উঠতে পারল না।
(সমাপ্ত)
লেখিকা – অরণ্যানী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *