গিরিশ ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা ✒️✒️ পাপিয়া সাহা

গিরিশ ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা 

পাপিয়া সাহা

নবম পর্ব
পূর্ব প্রকাশিতের পর

1870 খ্রীষ্টাব্দ থেকে বাংলা রঙ্গমঞ্চে নারীরাই নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে শুরু করল। তবে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা থিয়েটারে এগিয়ে এলো না। তাই থিয়েটারের মালিকরা বারাঙ্গণা বা ওই ধরনের মেয়েদের মঞ্চে অভিনয়ে নিযুক্ত করল। ফলে গোঁড়া আচার সর্বস্ব ভূয়ো নীতিবাগীশরা থিয়েটার বর্জন করল। কিন্ত উদারপন্থীরা বারাঙ্গণা বা বাইজীদের থিয়েটারে নিযুক্তিকরন সমর্থন করল। কারন তারা উপলব্ধি করেছিল যে থিয়েটার বাংলা কৃষ্টি সংস্কৃতি ও শিল্প বিস্তারের একটি সুন্দর সহায়ক সংস্থা। যে সব বারাঙ্গণা নারীরা বাংলা রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে থিয়েটার শিল্পকে এক অভূতপূর্ব উৎকর্ষতা এনে দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছিল এদের মধ্যে বিনোদিনী, তারাসুন্দরী,ও তিনকড়ি অভিনেত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশী খ্যাতি অর্জন করেছিল সেই সময়ে। এই নায়িকারা প্রায় সমসাময়িক হলেও বিনোদিনী ছিল বয়সে খানিকটা বড়।উপেন্দ্র নাথ বিদ্যাভূষন ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত, অধ্যাপক ও নাট্য সমালোচক। তার রচিত তিনকড়ি,বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী নামক একটি মূল্যবান গ্রন্থ থেকে আমরা এই তিন অভিনেত্রীর নাট্যজীবন, নাট্যপ্রতিভা ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে পারি।কেননা তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী।
পদ্মের মূল দুর্গন্ধযুক্ত কাদার মধ্যে থাকে, কিন্ত পদ্মনাল জলের ভিতর দিয়ে কুঁড়ি রুপে উপরে উঠে বিকশিত হয়। বিনোদিনীর মত তারাসুন্দরীর জন্মও হয়েছিল উত্তর কোলকাতার এক নিষিদ্ধ পল্লীতে এক বারবনিতার কোলে 1885 সালে।তার দুটি মেয়ে নৃত্যকালী ও তারাসুন্দরী বহু দুঃখ কষ্ট ও অভাবের মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছিল। তারার মা ও বিনোদিনীর মায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। তারার মায়ের অনুরোধে মাত্র ছ বছর বয়সে তারাকে বিনোদিনী থিয়েটারে ভর্তি করে দেয় অভিনেত্রী হবার জন্য এবং প্রসিদ্ধ নাট্যকার ও অভিনেতা গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। “চৈতন্য লীলা”নাটকে একটি বালকের ভূমিকায় তারার আবির্ভাব হল স্টার রঙ্গমঞ্চে। কিন্ত একজন বিখ্যাত ধনী গোপাল লাল শীল স্টার থিয়েটার কিনে নেওয়ায় ওই মঞ্চের নাম হল রেভারেণ্ড। মঞ্চ পরিচালক বিখ্যাত অমৃত লাল মিত্রের কাছে তারার প্রথম অভিনয় শেখা শুরু হল। পরিচালকের নির্দেশে তারার প্রাণবন্ত অভিনয়,সুন্দর সরল নিষ্পাপ মুখখানি দর্শকদের মুগ্ধ করল।1888 সালে গিরিশ চন্দ্র পুনরায় স্টার থিয়েটারে ফিরে এলে তারার গিরিশ চন্দ্রকে ভাল করে দেখবার ও চিনবার সুযোগ হল। মাত্র দশ বছর বয়সে তারাসুন্দরী প্রথম নারীর ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্রের “চন্দ্রশেখর উপন্যাসের নাট্যরূপে তারা শৈবলিনীর ভূমিকায় অভিনয় করল।তারার প্রাণবন্ত অভিনয় সকল দর্শকদের মুগ্ধ করল। দর্শকবৃন্দ স্বীকার করল যে এতদিন পর তারা বঙ্কিম চন্দ্রের জীবন্ত শৈবলিনী দেখতে পেল।

পনের ষোল বছর বয়সের অভিনেত্রীর জীবন বড়ই বিপজ্জনক। নানা প্রলোভন,প্ররোচনা অভিনেত্রীর জীবনকে প্রলুব্ধ করতে উদ্যত হয়। ঠিক সেভাবেই অমরেন্দ্র নাথ দত্ত নামে এক ধনী যুবক তারাকে প্রলুব্ধ করল ও তাকে থিয়েটার থেকে সরিয়ে নিয়ে কোলকাতার সন্নিকটে বাগমারি বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল। কিছুদিন পর সঞ্চিত অর্থ ক্রমশঃ নিঃশেষ হতেই প্রেমের নেশা কেটে গিয়ে তাদের জীবনে নামল নিষ্ঠুর দারিদ্র্যের ঘন মেঘ।এরপর গিরিশ চন্দ্র বাগমারিতে গিয়ে তারাকে মিনার্ভা নাটকে করমেতির ভূমিকায় অভিনয় করতে অনুরোধ করলেন। তারা গিরিশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে না পেরে মাত্র তিনদিনের রিহার্সালে অভিনয়ে নামল এবং প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করল। গিরিশ চন্দ্র তার পিঠ চাপড়ে আশীর্বাদ করলেন এবং বললেন “বেটি আমার আশীর্বাদে বঙ্গ নাট্যশালার তুই একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হবি। “এরপর 1897 সালের16 ই এপ্রিল “নল দময়ন্তী”তে তারা দময়ন্তীর ভূমিকায় অভিনয় করল। আগুনের মত প্রতিভাকেও চেপে রাখা যায় না তা স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পরে।এভাবেই তারার অভিনেত্রী জীবন পুরোদমে এগিয়ে চলল। “হারানিধি” “তরুবালা” “বিল্বমঙ্গল ঠাকুর “”দেবী চৌধূরানী” দূর্গেশনন্দিনী” “শৈবলিনী” “রামানুজ” “রিজিয়া” প্রতিটি নাটকে প্রধান নারী চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীর শিরোপা লাভ করেছিল। ব্রাহ্ম নেতা বিপিন চন্দ্র পাল তারার রিজিয়া দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি হিন্দু রিভিউতে তারার ছবি সহ প্রবন্ধ লেখেন। এটা একটা বিরল ঘটনা। কেননা তখনকার দিনে কোনও বারবনিতার ছবি ব্রাহ্ম বা হিন্দুধর্মের পত্রিকাতে প্রকাশ হোতনা। 1904 সালে তারা অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামে এক সুদর্শন অভিনেতার প্রেমে পড়ে। তাদের নির্মল ও প্রতিভা নামে এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়।
অর্থ, যশ,নাম, সফলতা তারার জীবনে প্রচুর এসেছিল বটে কিন্ত এগুলো তার জীবনকে পরিপূর্ণতা এনে দিতে পারেনি।সে অন্তরে একটা শূন্যতা অনুভব করত।একদিন থিয়েটারের অফিস ঘরে সকল অভিনেতা অভিনেত্রী গিরিশ চন্দ্রের সম্মুখে সমবেত হল।গিরিশ ঠাকুরের কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পাপী,তাপী,পতিতা,সকলের আশ্রয় স্থল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্তরঙ্গ শিষ্য সর্বত্যাগী সন্যাসী অকৃত্রিম স্নেহে তারাকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা দিলেন ও অভয়বানী প্রদান করলেন। তারার জীবনের সংশয়,দ্বিধা,দ্বন্দ্ব সব অন্তর্হিত হল। তার উপলব্ধি হল যে শ্রী শ্রী ঠাকুর শ্রীশ্রী মায়ের করুণা সে প্রাপ্ত হয়েছে। 1922 সালে তার পথ প্রদর্শক মন্ত্রগুরু স্বামী ব্রহ্মানন্দের প্রয়ানের পর শোকে দুঃখে তাপে তার ভিতর তীব্র বৈরাগ্য ভাব জাগল।অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ও উন্মাদনা তারার ভেতর থেকে বিসর্জিত হল।স্বামী শিবানল্দের পরামর্শ অনুযায়ী ভুবনেশ্বরে ঠাকুরের নামে একটি মন্দির নির্মাণ করে তার নাম দিল
“রাখাল কুঞ্জ “।মন্দিরে ঠাকুর মা স্বামীজির ছবি প্রতিষ্ঠা করল। 1933 সালে তারা কোলকাতা রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়ে ভুবনেশ্বরে তার নির্মিত রাখালকুঞ্জে একমাত্র কন্যা প্রতিভার সাথে প্রায় বারো বছর ধরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আরাধনায় জীবন অতিবাহিত করল।তারপর ধীরে ধীরে জাগতিক মায়ার বন্ধন কাটিয়ে অভিনয় জীবনের স্মারক উপহার গুলি পুঁড়িয়ে ফেলে তীব্র বৈরাগ্য ভাব নিয়ে ঠাকুরের অনন্ত আহ্বানে সাড়া দিতে উন্মুখ হল।চৈত্র মাস রামনবমীর পরের দিন সকাল দশটা পঞ্চান্ন মিনিটে ঠাকুরের ছবির সামনে লুটিয়ে পরে জাগতিক মঞ্চ থেকে বিদায় নিল। একটি সার্থক সাধিকা অভিনেত্রীর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল।
প্রত্যেক মানুষই এ জগতে আত্মার তিনটি শক্তি নিয়ে জন্মায়। জ্ঞান শক্তি, ইচ্ছা শক্তি ও ক্রিয়া শক্তি।এই তিনটি শক্তির তারতম্যের জন্যই মানুষে মানুষে প্রভেদ পরিলক্ষিত হয়।কিন্ত গিরিশ চন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক তিন প্রখ্যাত অভিনেত্রীর মধ্যে তিনকড়ির ভেতরে এই তিন শক্তির উন্মেষ প্রবল ভাবে ঘটেছিল। তাই সে বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রখ্যাত অভিনেত্রী হয়ে উঠতে পেরেছিল।1870 সালে কোলকাতার এক নিষিদ্ধ পল্লীতে তিনকড়ির জন্ম হয়। তার মায়ের আর্থিক অবস্থা বিনোদিনী বা তারাসুন্দরীর মত অতটা খারাপ ছিল না। মাত্র চার বছর বয়সেই বালিকা তিনকড়ির মধ্যে প্রতিভার স্ফূরণ দেখা যায়। ছেলেবেলা থেকেই সে ছিল অত্যন্ত দয়ালু ও মমতাময়ী। পরবর্তি কালে মঞ্চেও প্রতিটি ভূমিকায় সে তার হৃদয়ের তীব্র আবেগ প্রকাশ করে দর্শকদের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল এবং শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীর শিরোপা লাভ করেছিল।
1881 সালের আশ্বিন মাসে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে গিরিশ চন্দ্রের “রাবন বধ “চলছিল। এগারো বছরের বালিকা তিনকড়ি মায়ের সাথে থিয়েটার দেখতে গিয়ে নাট্যকার ও প্রখ্যাত নট গিরিশ চন্দ্রের অভিনয় দেখে তন্ময় হয়ে গেল এবং সেই থেকেই অভিনেত্রী হবার সুপ্ত বাসনা তার মনকে দখল করে নিল। তখন বঙ্গরঙ্গমঞ্চে সুবিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী দাপিয়ে অভিনয় করছিল।তখনকার দিনে অভিনেত্রী হওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। থিয়েটারের সংখ্যা কম ছিল বলে নট নটীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। যা হোক ষোল বছর বয়সে তিনকড়ির জীবনে মঞ্চে অভিনয় করার এক সুযোগ এল।রাজকৃষ্ণ রায়ের “বীণা” থিয়েটারে মীরাবাই নাটকে তিনকড়িকে মীরার ভূমিকা দেন।তিনকড়ি রূপে সঙ্গীতে এবং অভিনয়ে অনায়াসে দর্শকদের চিত্ত জয় করে নেয়। অভিনেত্রীদের রূপ যশ প্রতিভা ও জনপ্রিয়তা চিরকাল তাদের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।ঠিক সেইরূপ তিনকড়ির জীবনেও কামাতুর,লোলুপ ধনীর সংখ্যা কম ছিল না যারা তিনকড়িকে শর্ত সাপেক্ষে থিয়েটার ছাড়িয়ে অর্থের বিনিময়ে কলুষিত জীবনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্ত তিনকড়ি কিছুতেই থিয়েটার ছাড়তে রাজি ছিলনা।অভিনেত্রী হওয়াই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। যাই হোক নিজের জেদ ও একাগ্রতা দিয়ে সে অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগল। বিখ্যাত অভিনেতা মহেন্দ্রলাল বসু তিনকড়ির মীরাবাই দেখে মুগ্ধ হন। তিনি তিনকড়িকে দ্বিগুণ মাইনে দিয়ে এমারেণ্ডে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। কিছুদিন পর আর্থিক অনটনের জন্য থিয়েটার কর্তৃপক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রীদের মাইনে কমাতে লাগলেন। কিন্ত তিনকড়ির আত্মসম্মান বোধ এত প্রবল ছিল যে অবমাননা সহ্য করতে না পেরে থিয়েটারে কাজ করা বন্ধ করে দিল। কিন্ত কিছুদিন পরই সিটির ম্যানেজার নীলমাধব মূখার্জী একই মাইনেতে আবার তিনকড়িকে থিয়েটারে নিযুক্ত করলেন। তিনকড়ির চেহারা ছিল একহারা লম্বা ফর্সা উজ্জ্বল আয়তলোচনা। তার গলার স্বর ছিল মিষ্ট ও তেজদীপ্ত। এবং তার আচরণ ছিল চটপটে, প্রাণবন্ত ও সাবলীল। নানা ঘাত প্রতিঘাতের পর তিনকড়ি গিরিশ চন্দ্র ঘোষের ম্যাকবেথ অভিনয় করল।ম্যাকবেথের প্রাণবন্ত অভিনয় এত প্রশংসিত হল এবং দর্শক চিত্তকে আকৃষ্ট করেছিল যে তিনকড়ির মাহিনা দ্বিগুণ করা হইল। এরপর পৌরাণিক সামাজিক নানা নাটকে নানা প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে তিনকড়ি দর্শক মনে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার আসন লাভ করে শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীর শিরোপা অর্জন করিয়াছিল।
তিনকড়ির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। বহু ধনীর দ্বারা যৌবনে সে প্রলুব্ধ হইয়াছে কিন্ত একজন প্রনয়ীর সাথেই কেবল সে বাস করিয়াছে। অভিনেত্রীদের প্রনয়ী বা গান্ধর্ব মতে বৃত্ত পতিকেই থিয়েটারের ভাষায় বাবু বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। তিনকড়ির রূপ,প্রতিভা, সহৃদয়তা ও আবেগ পূর্ণ অভিনয় দেখিয়া গিরিশ চন্দ্রের এক ধনী বন্ধু তাহার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। তিনকড়ি এই বিষয়ে গিরিশ চন্দ্রের সাথে পরামর্শ করার পর গিরিশ চন্দ্র রূপ যৌবন অর্থের চাইতে থিয়েটার শিল্প কলাকেই প্রাধান্য দিলেন। তিনকড়ি গিরিশ চন্দ্র অর্থাত তার গুরুর আদেশ কেই প্রাধান্য দিয়া গুরুর আদেশ ই মানিয়া লইল।তিনকড়ি খুব ধর্ম পরায়ন ছিল। তার হৃদয়ের অন্তস্থলে পবিত্র আধ্যাত্মিকতা ফল্গুধারার মত এক স্নিগ্ধ স্রোত প্রবাহিত হইত।তার প্রাত্যহিক জীবনও আড়ম্বর পূর্ণ ছিল না। বাল্যকাল হইতেই ঈশ্বরের প্রার্থনা না করিয়া সে শয়ন করিতে যাইত না।
ভক্ত ভৈরব গিরিশ চন্দ্র অভিনেতা অভিনেত্রীদের আধ্যাত্মিকতার পথেও অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রী শ্রী মা সারদা ও তাদের অনুরক্ত শিষ্যদের সম্পর্কে নানা কথা বলে তাদের কর্ম ও ধর্ম পথে উদ্বুদ্ধ করতেন। 8ই ফেব্রুয়ারি 1912 সাল মহাপণ্ডিত নাট্যগুরু গিরিশ চন্দ্র ঘোষ দেহ রাখেন। পরম গুরু ও উপদেষ্টার মৃত্যুতে তিনকড়ি দারুণ আঘাত পেল এবং নিয়মিত অভিনয় করা ছেড়ে দিল। থেসপিয়ান টেম্পেলের ম্যানেজারের আন্তরিক অনুরোধে 1915সালের 7th আগষ্ট থেকে 22 শে অক্টোবর পর্যন্ত মনমোহন থিয়েটারে শেষ অভিনয় করে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে মন দিয়ে নটরাজের পূজো করে গেছে। 1997 সালে তার বাম বাহুতে কারবাঙ্কল দেখা দিল। অনেক স্বনামধন্য বিখ্যাত ডাক্তার তার চিকিৎসা করিয়াছিল। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে তার অপারেশন হল। কিন্ত ঐ ঘা সেপটিক হইয়া তাহার সর্বাঙ্গে ছড়াইয়া পরিল।সার্জারি চিকিৎসা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। তিনি জগত মঞ্চ হইতে বিদায় লইল।তার বিচিত্র কর্মময় জীবন লীলা সাঙ্গ হইল।তাহার দেহ বিবিধ পুষ্প ও পুষ্প মাল্যে সজ্জিত করা হইল। কোলকাতার প্রায় সব অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা তাকে সম্মান জানাইতে জড় হইয়াছিল। কোলকাতার নিমতলা শ্মশানে চন্দন কাঠ, ঘি গুগগুল, শাল নির্যাসে সজ্জিত চিতায় তিনকড়ির নিথর পার্থিব দেহ বিশ্বপাবন অগ্নিদেব নিঃশেষিত করে তার প্রার্থিত দিব্য নটনাথের ধামে পৌঁহুছাইয়া দিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনকড়ি একখানা উইল করিয়া গিয়াছিল। সেই উইলের শর্ত অনুযায়ী তাহার দুইখানা বাড়ি বড়বাজার হাসপাতালে প্রদান করা হইয়াছিল। আর একখানি বাড়ি তাহার বাবুর পুত্রকে প্রদান করা হইয়াছিল। তাহার অলঙ্কারাদি ও গচ্ছিত টাকা হইতে তাহার বাটির প্রত্যেক ভাড়াটিয়াকে পঞ্চাশ টাকা করিয়া দাওয়া হইয়াছিল। এবং আর বাকি টাকা তার অন্ত্যেষ্টি কার্য অর্থাত শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের খরচ বাবদ রাখা হইয়াছিল। এই উইলের উন্নত প্রকৃতি হইতে বোঝা যায় যে কত বড় হৃদয়ের মানুষ ছিল তিনকড়ি। বঙ্গদেশে কত শত সহস্র অভিজাত ধনী মানুষ তাদের সঞ্চিত অঢেল অর্থরাশি উত্তরাধিকারদের উড়াইয়া দিবার জন্য রাখিয়া যান। তাদের মধ্যে কয়জন মানুষ তাদের অন্তিমকাল উপস্থিত হইলে অর্থাত তাদের মানব লীলা সাঙ্গ কালে এই উদার মহৎ প্রবৃত্তির দ্বারা তাদের হৃদয়কে চালিত করিতে পারিয়াছিলেন বা পারেন। তিনকড়ি সম্বন্ধে গিরিশ চন্দ্র বলিয়াছিলেন শুধুমাত্র অভিনয় নৈপুন্যের জন্যই নয় তাহার বিশাল ব্যপ্ত হৃদয় বৃত্তি তাহাকে মুগ্ধ করিয়াছিল।
ধন,জন,যৌবন সবই চঞ্চল ক্ষণস্থায়ী। কেবল যশ ও কীর্তিই সর্বদা অমর রহে। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের পাতায় এই তিন অসামান্যা অভিনেত্রী বিনোদিনী ,তারাসুন্দরী ও তিনকড়ি গিরিশ চন্দ্রের সম্মোহনী যাদুর ছোঁয়ায় অমরত্ব লাভ করিয়াছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *