গিরিশ ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা  ✒️ পাপিয়া সাহা

গিরিশ ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা 

পাপিয়া সাহা

পূর্ব প্রকাশিতের পর
অষ্টম পর্ব
ঈশ্বর এই জগতে সর্বত্রই বিরাজমান। তিনি অবিনাশী এবং নিয়ত ক্রিয়াশীল। তার দৃষ্টি সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত। এই জগত একটি নৈতিক ব্যায়ামশালা। এখানে আমাদের সকলকেই আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করার জন্য নৈতিক অভ্যাস অনুশীলন করা উচিত।
সূর্য যেমন সকলের ওপর সমভাবে কিরন দেয় ঈশ্বরের ভালবাসাও তেমন সাধু সজ্জন পাপী তাপী সকলের প্রতিই প্রবাহিত হয়।শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন তার নাম কীর্তন করলে দেহের সব পাপ পালিয়ে যায়।তার নাম কীর্তন যেন হাততালি দেওয়া। হাততালি দিলে যেমন বৃক্ষের ওপর থেকে সব পাখি পালিয়ে যায তেমনি তার নাম গুন কীর্তনে সব পাপ পালিয়ে যায। মহাপাতক, অনেকদিনের পাতক, অজ্ঞান, অচেতন ব্যক্তিও তার কৃপা হলে মুক্তি পায়, আলোর সন্ধান পায়।হাজার বছরের অন্ধকার ঘরের ভিতর যদি হঠাত আলো আসে তাহলে সেই হাজার বছরের অন্ধকারও একটু একটু করে সরে যায়, একেবারে আলোকিত হয় না।আলোতেই অন্ধকার দুর হয়,আলোতেই মুক্তি ঘটে। কি অপূর্ব আশার বানী ঠাকুরের। বিনোদিনী, তারাসুন্দরী ,তিনকড়ি সে সময়ের কলকাতার তিন প্রখ্যাত নায়িকা শ্রীরামকৃষ্ণের এই বানী শ্রবণে মুগ্ধ হয়েছিল এবং ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। গিরিশ চন্দ্র ঘোষের চৈতন্য লীলায় বিনোদিনীর চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় দেখে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে “তোমার চৈতন্য হোক “বলে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। তারাসুন্দরী ও তিনকড়ি ঠাকুর কে চাক্ষুষ দেখেন নি তবে তাদের পরিচালক ও উপদেষ্টা গিরিশ চন্দ্রের কাছে ঠাকুরের কথা শুনেছিল। পরে তারা শ্রী মা সারদা দেবী কে উদ্বোধনে দর্শন করে আশীর্বাদ লাভ করেছিল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও ঠাকুরের অন্যান্য শিষ্যরা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের পথে উদ্বুদ্ধ করেন।
মানুষের জন্ম দৈবের অধীন। কিন্ত তার কর্ম নিজের অধীন। এই তিন নায়িকার জন্ম কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীতে এবং তাদের জীবন ছিল কঠোর দুঃখ, দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতায় ভরা।ডদ্রসমাজ এদের ঘৃনার চোখে দেখত। কিন্ত তাদের অভিনয় প্রতিডা, তাদের আত্মপ্রচেষ্টা ,আন্তরিকতা,ধৈর্য,সহিষ্ণুতা, অনুরাগ ও উচ্চাকাঙ্খা তাদের পৌঁছে দিয়েছিল সিদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায়। প্রকৃতি মানুষের মনের তলদেশে প্রতিভা ও ক্ষমতাকে লুকিয়ে রাখে যা আমাদের অজ্ঞাত থাকে।মানুষের প্যাশান বা আবেগ ঐ প্রতিডাকে একমাত্র প্রকাশ করতে পারে।
কথায় বলে জহুরি জহর চেনে।মহানট ও নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র বিনোদিনী, তারাসুন্দী ও তিনকড়ির মধ্যে সুপ্ত প্রতিডা লক্ষ করেছিলেন। তিনি এই অল্প বয়স্কা মেয়েদের মেয়েদের নিজের মেয়ের মত ভালবেসেছিলেন। গিরিশ চন্দ্র এদের কলুষিত জীবন পথ থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা জাগিয়ে তুলে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকাশ করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী রূপে গড়ে তুলেছিলেন। গিরিশ তার নাটকের নারী চরিত্রগুলোর কল্পনাকে জীবন্ত রূপ দিয়েছিলেন এদের অভিনয়ের মাধ্যমে। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে গিরিশ চন্দ্র এদের মহানায়িকা রূপে সৃষ্টি করেন।এছাড়া এদের আধ্যাত্মিক জীবন গড়ে তুলবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা সারদা দেবী এবং ঠাকুরের শিষ্যদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন। অন্যদিকে এই অভিনেত্রীরা নাটকের চরিত্রগুলোকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলে থিয়েটারের মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। নিজেরা স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হতে শিখেছিল। তাদের অভিনয়ের পারদর্শিতা দ্বারা গিরিশ চন্দ্রের মুখ উজ্জ্বল করে তুলেছিল এবং সমাজের বহু বিশ্রুত সমালোচনা ও নেতিবাচক বিরূপ মন্তব্যের মুখ থেকে গিরিশ চন্দ্রকে মাথা উঁচু রাখতে সহায়তা করেছিল। তাছাড়া সমাজের নিষ্ঠুর নিয়ম কে পদদলিত করে ও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মঞ্চে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে প্রতিভার স্বীকৃতি রেখেছিল ও অগণিত মানুষের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বিনোদিনী,তারাসুন্দী, ও তিনকড়ির মত মেয়েদের সামাজিক পটভূমি সম্পর্কে জানা নিতান্তই জরুরী। নিষিদ্ধ পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেও কিন্ত তারা অর্থের জন্য দেহোপজীবিনী বা বেশ্যা ছিল না। তারা ছিল ধনী ব্যক্তিদের মিস্ট্রেস বা প্রনয়িনী বা রক্ষিতা। সেকালে ধনী ব্যক্তিদের মিস্ট্রেস বা রক্ষিত রাখার প্রথা চালু ছিল। এখন যেমন অবিবাহিত নারী পুরুষ লিভ ইন টুগেদার পদ্ধতিতে গার্ল ফ্রেন্ড বা বয় ফ্রেন্ড হিসেবে একসাথে বাস করে। তখনকার সমাজে এরূপ একত্র বাস নিষিদ্ধ ছিল। সেই সময় তাই সমাজের চোখে তারা ছিল পতিতা ও অস্পৃশ্য। কিন্ত এখন সময়ের সাথে সাথে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী ও বদলেছে। প্রথমে বিনোদিনী সম্পর্কেই সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
বিনোদিনী দাসী
1870 সাল থেকে যখন মেয়েরা বঙ্গরঙ্গমঞ্চে অভিনয় শুরু করল তখন খুব কম মেয়েদের প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। কিন্ত বিনোদিনী তার তীব্র প্রচেষ্টা ,আন্তরিকতা , কঠিন পরিশ্রম ও অধ্যবসায় এবং সর্বোপরি তার ঐশ্বরিক প্রতিভা নিয়েই মঞ্চে আবির্ভূত হল সুপারস্টার হিসেবে। 1863 সালে কোলকাতার 145 কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (এখন বিধান সরণী)এক নিষিদ্ধ পল্লীতে বিনোদিনীর জন্ম হয়। তার কোনও পিতৃপরিচয় ছিল না।কঠোর দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সে তার মা দিদিমা ও একমাত্র ছোট ভাইয়ের সাথে বড় হতে থাকে।কিন্ত অতি অল্প বয়সেই তার ভ্রাতা তাদের চির দুখিনী করিয়া পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।ফলে পরিবারটি দুঃখ দারিদ্র্য ও মৃত্যু যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত হইয়া পরে। অতি অল্প বয়সেই বিনোদিনীর বিবাহ হয়।কিন্ত বিবাহের মর্ম বুঝিতে না বুঝিতেই কিছুদিন পর তার স্বামীর পরিবারবর্গ তাহার স্বামীকে লইয়া গিয়া অন্যত্র বিবাহ দিয়াছিলেন। সহজাত চঞ্চলতা ও জ্ঞানের ক্ষুধা লইয়া বালিকা বিনোদিনী কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের এক অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং লিখতে পড়তে এবং একটু ইংরাজি বলতেও শেখে। নিজেদের সমাজে নারীদের দুর্দশা দেখে সে নিজের ভিতরের শিল্পী সুলভ সত্তার উন্নতির জন্য যত্নশীল হল। মাত্র নয় বছর বয়সে সে সময়ের স্টার থিয়েটারের প্রসিদ্ধ গায়িকা গঙ্গাবাঈজীর সহিত বিনোদিনীর পরিচয় হল। গঙ্গাবাঈ ছিল ভীষণ উদার ও কোমল প্রকৃতির মহিলা। সে বিনোদিনীর সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে সঙ্গীত শিক্ষা দিতে সম্মত হল। কিছুদিন পর বিনোদিনীর দিদিমা বিনোদিনীকে বঙ্গ নাট্যশালার সঙ্গে যুক্ত পূর্ণবাবুর হাতে সুনিশ্চিত ন্যাশনাল থিয়েটারে দশ টাকা মাহিনাতে ভর্তি করিয়া দিলেন। বিনোদিনী পরবর্তি কালে তার আত্মকথায় লিখিয়াছিল-“যেদিন প্রথম জনসাধারণের সম্মুখে পার্ট মুখস্থ করিয়া দাঁড়াইতে হইল তখন উজ্জ্বল আলোকমালা, সহস্র লোকের উৎসাহিত দৃষ্টি তাহাকে সংকুচিত করিয়া দিল। কিন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতর হইতে সকল দ্বিধা,দ্বন্দ্ব, সংশয় মুহুর্তের মধ্যে অন্তর্হিত হইল এবং সাবলীলতা লাভ করিলাম”। তাহার প্রথম অভিনয়ই দর্শকদের হৃদয় জয় করিয়া লইল। সেই অবাধ জয়যাত্রা চলিল পূর্ণগতিতে।
মানুষের জীবন বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত, সংঘাত,উত্থান পতনের মধ্য দিয়াই চলে।বিনোদিনীর জীবনও থিয়েটার জগত, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও অর্থনৈতিক দোদুল্যতার মধ্যে দিয়া আগাইয়া চলিল যা তার থিয়েটার জীবনকেও প্রভাবিত করিয়া তুলিয়াছিল।গোলাপ সিং,গুর্মুখ রায় ও আরও কয়েকজন ধনী ব্যক্তি ব্যক্তি বিনোদিনীকে শর্ত হিসাবে বাংলা থিয়েটারে প্রচুর অর্থ প্রদান করিয়াছিলেন বিনোদিনীর সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও। বাংলা রঙ্গমঞ্চের সার্থে এবং থিয়েটারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বাংলার বিখ্যাত জ্ঞানী গুনী মানে লোকজন এমনকি গিরিশ চন্দ্রের অনুরোধে তাদের সাথে আর্থিক শর্ত সাপেক্ষে থাকিতে রাজি হয়। গিরিশ বাবুর সক্রিয়তায় বিনোদিনী ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগদানের পর থেকেই তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় এবং লোকসমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী রূপে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করে। বিনোদিনী যখন স্টার থিয়েটারে গিরিশ চন্দ্র রচিত চৈতন্য লীলায় চৈতন্যর ভূমিকায় অভিনয় করে তখন তার বয়স মাত্র বিশ বছর। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আসিয়াছিলেন চৈতন্য লীলা দেখিতে।নাটকের শেষে জনৈক ভক্ত ঠাকুরকে জিজ্ঞেসা করিলেন, কেমন দেখিলেন ঠাকুর? ঠাকুর বলিলেন-“আসল নকল এক দেখিলাম”। ঠাকুরের এই কথায় কল্পনা করে ধরে নেওয়া যায বিনোদিনীর রূপান্তর তার বৈরাগীর বেশভূষা, মেক আপ,অভিনয় প্রতিডা ,ভক্তিতে গদগদ কণ্ঠস্বর, কৃষ্ণের জন্য ছলছল আঁখি, দিব্যভাবে মাতোয়ারা চৈতন্য বেশী বিনোদিনী হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ বলিয়া ব্যাকুলতার আর্তি লইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পরিত। এই দৃশ্য দেখিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আহা আহা করিয়া সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। পরবর্তিতে বিনোদিনী আত্মকথায় ব্যাক্ত করিয়াছিল যে আমি এই চৈতন্য লীলায় অভিনয়ের মধ্য দিয়া পতিত পাবন পরম পূজনীয় দেবতা পরমহংস ঠাকুরের পাদপদ্মে আশ্রয় পাইয়াছিলাম। আমি তার দয়া লাভ করিয়াছিলাম। ঠাকুরের আশীর্বাদ প্রাপ্তির পর হইতে বিনোদিনীর মন ঠাকুরের দর্শন লাভ করিবার জন্য সবসময়ই বিচলিত থাকিত।ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ যখন শ্যামপুকুর বাড়িতে অবস্থান করিতেছিলেন তখন ইহা শুনিয়া বিনোদিনী ঠাকুরকে দর্শন করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিল। ঠাকুরের রোগ বৃদ্ধির শঙ্কায় ঠাকুরের প্রধান শিষ্য ও অন্যান্য শিষ্যরা ঠাকুরের অনুরাগী ভক্তদের তাহার সহিত দেখা সাক্ষাত নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্ত বিনোদিনীর আকুলতা দেখিয়া গিরিশ চন্দ্র, কালীপদ বিনোদিনীকে পুরুষের ন্যায় হ্যাট কোটে সজ্জিত করিয়া ঠাকুরের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। রঙ্গপ্রিয় ঠাকুর ইহা বুঝিতে পারিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে লাগিলেন এবং তার শ্রদ্ধা ভক্তি দক্ষতা ও সাহসের প্রশংসা করিলেন। বিনোদিনীও ঠাকুরের শ্রী চরণে মস্তক স্পর্শ করিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে ফিরিয়া আসিল। বিনোদিনীর ব্যক্তিগত জীবনও সুখের ছিল না। এক ধনী ও দয়াশীল ব্যক্তির সাথে একত্রিশ বছর বাস করিয়া বিনোদ একটি কন্যা সন্তান লাভ করিয়াছিল। মেয়েটির নাম ছিল শকুন্তলা। এই মেয়েটি ছিল তার স্নেহ, ভালবাসা ও সান্ত্বনার স্থান। কিন্ত বিধির বিড়ম্বনায় মাত্র তের বছর বয়সে শকুন্তলা চিরজীবনের মত তার স্নেহের আঁচল ছেড়ে তাকে চিরদুখিনী করিয়া ইহলোক ত্যাগ করে। এই দুঃখের ভারকে আরও বৃদ্ধি করিয়া কিছুদিন পর তার ভালোবাসার জীবন সঙ্গী জগৎ সিং ও তাকে ত্যাগ করিয়া পৃথিবী ছাড়িয়া চলিয়া গেল। শোকে বিনোদিনীর হৃদয় বিদীর্ণ হইল এবং নিদারুণ রোগ শয্যায় পতিত হইয়া মরনোন্মুখ হইয়া পরে। বহু অর্থ ব্যায় করিয়া বহু চিকিৎসকের সহায়তায় তার জীবন রক্ষা পাইল। প্রিয়জন বিরহের শোক অন্তরে ধারণ করিয়া জীবনের গতিকে নানা দিকে ও নানাভাবে প্রবাহিত করিয়াছিল। তিনি একটি বালিকাকে নিজের পোষ্য হিসাবে গ্রহণ করিয়া তাকে মানুষ করিয়াছিল। এবং পরবর্তিকালে মেয়েটিকে সৎ পাত্রে সমর্পণ করিয়া চারটি নাতি লাভ করিয়াছিল। অবসর জীবনে বিনোদ অর্গান বাজিয়ে গান গাইত,কখনও থিয়েটার হলে থিয়েটার দেখিতে যাইত। সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা তাকে খুব সম্মান করত। বিনোদিনী ছিল আত্মসম্মানী,দয়ালু,কোমল ও ভালবাসা পূর্ণ। 1896 সালে তাঁর আত্মজীবনীতে তার বাল্যজীবন,,পারিবারিক জীবন, অভিনেত্রী জীবন সম্পর্কে নানা কথা ও কাহিনী লিখিয়াছিল যা নাট্যমন্দির পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হইয়াছিল। “বাসনা”পত্রিকায় একচল্লিশ টি কবিতা লিখে তার মাতার উদ্দেশ্যে এবং 1905 সালে “কণক”ও “নলিনী”নামে আর একটি কবিতার বই তার প্রিয় কন্যা শকুন্তলার উদ্দেশ্যে উপসর্গ করে। তার বাচনভঙ্গী ও ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট সুন্দর ও আকর্ষণীয়।
বিনোদিনী সংসার জীবনের অসারতা ও অস্থিরতা উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর তার ভগ্ন হৃদয়ে শান্তির প্রলেপ দিয়াছিলেন। তারাসুন্দরীর কন্যা প্রতিভা বলিয়াছিলেন-জীবনের শেষ দিকে সে তিন তলায় একটি বড় ঠাকুর ঘর নির্মাণ করিয়া রাধাকৃষ্ণ মূর্তি, গোপাল ও শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত করিয়া পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবনে আত্মোৎসর্গ করিয়াছিল। একজন পুরোহিত তার ঠাকুর ঘরে নিত্য পূজা পাঠ করিবার জন্য নিযুক্ত ছিল। এখন ছাড়া তার নিজস্ব পূজা গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণের পট স্থাপন করিয়া নিজের হাতে পূজা আহ্ণিক ও গীতাপাঠ করিত। বিনোদিনী ছিল দয়ালু পরপোকারী ও ধর্মপরায়ণা। তার গৃহের নাম রাখিয়াছিল গোপাল কূটির। তার শেষ জীবন ছিল সম্পূর্ণ ঈশ্বরে নিবেদিত। ঠাকুরের অন্তরঙ্গ শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞানন্দ নিজ মুখে বলিয়াছিলেন যে বিনোদিনী ঠাকুরের পটে সামনে হাঁপুস নয়নে কাঁদিত। বিনোদিনী তার বাড়ির সন্নিকটে শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে নিত্য যাতায়াত করিত। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের শিষ্য স্বামী অভেদানন্দের সাথে দেখা করে নিত্য সন্ধ্যা আরতি দেখত। 1941 সালের 12 ই ফেব্রুয়ারি গিরিশ চন্দ্রের মানস কন্যা স্বরূপা বহু বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারিনী নটী বিনোদিনী চিরদিনের মত জাগতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিল। নিষিদ্ধ গণিকা পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেও এই সাধারণ নারী তার স্বীয় প্রতিভা,আভ্যন্তরীণ অনুসন্ধিৎসা,অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর অনুশিলনী,বিনয়ী ও নম্র স্বভাব, আত্মসচেতনতা, ও ব্যক্তিত্বের দ্বারা বাংলার বিখ্যাত প্রোথিতযশা সংস্কৃতিবান পণ্ডিত মানুষের সংস্রব থেকে অবতার পুরুষ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের চরণাশ্রয় লাভ করে এক কিংবদন্তী জনপ্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *