কবি ও কবিতা — প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা ড: হিমাদ্রি সাহা

কবি ও কবিতা — প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা

ড: হিমাদ্রি সাহা

ইদানীং একটা কথার খুব চল হয়েছে যা আমায় খুব পীড়া দেয় তা হলো আমরা সবাই নাকি কবি। আমরা সবাই সবাইকে কবি পরিচয় দিয়ে থাকি। আসলে আমরা একটা ছাতার তলায় থেকে সংঘবদ্ধ থাকতে চাই। ফেসবুক এই প্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা ভেবে নিয়েছি যে কবির একটি বিশেষ সন্মান আছে বা একটি সামাজিক জোর আছে। তাই কবি বললে নিজের মধ্যে একটি প্রতাপ উদ্রেক হয়।

আমার এই লেখার অবতারণা এই হেতু যে আমরা যা লিখছি তা কি সত্যিই কবিতা হয়ে উঠছে। এইটা নির্ধারণ করতে গেলে বুঝতে হবে কবিতা কি। কবিতা কি — এই বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার একটি বিবর্তন হয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন ছন্দবদ্ধ সুললিত শব্দই কেবল কবিতার যোগ্য ছিল। এইসব শব্দরা “কাব্যিক” বলে পরিগণিত হতো।‌ প্রণম্য রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এইরূপ কাব্যিক শব্দের ধারনা প্রাধান্য পেয়েছে। অন্য দিকে সমকালীন ভাষা অনেক স্থূল যা কাব্যিক স্তরে উন্নীত হতে পারে না এইরকম একটা ধারনা বদ্ধমূল ছিল। কবিতায় সেইসব শব্দের স্থান নিষেধ। ইংরেজ কবি Thomas Gray বলছেন : ” The language of the age is never the language of poetry”.

আবার উল্টোদিকে কবিতায় এইসব কাব্যিক পোশাকি শব্দ ব্যবহারের পরিপন্থী ছিলেন William Wordsworth। উনি জোর দিয়েছিলেন যে সেই শব্দই কবিতায় আসবে যা উৎসারিত হবে ” real language of men” থেকে। এই কথ্য ভাষা যা দেখতে বা শুনতে অনেকটা স্থূল।

এই দুই ধারণার মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে কবি সমাজ। তবে এই দুই পন্থার কবিরাই অল্পবিস্তর হয়তো উগ্রপন্থায় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছিলেন।

তাই কবিতায় উত্তীর্ণ হতে হলে একটি লেখার কি বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত সেই নিয়ে একটা মীমাংসা সূত্র পাওয়া যায় Sir Walter Raleighর কথায়। তিনি বললেন যে কবিতায় শব্দকে তো অবশ্যই প্রাধান্য যেমন পেতে হবে ততধিক গুরুত্ব দিতে হবে শব্দ- বিন্যাসের ওপর। শব্দের একটি আক্ষরিক অর্থ থাকে যা অনেকটা নিশ্চল। অনেকগুলো শব্দ একটি বিন্যাসে লেখা হলে প্রতিটি শব্দ একত্র হয়ে সেই গঠন শৈলীর মধ্যে একটি সচলতা আসে যা হলো কবিতার রস বা ভাব। এই বিন্যাস শব্দকে তার আক্ষরিক অর্থের কারাগার থেকে মুক্ত করে তার মধ্যে এক ভাবের প্রাণ সঞ্চার করে। তাই যে শব্দই কবিতায় ব্যবহার হোক না কেন – সুললিত কাব্যিক বা কথ্য — শব্দসমূহ যেন মুক্ত হয়ে বিচরণ ক’রে একটি অন্তর্নিহিত ভাবের সৃষ্টি করে এবং কবিতা তার পাঠককে একটি নিবিড় ভাবনায় নিয়ে গিয়ে ফেলে যার ফলে কবিতা নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলে গদ্য থেকে। গদ্য পাঠককে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভাবের জগতে বিচরণের অবকাশ দেয় না।

তাই ইদানীং অধিকাংশ লেখা যাদেরকে আমরা জোর গলায় কবিতা বলে ঘোষণা করছি, ভাবতে হবে সেইসব লেখায় শব্দরা একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে লেখা হওয়ার পর একটি ভাব সঞ্চার করতে পারছে কিনা বা বলা যায় কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ সমূহ কি একটি synergistic অর্থ প্রদান করতে সক্ষম হচ্ছে। নাকি নিছক শব্দ সমূহ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে কেবল তাদের আক্ষরিক অর্থ নিয়ে। তখন সেইসব লেখা কবিতা রূপে গণ্য হতে নিদারুণ ব্যর্থ হয়। আমাদের লেখা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই শেষ পর্যায়ে পড়ে। তাই “কবি “ও “কবিতা” — এই দুটি শব্দ সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। বরং বলা যেতে পারে যে আমরা কবিতা লেখার পথে ক্রমাগত হেঁটে চলেছি। আশা রাখি, একদিন আমাদের লেখা কবিতা রূপে উত্তীর্ণ হবে এবং সময় তখন আমাদের ” কবি”র মর্যাদা দেবে। ততদিন আমরা এই দুটি শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারে একটু সংযত হবো। এইটুকু সততা তো আমরা নিজেদের কাছে আশা করতেই পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *