ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (চতুর্থ পর্ব) ✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (চতুর্থ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় একটা নতুন শব্দের সাথে পরিচিতি হয়েছিল, তা হল “রামসার সাইট”। আসলে ইরানের রামসার শহরে জলাশয় সংরক্ষণের নিমিত্তে প্রথম আন্তর্জাতিক অধিবেশন বসে। তাই সেই শহরের নামানুসারে সংরক্ষিত জলাশয় অঞ্চলগুলিকে রামসার সাইট বলে। উদাহরণ হিসেবে কিছু জানা নাম শিক্ষার্থীদের দিয়েই বলিয়ে নিয়েছিলেন স্যার, যেমন, উলার, অষ্টমুদি, ভেম্বানাদ, লোকটাক, চিলিকা। আরও কিছু নাম ছিল যা আমরা জানতাম, কিন্তু তারা এখনও সে মর্যাদা পায়নি, যেমন মহানন্দা, গজোলডোবা, দোমোহনি। অর্থাৎ আমাদের কাছাকাছি কোনো রামসার সাইট নেই। স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমাদের সবচেয়ে কাছের রামসার সাইট কোনটি? পশ্চিমবঙ্গে কি একটাও নেই? স্যার বলেছিলেন আছে। ইস্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যাণ্ড, যার আমাদের থেকে দূরত্ব প্রায় ৬০০ কিমি। কিন্তু এরও কাছে আছে দিপর বিল, ৪০০ কিমি দূরে, গুয়াহাটি শহরের কাছে। এরপর কয়েকবার কলকাতা গেলেও সঙ্গীর অভাবে ইষ্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যাণ্ড দেখা হয়নি। যাইহোক এবার গল্পে আসি। গুয়াহাটি থেকে দু’টো বাচ্চা ছেলেকে সাথে করে ফেরার জন্য কামাক্ষা স্টেশনে অপেক্ষা করছি। ওদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করে ফেরার পথে শুনলাম ট্রেন লেট। ১০:৪০ নাগাদ ট্রেনে উঠলাম। আমরা সাধারণত সরাইঘাট ব্রীজ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে পশ্চিমে অগ্রসর হই। আজ সকাল হওয়ায় ভাবলাম দিনের বেলা ব্রহ্মপুত্র দেখবো। ওরা দু’জনে আপার বার্থ পেয়ে উপরে উঠে গেলো। একে শীতকাল, তার ওপর এসির হাওয়া খুব একটা ভালো না লাগায় আমি বাইরে এসে দরজায় দাঁড়ালাম। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও কোন ব্রীজ চোখে পড়লোনা। শুধু বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি, আর মাঝে মাঝে জলের দেখা মিলছিল। দূরে কামাক্ষা পাহাড় দেখা যাচ্ছিলো। যেখানে জল নেই সেখানেও প্রচুর শুকনো কচুরিপানার দেখা মিলছিল, যার মানে দাঁড়ায়, এখানে বর্ষায় যথেষ্ট জল হয়। কিছু পাখির দেখাও মিলছিল ইতস্তত। আর মনে হচ্ছিল যেন আমাদের ট্রেনটা সমানে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরছে। হঠাৎ মনে পড়লো এই তবে আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত রামসার সাইট দিপর বিল। জিপিএস খুলে চেক করলাম, ঠিক তাই। আমার এক অসাধারণ অনুভূতি হতে লাগলো। এই সেই সারপ্রাইজ যা আগের পর্বে পড়েছিলাম। মাঝে মাঝে যেখানে বিলের ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে সেই ছোট ব্রীজগুলির আগেও দেখা মিলছে সাইনবোর্ডে ব্রীজের নম্বরের সাথে বিলের নাম। এরপর যেন জলের পরিমাণ বাড়লো। এখানে হ্রদের মাঝে চোখে পড়লো ছোট ছোট দ্বীপ। সাত-আটটা নৌকো বাঁধা রয়েছে। এগুলো সবই স্থানীয় জেলেদের নৌকো। মাছধরাই ওদের প্রধান উপজীবিকা। এই বিলের স্বাস্থ্যের ওপর ওদের ও ওদের অর্থনীতির স্বাস্থ্য নির্ভর করে। ১৪ টি গ্রামের ১২০০ পরিবারের জীবন এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবার একটু বলি নামকরণ নিয়ে। দিপর বিল বানান দেখলে বোঝা যাবে এ নাম দিয়ে দ্বীপের কথা বোঝানো হচ্ছে না। সংস্কৃত শব্দ ‘দ্বিপ’ অর্থ হাতি। অর্থাৎ দিপর বিল অর্থ হাতিদের বিল। একদা ব্রহ্মপুত্রের গতিপথে থাকলেও পরবর্তীতে গতিপথ পরিবর্তন করে নদ, আর বয়ে যায় উত্তর দিয়ে। ২০০২ সালে এই বিল রামসার সাইট তকমা পায়। ৪০.১৪ বর্গকিমি বিস্তৃত এই বিল নেহাত ছোট নয়। এই বিলের উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে খাঁড়া রানী ও গারভাঙা পাহাড়। উপত্যকাটি অনেকটা ইংরেজি ‘U’ আকৃতির। দুটি ছোট নদী বশিষ্ঠ ও কালমানি এসে মিসেছে এখানে। তাছাড়া বৃষ্টির জলই এর প্রধান উৎস। এর সাথে সাথে বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রে জলস্ফীতি হলে সেই জলও এসে পড়ে এখানে। কচুরিপানার সাথে সাথে সাকসেশনের জন্য দেখা মেলে মাখনা তথা থেকে শুরু করে সেগুন গাছও। আমার ডিসার্টেশন ছিল অ্যাকোয়াটিক ফ্লোরার ওপর। একসাথে পিস্টিয়া, ওট্টেলিয়া, হাইগ্রোরাইজা, আইকর্ণিয়া, নিম্ফিয়া, নিম্ফয়ডিস, নিলাম্বো, অ্যাপোনোজেটন, পটামোজেটন, ভ্যালিসনারিয়া, হাইড্রিলা, লেমনা, ইউট্রিকুলারিয়া, স্যাজিটারিয়াকে দেখার সৌভাগ্য আমার এই প্রথম হল। ট্রেন তুলনামূলক ধীর গতিতে চলছে এখানে, সম্ভবত বাঁক থাকার দরুণ। দু’টো পেলিকান পাখি ভাসছে জলে। কি অদ্ভুত ওদের ঠোঁট। অজস্র পরিযায়ী পাখি রয়েছে। হ্রদের ধার ঘেঁষে গোলাপি ক্লিওম হাউট্টিয়ানা ফুলের মেলা। এভাবে একসময় দিপর বিল শেষ হয়ে গেল, কিন্তু মন খারাপের সুযোগ নেই। এতক্ষণ উত্তরে চেয়ে ছিলাম, এখন দক্ষিণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। এই রেলপথে জার্নি আমার কাছে নতুন, তাই যাই দেখি নতুন মনে হয়। পর্ণমোচী অরণ্য চোখে পড়ছে। নয়ানজুলি রয়েছে। আর রয়েছে ছোট শুষ্ক নদী খাত। এরপর দেখা মিলল মেঘালয় মালভূমির সম্প্রসারিত অংশ। লাল মাটি বলে দিচ্ছে ওই তো মেঘালয় তোমার হাতের কাছেই। সত্যিই তাই। রেলপথ পাতা হয়েছে দুই রাজ্যের সীমান্তের কাছেই। কাছেই বিচ্ছিন্ন পাহাড়। এরপর হঠাৎ একটা বড় নদী পেরোতে লাগলো ট্রেণ। না না, নদী নয় নদ। ব্রহ্মপুত্র ক্রস করছি নরনারায়ণ সেতু দিয়ে। ডাবলডেকার সেতু, উপরে সড়কপথ, নীচে রেলপথ। এরপর আবার সেই চেনা পথ ধরে ফিরে আসা নিজের শহরে। প্রতিবার গুয়াহাটি যাওয়ার অন্য আরেকটি মজা রেলপথে তিস্তা নদী পেরোনো। আজ এপর্যন্তই। পরের পর্বে শোনাবো আরও নতুন গল্প।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *