“শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের বোহেমিয়ান ভক্ত গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা ” পাপিয়া সাহা
“শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের বোহেমিয়ান ভক্ত গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা “
পাপিয়া সাহা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ষষ্ঠ পর্ব
গিরিশ চন্দ্র তার পরিনত সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনার দ্বারা পতিত অবহেলিত মানুষদের জন্য নতুন দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। অন্ধকার জগতের মেয়েদের জন্য নতুন দিশার সন্ধান দিয়েছিলেন যাতে অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তারা তাদের জীবন যাত্রার পরিবর্তন আনতে পারে।অভিনয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে বহু হতভাগ্যের জীবন রক্ষা করেছিলেন। শুধু তাই নয় দু তিন জন অভিনেত্রীকে তিনিই জনসমক্ষে পেশ করেছিলেন যারা এককালে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাপের জীবনে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি সাধারণ কথায় সমগ্র স্ত্রী জাতির জীবনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটানো মেয়েরা পাপের অতল গহ্বরে তলিয়ে না গিয়ে বাংলা মঞ্চের আশীর্বাদ উদ্ধার পায় ও বাংলা নাট্যমঞ্চকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তিনি চাইতেন যেন আমরা আরতির সময় মঠে আসি এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি।আমরা খুব ভয়ে ভয়ে সংকুচিত থাকতাম যদি আমাদের মত কলুষিত মেয়েদের স্পর্শে ঐ পবিত্র ভূমি কলুষিত হয়ে যায়। কিন্ত গিরিশ বলতেন:শ্রীরামকৃষ্ণ থাকলে তিনি নিজেই তোমাদের ও আমাকে শিক্ষা দিতেন। তিনি আমাদের মত পতিতদের উদ্ধারের জন্যই কি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন নি?
গিরিশ চন্দ্র তার উশৃঙ্খল সঙ্গী সাথীদের পরিত্যাগ করার চাইতে তাদের আধ্যাত্মিক হিত সাধনেরই পক্ষপাতি ছিলেন বেশি। আত্মিক অর্থাৎ আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম পরে তিনি অতীতকে কখনও অস্বীকার করেন নি।পরিবর্তে সকল পতিত দলিত সাধারণ নিরক্ষর অবচেতন মানুষের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারা বিকিরণ করেছিলেন। গুরুকে দেওয়া আম মোক্তারনামা গিরিশ কখনও লঙ্ঘন করেননি। স্বামী তুরীয়ানন্দ এবং অন্যরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে “আমাদের মধ্যে গিরিশ ই ছিলেন সবচেয়ে ধার্মিক। তিনি অন্তর্যামীর নির্দেশ অনযায়ীই তার নিজের জীবন যাপন করেছিলেন।
গিরিশ চন্দ্রের জীবনের গভীর শোক ও আবেগ মঞ্চে তাকে মানবীয় আবেগের নিখুঁত স্ফূরনে সাহায্য করেছে।বারবার দুঃখ শোক এসে বিদীর্ণ করেছে তার হৃদয়।কবিতা,গান রচনা ও শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য তাকে শান্তি ও আনন্দ দিয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্য আরো দৃঢতর হয়েছে।গিরিশ চন্দ্র নিজের মুখে বলেছেন-ঈশ্বরের কৃপায় আমি সংসারের ঘৃণ্য বেশ্যা ও লম্পট চরিত্র হইতে জগৎ পূজ্য অবতার চরিত্র পর্যন্ত দর্শন করিয়াছি। সংসার বৃহৎ রঙ্গালয়। নাট্যরঙ্গালয় তাহারই ক্ষুদ্র অনুকৃতি।
1904 সালে ক্লাসিক থিয়েটারে যুক্ত থাকার সময় গিরিশ চন্দ্রের আর একটি হতাশা ব্যাঞ্জক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মুঘল সম্রাট আওরংজেব হিন্দুদের ওপর অন্যায্য কর চাপিয়ে তাদের ওপর জুলুমবাজি করেছিলেন। বলপূর্বক হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছিল। এতে হিন্দুরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। রাজপুত কন্যা বৈষ্ণবী মুসলিমদের হাতে পিতাকে নিহত হতে দেখেছিলেন।প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি “সৎনাম” নামে সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে একটা দল গড়ে তুলেছিলেন। সৎনাম হল তাদের দেবতাদের নাম। বৈষ্ণবী কে হিন্দুদের “জোয়ান অব আর্ক ” আখ্যা দেওয়া হয়। সে এবং তার সৈন্যরা বহুবার মুঘল সেনাদের ঝঞ্ঝাটে ফেলেছিল এবং পরাজিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত বৈষ্ণবী ও তার সেনাদল আওরংজেবের কাছে পরাজিত হয়েছিল। 1904 সালে 30 শে এপ্রিল “সৎনাম” এর বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্রথম প্রযোজিত হয়। এর মূল বিষয় বস্তু ছিল হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ।
1856 সালে আইনসম্মত বিধবা বিবাহ নিয়ে 1908 সালে একটা বিতর্ক তৈরি হয়।গিরিশ চন্দ্রের বিধবা বিবাহের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। “শাস্তি কি শান্তি” নামক নাটকে সামাজিক রীতিনীতির পক্ষে ও বিপক্ষে সমস্ত যুক্তি তর্কের অবতারনা করে গিরিশ চন্দ্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভাবটা চাপিয়ে দেন দর্শক অর্থাৎ আমজনতার উপর।
কলকাতায় থাকাকালীন প্রত্যেক শীতে গিরিশ হাঁপানিতে ভুগতেন। ঐ সময়টা চিকিৎসকদের পরামর্শে গিরিশ বারানসীর সিগরায় রামপ্রসাদ চৌধুরীর বাগানবাড়িতে কাটাতেন।তিনি এক সময় হোমিওপ্যাথি পড়েছিলেন। কলকাতায় বহু মানুষের চিকিৎসাও করতেন। মধ্যাহ্ণ ভোজনের পর তিনি একটু বিশ্রাম নিতেন। সন্ধ্যাবেলা রামকৃষ্ণ সংঘের অনেক সন্যাসী, চিকিৎসক, আইনজীবী, অভিনেতা,সঙ্গীত শিল্পী এবং আরো বিশিষ্ট মানুষ তার সঙ্গে ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, সঙ্গীত এবং অভিনয়ের সর্বব্যাপী আলোচনা করতেন এবং তার জ্ঞান ভাণ্ডারের বিস্তৃতি দেখে চমৎকৃত হতেন।
একজন প্রতিভাবানের পক্ষে সীমিত ধ্যান ধারণার গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। তাই গিরিশ চন্দ্র সর্বদাই তার নাটকের জন্য নূতন বিষয়বস্তু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। সামাজিক, ধর্মীয়, পুরান এবং ঐতিহাসিক নাটক ছাড়াও অষ্টম শতাব্দীর প্রখ্যাত দার্শনিক শঙ্করাচার্যের জীবনের ওপর আলোকপাত করেন।স্বামী ব্রহ্মানন্দের উৎসাহকে তিনি গুরুর আদেশ মনে করে ঐ কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। 1910 সালের15 ই জানুয়ারির মিনার্ভা তে “শঙ্করাচার্য ” অভিনীত হয় ও সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছায়।
লোকে বলে নাস্তিকরাই ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখে। কারন ঈশ্বর বিশ্বাসীদের তুলনায় তারাই ভগবান কে বেশি বার স্মরণ করে। খাঁটি নাস্তিকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনা। একরকম নেতিবাচক ভাবে তারা ঈশ্বর চিন্তা করে। নেপোলিয়ন বলেছিলেন-শুধুমাত্র ইচ্ছার বলে কেউ ঈশ্বর বিদ্বেষী হতে পারে না। ফ্রান্সিস বেতন বলেছিলেন–হৃদয়ের চেয়ে ওষ্ঠেই বরং নাস্তিকতার অবস্থান। এই কথাগুলো গিরিশের জীবনে অত্যন্ত সত্য। তার উগ্র অহংকার বোধ, প্রবল কর্মশক্তি ও অসম্ভব প্রতিভা তাকে ঈশ্বর উপেক্ষার স্পর্ধা জোগায়, পরমের অস্তিত্বে সন্দেহ জাগায, স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে ঈশ্বর ভক্তদের উপহাসাস্পদ করে তোলে। নাস্তিকের ভূমিকায় তাকে ঈশ্বর চিন্তা করতে বাধ্য করত।