# যমুনা # – ১ লেখিকা – অরণ্যানী

# যমুনা # – ১

লেখিকা – অরণ্যানী

দীর্ঘ বছর আগের কথা। সালটা তখন ১৯৭৮। সে সময়কার মানুষের মনে নিশ্চয়ই আজও এক ভয়াবহ স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে সমস্ত বাংলা জুড়ে সেই ৭৮ সালের বন্যার। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যারা থাকতেন। তিন চার দিন ব্যাপী অবিরাম ধারায় ঝরে চলা বৃষ্টি, ও সেইসঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। কত প্রাচীন বৃক্ষ শিকড় সহ ভূপপতিত হয়। গ্রামের আশে পাশে নদী থাকুক বা নাই থাকুক, সমস্ত পুকুর, ডোবা, জলাশয়, কূল ছাড়িয়ে রাস্তাঘাট ভাসিয়ে দেয়। কত মানুষের মাটির ঘরের দেয়াল খসে পড়ে। নদী সংলগ্ন অঞ্চলে তো জলের চাপ সইতে না পেরে আচমকা বাঁধ ভেঙে কত মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণ যায়। দোকানপাট সব বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিছু সঞ্চয়ী মানুষ সময় বুঝে প্রয়োজনীয় খাদ্যের ভান্ডার গড়ে নিলেন গৃহে। দেখা দিল চালের অভাব। টাকা থাকলেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব। এমন একটি পটভূমি থেকেই কাহিনীর শুরু।

বিশেষ এক রাজনৈতিক দল তখন সবে মাত্র রাজ্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছে। মানুষের মনে জেগে উঠেছে নতুন আশার আলো। আর ঠিক সেই সময়েই ঘটে এই বিপর্যয়। যে গ্রামের পটভূমিতে কাহিনীটি রচিত, সে গ্রামের মানুষের বন্যা সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অনেক বুঝিয়েও দরিদ্র গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য গৃহ থেকে তাদের স্কুল বাড়িতে নিয়ে আসতে পারছে না। কেন তাদের ঘর ছাড়তে হবে, একবার ঘর ছাড়লে আর তা ফিরে পাওয়া যাবে কিনা, তাই নিয়ে মনে তাদের সংশয়। তারা মরতে হলে নিজের ঘরেই মরবে, তবু আপন গৃহ ছেড়ে অন্যত্র যেতে নারাজ। এই পরিস্থিতিতে গ্রামে বসবাসকারী একজন শিক্ষক এগিয়ে এলেন গ্রামবাসীদের বোঝাতে। তার বোঝানোতে অনেকটাই কাজ হল। গ্রামের স্কুল বাড়িটাই হল আপাতত গৃহহীন গ্রামবাসীদের আশ্রয়স্থল। সরকার থেকে এদের খাদ্য সংস্থানের জন্য এল বস্তা বস্তা চাল, আটা, ডাল, আলু, আর চিরে মুড়ি। দ্রুত কলেরার টীকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হল।

এদিকে বৃষ্টি একটু কমলেও যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে একের পর এক নদীর বাঁধ ভাঙছে। নির্জন গভীর রাত্রে এই গ্রাম থেকেও শোনা যেতে লাগল সেই বাঁধ ভাঙা জলচ্ছাসের ভীষণ গর্জন। যদিও আশেপাশে নদী নেই, কিন্তু নির্জন রাতে দূরের বহু দূরের গ্রামের আওয়াজও মানুষের কানে এসে পৌঁছত। কোন এক গ্রামে নাকি মানুষ নিদ্রারত থাকাকালীন নদীর জল ঢুকে পড়ে বহু ঘুমন্ত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, এমন খবরও শোনা যেতে লাগল রেডিওতে। সংবাদপত্র তখন এই পরিস্থিতিতে কিভাবেই বা পৌঁছবে গ্রামে। ওদিকে পাশের দুটি গ্রাম তখনও একসময়ের মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর চিহ্ন টুকু বহন করছিল। তাও এখন বেশ ছোট খাটো নদীর রূপ ধারণ করে কূল ছাপিয়েছে। পাশের একটি গ্রামের স্টেশনের ওপার পর্যন্ত জল চলে এসেছে!

এ সময় হঠাৎই একদিন স্কুল বাড়িতে আবির্ভাব ঘটল ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, গোলাকৃতি মুখের চোদ্দ পনেরোর এক কিশোরীর। নাম যমুনা। ঘর ভেঙে যাওয়ার কারণে তারও আশ্রয় স্থল এখন স্কুল বাড়ি। স্কুলটির প্রচলিত নাম গ্রামের নামেই। যদিও একটি নিজস্ব বিশাল নাম আছে স্কুলটির। গ্রামের নাম বাকসা। গ্রামে বসবাসকারী শিক্ষক সচ্চিদানন্দ বাবু নামেই ভদ্র সমাজে পরিচিত। যদিও স্থানীয় মানুষ তাকে মাস্টার মশাই বলেই ডাকেন। আর সকল রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তখন মাস্টার মশাই গৃহহীন মানুষ গুলির দেখভাল করে চলেছেন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত। যমুনা মাস্টার মশায়েরই আবিষ্কার বলা যেতে পারে। স্কুল বাড়ির বিভিন্ন ঘরে বিছানা পত্র পেতে গৃহহীন মানুষগুলো অসহায় মুখে সুদিনের অপেক্ষায়। মাস্টার মশাই তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই একটি নির্বোধ কিশোরীকে কিছুতেই আশ্বস্ত করে উঠতে পারছেন না। সে মনের গভীরে কার উপর যে অভিমান করে বসে আছে, তা আন্দাজ করাও কঠিন হচ্ছে সকলের পক্ষে। পরিবারকে অস্বীকার করে বার বারই সে নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সকলে ধরে আনলে বিরক্ত হয়ে গালিগালাজ করছে! কারুর সঙ্গেই মানিয়ে নিতে সে অক্ষম। তার নামই যমুনা। তার শরীরের ভাষাতেই যেন কী এক প্রতিবাদ ফুটে উঠছে সর্বক্ষণ। ঈশ্বরের প্রতি? নাকি যারা এখানে অভিভাবকত্ব করছেন তাদের প্রতি? বোঝা মুশকিল। বেশিরভাগ সময়ই সে নীরব। শুধু কোনও নির্দেশ দিতে এলেই দুর্ব্যবহার! সে খাওয়া হোক, শোয়া হোক, সব কিছুতেই। সকলেই তার মাথায় ছিট আছে, এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হল। শুধু মাস্টার মশাই সচ্চিদানন্দ বাবু বোধহয় কিছু বুঝলেন। সকলের বিদ্রুপ থেকে যতদূর সম্ভব তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন সবাইকে বুঝিয়ে। অনেক অনুনয় বিনয় করে তাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন মাস্টার মশাই। ধীরে ধীরে যমুনা মাস্টার মশায়ের প্রতি কিছুটা সদয় হলে, স্নেহভাজন হয়ে উঠতে থাকল। সচ্চিদানন্দ বাবুর দুই মেয়ে ও স্ত্রী আছেন। যমুনার বয়স তার দুই মেয়ের মধ্যবর্তী। যমুনাকে দেখে বার বার গৃহে নিজের কন্যাদের কথাই তার মনে পড়ছিল। তিনি বাবা মাকে হারান কৈশোরেই। তার নিজের কন্যাদের যদি কখনও যমুনার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় জীবনে? বিশেষ করে তার জেদি ছোট কন্যার? একথা মনে হলেই যমুনার প্রতি স্নেহ যেন আরও বেড়ে ওঠে। এখন খুব কম সময়ই তিনি গৃহে থাকতে পারছেন। সর্বদাই ব্যস্ততা। সকলের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবসর নেই তার। অবশ্যই সহকারী হিসাবে আছে পার্টির কর্মীরা। কিন্তু সরকারের পাঠানো খাদ্য সামগ্রী যদি দরিদ্র পার্টি কর্মীদের মধ্যে কেউ চুরি করে ফেলে, অথবা তাদের নিজেদের মধ্যে কোন কিছু নিয়ে বিরোধ বাধে, তাই রাতের সব কাজ শেষ হলে খাদ্য সামগ্রী তার একটি মাত্র ভাড়া ঘরেরই এক কোণে গাদা করে রেখে তবে তার ছুটি।

যমুনাকে নিয়ে সব থেকে ঝামেলা বাঁধল টীকা দেওয়ার দিন। এমনিতেই ওই শ্রেণীর অনেক মহিলা ও শিশুরা তো বটেই, অনেকেই টীকা নেওয়ার ভয়ে এত বড় স্কুল বাড়ির চারিদিকে লুকিয়ে বসে আছে। গ্রামের হসপিটাল থেকে নার্স এসেছেন কলেরার টীকা দিতে। কিন্তু অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নার্স আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন? যাদের হাতের কাছে পাওয়া গেল, তাদেরই দিলেন। ছোটদের অনেককে খুঁজে নিয়ে এসে জোর করে টীকে নেওয়ানো হল। বাকি কিছু মহিলা, কিশোর কিশোরী, তখনও লুকিয়ে।হাতের লিস্ট দেখে নাম ধরে রাজনৈতিক কর্মীরা ডাকছে তাদের। কিন্তু পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। যমুনাও আছে তাদের মধ্যে। সচ্চিদানন্দ বাবুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অনেক বুঝিয়ে কিছু জনকে রাজি করাতে পারলেন। কিন্তু অনেকেই বাকি রয়ে গেল। নিরুপায় নার্স অপেক্ষা করে চলেছেন। তখন স্থির হল, দুপুরের খাওয়ার আয়োজন হোক। খেতে দিতে শুরু করলেই সকলে এসে জড়ো হবে। তখন টীকে যারা নেয়নি তাদের খেতে দেওয়া হবে না।

কাজ হল এতে। ক্ষুধার্ত মানুষ গুলো এসে জড়ো হল, ও খাওয়ার জন্য টীকে নিতে বাধ্যও হল ভীতি সহকারে। যমুনাও এল। কিন্তু তার প্রশ্ন, খেতে গেলে টীকে কেন নিতে হবে? একটু খেতে দেবে বলে গায়ে সুঁচ ফোটাতে হবে? দরকার নেই আমার অমন খাওয়ার। সে শুকনো মুখে পেটে ক্ষিদে নিয়ে খাবারের সামনে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। কিশোরী বয়স। পার্টি কর্মীরা যুবক। জোর করে গায়ে হাত দিয়ে চেপে ধরতে পারছে না তাকে। ফলে তাদের মাস্টার মশাইকে অনুরোধ করে যাচ্ছে। মাস্টার মশাই টীকে নেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলে শেষ পর্যন্ত এতদিনের জমে থাকা রাগ, অভিমান, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, সবই অশ্রুর স্রোতে আচমকা ঝরে পড়তে থাকল নীরবে যমুনার দু’চোখ থেকে। সচ্চিদানন্দ বাবু কর্মীদের বললেন যমুনাকে আগে খেতে দিতে। তারপর উনি দায়িত্ব নিয়ে ঠিকই বুঝিয়ে ওকে টীকে নেওয়াবেন। ক্ষুধার্ত একটি মানুষের প্রতি এটি অবিচার হচ্ছে। যমুনাকে বললেন, টীকে নিতে তোকে হবে না। তোর খিদে পেয়েছে, পেট ভরে খা।

খাওয়া শেষ হতে সচ্চিদানন্দ বাবু অনেক বুঝিয়েও এই নির্বোধ কিশোরীকে রাজি করাতে না পারায়, শেষে সবাই ধরে জোর করেই টীকে নিতে বাধ্য করল যমুনাকে। টীকে নিতে গিয়ে তার যতটা না লাগল, তার থেকে বেশি লাগল আত্ম মর্যাদায়। এরপর আর সে কিছুতেই সেখানে থাকতে রাজি নয়। “না খেয়ি মরবু, ভিক্কে করবু, তব্বু ইকানে থাকবুনিকো।” এই বলে সে খালি হাতে তার বাবা মার হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সচ্চিদানন্দ বাবু এসে দাঁড়ালেন সামনে পথ আটকে। অভিযোগের সুরে যমুনা বলল, তুম্ম যে বলিছিলে ইজ্জেছন নিতি হবি না। তবি উরা ক্যানে দিলে? সচ্চিদানন্দ বাবু সে কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মাথায় স্নেহের স্পর্শ রেখে বললেন, চল, আমার বাড়িতে যাবি। এখানে তোকে থাকতে হবে না। যমুনা কিছুটা অভিমান ভুলে আব্দারের সুরে বলল, তুম্মর বাড়ি গেলি আচার খেতি দিবে? সচ্চিদানন্দ – হ্যাঁ, তোর জেঠিমা আচার বানায়। বললেই দেবে। সেই শুনে সন্তুষ্ট হয়ে যমুনা চলল সচ্চিদানন্দ বাবুর বাড়িতে। ওর বাবা মাও কোনও আপত্তি করল না। অন্য অনেকেই ভাবল, আপদ বিদায় হয়েছে, বাঁচা গেছে। কেউবা মাস্টার মশাইকে কানে কানে বলল, ওর মাথায় কিন্তু ছিট আছে। ওকে নিয়ে মুশকিলে পড়তে হবে। মাস্টার মশাই সে কথায় কান দিলেন না। যমুনাকে নিয়ে এলেন তার বাড়িতে।
(ক্রমশ)
লেখিকা – অরণ্যানী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *