ছোট বউমা — ছোট গল্প কলমে —- দীপিকা ভট্টাচার্য সান্যাল

ছোট বউমা — ছোট গল্প
কলমে —- দীপিকা ভট্টাচার্য সান্যাল

চলুন মা , ড্রাইভার এসে গেছে। আপনার ছেলেকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে ও আপনাকে দাদার বাড়ি পৌঁছে দেবে। আর ফেরার সময়? শাশুড়ি প্রশ্ন করলেন। সুনীল তো আপনার সঙ্গেই থাকবে। আপনার ছেলে অফিস থেকে বাসে বাড়ি ফিরবে। আপনি সারাদিন গাড়িটা রেখে দেবেন। ইচ্ছে করলে দুপুর বেলা খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম করে দাদার বাড়ি থেকে দিদির বাড়িতে ও ঘুরে আসতে পারেন শিখা উত্তর দিল । তা ঠিক বলেছো ছোটো বউমা। পরশু মনা ফোন করে বলল, মা, ছোড়দাকে বোলোনা গো তোমাকে নিয়ে একদিন আসতে। আমি বললাম , ও তো ফেরে অনেক রাত করে। অফিসে এখন খুব চাপ চলছে বলছিল। তুই একদিন আয় না । কতো দিনতো আসিস নি । তা বলল , সামনে ছেলে মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা মা। আমি এখন গেলে তোমার জামাই অশান্তি করবে। জানো তো তার মেজাজ।
সেইজন্যই তো বলছি মা, আপনি একবার ওখানে ও ঘুরে আসতে পারেন। যদি অবশ্য দাদা বা দিদিভাই রাজি হন। সেটা হয়তো তুমি ঠিক বলেছো বউমা, ওরা হয়তো ছাড়বে না। শিখা উত্তর দিল , ওঁরা না চাইলে যাবেন কেন? তাই তো বললাম, যদি সম্ভব হয় ! বলে শিখা রান্না ঘরে শাশুড়ির এক বোতল জল আর গুছিয়ে রাখা পানের ডিবে আনতে ঢুকল। শাশুড়ি দরজা অবধি গিয়ে ফিরে এসে বললেন, বউমা মিষ্টির বাক্স আর দাদু ভাই দিদি ভাইয়ের চকলেট খেলনা গুলো দিলেনা তো? কথাটা বলার ভঙ্গি তে একটু বিরক্ত হয়েও শিখা হেসে বলল, মা, আপনি ভাবলেন কী করে আমি যেগুলো কাল নিজে কিনে আনলাম ওদের জন্য সেগুলো দেবো না, রেখে দেবো ? আপনি কী ওসব নিয়ে গাড়িতে উঠতে পারবেন? আপনার ছেলের হাতে আগেই সেগুলো দিয়ে দিয়েছি। সে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। এই নিন পানের ডিবে। দশটা পান সেজে দিয়েছি হবে তো? আসুন সাবধানে। আমি জলের বোতল গাড়িতে তুলে দিচ্ছি। এগিয়ে যায় শিখা।
তার এখন অনেক কাজ। সকাল থেকে ফুরসত পায়নি একটু যে দম নেবে । ঘরের সব কাজ বাকি। মিনা এখনই ঘর ঝাঁট পোঁছ করতে চলে আসবে। ঘর দোর ঝারা সাবান ভিজানো নিজের টিফিন করা সব বাকি আছে। স্বামীর রান্না অফিসের টিফিন, শাশুড়ির টিফিন এসব করতেই এতোক্ষণ সময় পার হয়ে গেল। একটু যে বসে টিফিন চা টা মুখে দেবে তার ও সময় হয়নি। এদিকে মেয়ের ছুটির সময় হয়ে আসছে। সে এসে পড়লে তো আর কিছুই করা যাবেনা। তার পিছনে সময় যাবে। যেমন মা তেমন ছেলে। কোনো সাহায্য তো করবেই না, আবার পান থেকে চুন খসলেই টিপ্পনি। সোজাসুজি নয়, ঘুরিয়ে নাক দেখানো। সবই কপাল।
বিয়ের আগে মেয়ে দেখতে এসে শাশুড়ির কতো নাটক, বেয়ান, আপনি চিন্তা করবেন না। ও আমার আর একটি মেয়ে। আদরেই থাকবে। আপনার একটা মেয়ে , যেমন যত্নে রেখেছেন তেমন যত্নেই রাখব। আরে বাবা, আমিও তো মা না কী? আমার নিজের ও তো একটা মেয়ে আছে। তাছাড়া বড়ো বউমা আছে। আপনি আর চিন্তা করবেন না। মেয়েদের শ্বশুর বাড়িই তো আসল বাড়ি। এবার বিয়ের যোগাড় শুরু করুন। মা কথাটা বিশ্বাস করে আল্হাদিত হয়ে ওমনি বলল, নারে শিখা, মনে হচ্ছে এঁরা মানুষ ভালো। তোর বাবা ঠিকই বলছেন। আর এখন? সে নাটকের শেষ পর্ব।
যাবার আগে একবার মুখে এলোনা তো, বউমা , আমি তো চলে যাচ্ছি তোমার খাওয়াও হলনা। আগে টিফিন চা টা খাও। তারপর বাকি কাজ কোরো। এরই নাম যত্নে রাখা । গেটের দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে দেখল, খবরের কাগজ টা খোলা পড়ে আছে খাটের ওপর। কাগজটা পড়ে ভাঁজ ও করা হয়নি। একজন চাকর তো আছে বাড়িতে সব খিদমৎ খাটার জন্য। শিখা যেনো নিজেকেই বলল। দূর, আর ভালো লাগছেনা আগে একটু চা খাই । ভাবতে ভাবতে চায়ের কেটলিতে জল নিয়ে গ্যাস জ্বালালো। চা করতে করতেই কলিঙ বেল বেজে উঠল। বুঝল, মীনা এসে গেছে। রান্না ঘর থেকে শিখা সাড়া দিল, দাঁড়া আসছি।
দরজা খুলতেই মীনা ঢুকল ঝড়ের গতিতে । ঘরে ঢুকে শাশুড়িকে না দেখতে পেয়ে মীনা জিজ্ঞাসা করল, মাসীমা নেই দেখছি যে বউদি , বড় দাদার বাড়ি গেছে? কবে ফিরবে? ও মা , তোমার তো এখোনো টিফিন চা ও খাওয়া হয়নি । তুমি খেয়ে নাও বউদি। আমি ততক্ষণ ঘর ঝাঁট দিই। আজ একটু তাড়া আছে গো। যাবার সময় বাজারে যাব ঘরে কিছু নেই। রাতে রান্না করতে পারবনা। শিখা চায়ের কাপে চিনি নাড়াতে নাড়াতে বলল , নারে, তুই ও টিফিন চা টা খেয়ে নে । তারপর বাসন মেজে নে আগে। আমার এখোনো ঘর দোর ঝাড়া পোঁছা হয়নি রে। হাতটা ধুয়ে তোর কাপটা থালাটা নিয়ে বস, আমি তোকে খাবার দিয়ে তারপর খাব।
মীনাকে চা দিয়ে শিখা টেবিলে বসে চা খেতে খেতে ঘড়ির দিকে তাকালো। সারে এগারোটা বাজে। মেয়ে আসবে এখনো দু ঘন্টা পর। এর মধ্যে সব কিছু কাজ সেরে নিতে হবে। যদিও মেয়ে স্কুল বাসে ফেরে কিন্তু মোড়ের মাথায় গিয়ে আনতে হয়। তখনই পাড়ার দোকান থেকে টুক টাক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে। মাঝে মাঝে মেয়ের আবদারের জন্য কিছু খেলনা বা অন্য কিছু আনতে হয়। মীনা টিফিন চা কোনো রকমে খেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। শিখা হাতের বাকি কাজ গুলো খুব তাড়াতাড়ি সেরে নিল। মীনার কাজ শেষ হতেই এবার নিজে তৈরি হয়ে আস্তেু আস্তে রাস্তায় পা রাখলো মেয়েকে আনতে।
সময় কারো জন্য বসে থাকেনা। এগিয়ে চলে নিয়ত। স্নেহা বাস থেকে নেমে মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে মায়ের হাত ধরল। ওয়াটার বটলটা মায়ের হাতে দিয়ে সারাদিনের জমানো গল্প করতে করতে বাড়িতে ফিরে এল। তার পর হাত মুখ ধুয়ে ড্রেস পাল্টে মায়ের হাতে তৈরি দৈয়ের সরবত খেয়ে একটু বিশ্রাম করে স্নান করে নিল। ততোক্ষণে শিখা দুজনের ভাত ডাল সব্জি মাছ থালায় সাজিয়ে টেবিলে গুছিয়ে রাখল। মায়ের সঙ্গে খেতে বসে স্নেহা স্কুলের সব গল্প শিখাকে শোনায় কে কি করেছে মিস কাকে কি বলেছেন সব। এরপর দুজনের খাওয়া দাওয়া এবং একটু দুপুর নিদ্রা। ঘুম থেকে উঠেই এক গ্লাস দুধ খেয়ে একটু পরেই স্নেহা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেল। ওরা কয়জনে মিলে বাড়ির সামনে রাস্তাতেই খেলতে যায়। শিখা এখন কিছু সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত। গা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে একটু সাজ গোজ করে অপেক্ষা করছে তার স্বামীর অফিস থেকে ফিরে আসার সময়টুকুর জন্য। একসঙ্গে বসে চা খাবে। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে ঘড়িতে তাকালো। সাতটা বেজে গেছে।
মেয়ে পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ালো। শিখা দরজা খুলে দেখল শাশুড়ি ফিরেছেন। তাঁর হাতে একটা কাপড়ের প্যাকেট। তিনি ঘরে ঢুকেই শিখাকে নানান ভাবে বড় বউমার সুখ্যাতি করতে লাগলেন প্রশংসায় পঞ্চ মুখ হয়ে। তারপর বললেন জানো ছোটো বউমা, বড়বৌমা নিজেই বল্ল, মা চলুন আপনাকে দিদির বাড়ি নিয়ে যায়। অনেকদিন তো আমার ও দিদির কাছে যাওয়া হয়না আজ চলুন আপনার সঙ্গে যায়। শিখা বলল, ভালোই তো হয়েছে দিদির সঙ্গে ও দেখা হয়ে গেলো। যায় হোক কাপড়টা ছেড়ে গা ধুয়ে আসুন আমি চা করছি বসে খেতে খেতে সব গল্প করবেন। এবার শাশুড়ি প্যাকেট টা খুলে একটা শাড়ি বের করে বললেন, দেখো ছোটো বউমা, বড় বৌমা আমাকে কত যত্ন করল আবার কি সুন্দর একটা কত দামী শাড়ি দিয়েছে।
এবার শিখার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। ও বেশ জোড়ের সঙ্গেই বলল, হ্যাঁ মা, আপনি সারাজীবন আমার সঙ্গে থাকলেন, আপনার সব দায়িত্ব আমি পালন করলাম, ডাক্তার বদ্যি সব করি, এই সেদিন চোখ অপারেশন ও করিয়ে আনলাম। আপনাদের সুখের জন্য আমার ওকালতির প্র্যাকটিস ও ছাড়তে বাধ্য হলাম। তাতে আপনার মন পেলাম না। আর দিদিভাইয়ের কাছে একদিন গেলেন যত্ন পেলেন একটা শাড়ি পেলেন একবার দিদির বাড়িতে ঘুরিয়ে দিল, তাতে আপনার বড় বউমা এতো ভালো হয়ে গেলো যে আপনি তার প্রশংসা করেই চলেছেন থামতে পারছেন না। আমি যদি আমার মাথাটা কেটে আপনার পাতে তুলে দিই, তবুও আপনি সন্তুষ্ট হবেন না। তখন আপনি বলবেন, বউমা, সবই তো দিলে ভালো , তবে মাথার সঙ্গে আর একটু বেশি মাংস রাখতে পারলে না মা ?
শিখার কথা শুনে শাশুড়ি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *