শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী —- রত্না রায়

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী

রত্না রায়

পলিথিনটা সরিয়ে শিউলি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো।
আহা,আজ একেবারে ঝিঙাফুল রোদ উঠেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমেদাবাদের দিনগুলোর জন্য মনটা একেবারে হু হু করে ওঠে শিউলির। নীল আকাশটাতে পেঁজা পেঁজা তুলোয় ছেয়ে আছে।

চার বছর আগে লোকেলোকারণ্য এই উঠোনে দাঁড়িয়েই খবর এসেছিল বড় ভাসুর কার্তিক মণ্ডলকে পিরখালি জঙ্গলে দক্ষিণরায় টেনে নিয়ে গেছে। কিছু রক্তমাখা জামাকাপড় আর তালগোল পাকানো আধখাওয়া শরীরটা আর বাড়ি নিয়ে আসার কথা মুখে আনেনি কেউ।
সেদিন ঘরের মানুষটা একেবারে ক্ষেপে উঠেছিলো। ছোটবেলার স্যাঙাত হারানকে ধরিকরি করে বউ শিউলি, ছেলে সুরেন আর মেয়ে অতসীর হাত ধরে গাগরখালির গাঁ ছেড়ে সোজা আমেদাবাদে সুতাকলে। যাবার বেলায় বুড়ি শাউরিরটার কি আছাড়ি বিছাড়ি কান্না। কিন্তু মানুষটা কারুর কথা কানে তোলেনি।
তার তখন এককথা, “ও দক্ষিণরায় তার বাপকে নিয়েছে, দাদাটাকেও টেনে নেলো। এবারে তার দিকে নজর। এখানে থাকলে তার‌ও রেহাই নেই। এবার তার পালা। এখানে সে কিছুতেই থাকবে না আর।”

ভাল‌ই ছিল সেখানে। ছেলে মেয়ে দুটোকেও স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। ফি বছর যখন জমাট বাঁধা মেঘখানা সরে গিয়ে নীল আকাশে সজনে ফুলের মতো মেঘেরা ঘরের ডাক দিয়ে যেতো। মনটাও কেমন উচাটন করে উঠতো গাঁয়ে ফেরার জন্য। দেওয়ালীর বোনাসের জন্য অপেক্ষা না করেই সবার জন্য পুজোর নতুন জামা-কাপড় কিনতো লোকটা। ছেলেমেয়ের হাত ধরে একেবারে জগদ্ধাত্রী সেজে বাড়ি ফিরতো শিউলি। পুরনো ছবিটা মনে পড়তেই হঠাৎই ইছামতীর ঢেউ ভাঙে শিউলির চোখে।

সব কেমন গতজন্মের স্বপ্ন হয়ে গেছে। অথচ পেছন ফিরে চাইলেই মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। গাঁয়ের আলপথ দিয়ে আসতে আসতে হাসিহাসি মনটা শিশিরছোঁয়া বাতাসে হাসনুহানার আকুল করা গন্ধ প্রাণভরে শুষে নিতো। হিম সাদা কাশের ঝোপের একমুঠো খুশিরঙ আনন্দে নেচে উঠতো। জাফরনীআকাশ‌ও যেন তার ছিঁচকাদুনী কান্না ভুলে দেবীমায়ের আসার সুখে শরতের সোনাঝরা রোদ্দুর মেখে থাকতো।

কেমন পাল্টে গেল সব, অনামুখো রোগের জ্বালায় আধেক পৃথিবী উজাড় হয়ে গেল। মালিক‌ও মিলটা এই সুযোগে দিলো বন্ধ করে। ভয়, আতঙ্কে সব কেমন সিঁটিয়ে দরজা আটকে বন্দী করে নিলো নিজেকে। অতসীর ভীতু বাপটাও আর অচেনা জায়গায় তিস্টোতে চাইলো না। ছটফটিয়ে বলে উঠেছিল,
“জিনিসপত্তর গুছিয়ে নে শিউলি। এখানে আর একদন্ড নয়। মরি যদি দেশে গিয়ে চেনা ঘরদোরেই মরবো। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বেমক্কা মরবো না।”

টাকাপয়সা গুছিয়ে, খানিকটা হেঁটে খানিকটা ট্রেণে করে অনেককষ্টে শিউলিরা পরিযায়ী হয়ে ফিরে এসেছিল বাপ ঠাকুরদার ভিটেতে।

গণেশের ইচ্ছে ছিল জমানো পুঁজি দিয়ে একটা ছোট মুদির দোকান করবে। কিন্তু জন্মের সময়েই ওপরে বসে বিধাতাপুরুষ সব হিসেব করে লিখে রাখে। তার এককণাও এদিক ওদিক হ‌ওয়ার যোটি নেই‌ কারুর। আচমকা এক কালামুখী ঝড় এসে সবকিছু লুটে নিয়ে একেবারে সর্বস্রান্ত করে দিয়ে চলে গেল ওদের। অনিচ্ছুক মানুষটাকে বাধ্য হয়ে আবার সেই বাপ দাদার পেশাতেই লাগতে হয়েছে। খেয়েপরে তো বাঁচতে হবে।
আজ শেষরাতে উঠে কোনরকমে দুটো পান্তো খেয়ে ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কাঁকড়া ধরার ট্রলারে বিদ্যেধরীতে ভাসবে বলে র‌ওনা দিয়েছে।
সব‌ই বোধহয় বুড়িটার চোখের জলের অভিশাপ।
হঠাৎ এক অজানা আশঙ্কায় শরীরটা শিউরে ওঠে শিউলির। কপালে দুহাত ঠেকিয়ে নেয়,
“হে মা বনবিবি,এই আবাগীর সিঁথির সিঁদুর
রক্ষা করো মা। সুস্থ মানুষটাকে ফিরেয়ে দিও আমার কাছে। ছেলেমেয়েগুলোকে অনাথ করে দিও না মা। তোমায় বুক চিরে রক্ত দেবো মা আমি।”

“ব‌উ ভাত দিবি না!” শাউড়ির ডাকে সম্বিত ফেরে শিউলির।
চারদিকে জল থৈ থৈ। ইঁট দিয়ে উঁচু করা চৌকি। তার ওপরেই কাঁড়ি করা জিনিস। তার পাশেই ইঁট দিয়েই উঁচু করে রান্নার জোগাড়। কি আর রান্না, একটু ফ্যানাভাত আর আলুসেদ্ধ। তাও সরকারিবাবুদের দয়া।

যাওয়ার আগে মানুষটা ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের দিকে আকুলপানা চোখে চেয়ে ওর হাতদুখানা ধরে বলে উঠেছিল , “ব‌উ আমি ঘরকে না আসা পর্যন্ত সবদিকে সামলে রাখতে পারবি তো তুই? আমার অতসী,সুরেন আর বুড়িমাটাকে তোর ভরসায় রেখে যাচ্ছি কিন্তু আমি।”

বাদাবনে দক্ষিণারায়ের এলাকায় ঢুকবে। মানুষটার অহেতুক চিন্তা আর বাড়াতে চায়নি শিউলি।
মাথা নেড়ে বলে উঠেছিল, ” হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও তো তুমি। রিলিফের চালেডালে হেসেখেলে সাতদিন এখনও চলে যাবেখনে। আর একটু টেনেটুনে চালালে দিন পনেরো। তুমি যেমনটি রেখে যাচ্ছো, এসে দেখবে ঠিক তেমনটিই আছে। তোমার শিউলিকে একটু ভরসা করো দিকিনি।”

ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে মানুষটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বলে উঠেছিল, “আমি জানি তো তুই আমার লক্ষীমন্ত ব‌উ।”

এদিকে চাল যা আছে তাতে টেনেটুনে আর দু’দিন চলবে। তিনটে পেট হাঁ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে।
একবার যাবে নাকি ওপাড়ায় বকুলফুলের বাড়ি।
আড়াইবছর আগে বকুলফুলের ঘরের মানুষটাও জঙ্গলে মধু আনতে গিয়ে আর ফেরেনি। অতসীর বয়সীই ওর‌ও একখান মেয়ে আছে। গতবছর‌ও শিউলি যখন পুজোতে এসেছিলো গাঁয়ে। বকুলফুলের বাড়ি গিয়ে দেখা করে জামা-কাপড় টাকাপয়সা দিয়ে এসেছিল চুপিচুপি ওর হাতে। তখনি শুনেছিল বকুলফুল বাগদার মীন ধরে ইছেমতীর জলে। সংসারের যে নৌকাটা বালির চড়ায় আটকে গিয়েছিল ওর ,সেটা আবার সচল হয়েছে। শিউলির জন্যেও কিছু কাজের জোগাড় নিশ্চয়ই ও করে দিতে পারবে। বকুলফুলের কাছে শিউলির কোনো লুকোছাপা নেই।

শাড়িটাকে একটু ঝেড়েঝুড়ে পরে নেয় শিউলি। বদলে নিলেই ভালো হতো। কিন্তু দুখানা মোটে শাড়ি। বাকি সব ভেসে গেছে। একপিঠ চুলে কতদিন তেল ,সাবান, চিরুণী কিচ্ছু পরে না। তাও জলহাত দিয়ে চুলটা একটু থাবড়ে থুবড়ে নিয়ে কোনরকমে একটা হাত খোঁপা বেঁধে নেয় । দেশ গাঁয়ের বাইরে কয়েকবছর থেকে এখানকার মতো আলোঝলো হয়ে থাকতে পারে না আর। একটু পয় পরিস্কার তো থাকতেই হয়। শাড়ির আঁচলটাকে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে মেয়েকে ভাইএর দিকে একটুকুস নজর রাখতে বলে শিউলি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে।
্্্্

“বকুলফুল, বাড়ি আছিস নাকি?” বলতে বলতে হাঁটু অব্দি জল ছপছপ করতে করতে শিউলি সন্ধ্যামণির পলিথিন ছাওয়া বাড়ির উঠোনে।

হাঁকাড় শুনে সন্ধ্যমণির মেয়ে দোলনচাঁপা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।
” মায়ের খুব অসুখ মাসি। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। তুমি ঘরে এসো।”

শিউলি অন্ধকার স্যাঁতসাঁতে ঘরটায় ঢুকে বিছানার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। এ কাকে দেখছে ও! সন্ধ্যামণি! না তার প্রেত! ওদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে সোন্দর ছিল বকুলফুল। দেবীর চালচিত্তিরের মতো পাছা ছাপানো চুল ছিল। সেসব উঠে অড়হর ডালের বড়ির মতো একটুখানি খোঁপা। তিরিশ না পেরোনো শরীরটা দেখে যেন মনে হচ্ছে সাতজন্মের এক বুড়ি বিছানার অন্ধকার মেখে শুয়ে আছে।
“এ কি চেহারা হয়েছে বকুলফুল তোর!”

একটা ম্লান হাসি ফুটে ওঠে সন্ধ্যামণির মুখে। চৌকির কোণাটায় আর‌ও ঠেসে শুয়ে একচিলতে জায়গা করে দেয় ওকে।
“বোস এখানটায়। তুই এসেছিস আমি খবর পেয়েছি। ভাবছিলাম কবে আসিস আমার কাছে।
এবারে কি একেবারে চলে এলি? না আবার যাবি ফিরে?”

“জানিনা রে, সবকিছু যে আবার কবে আগের মতো হবে?”

” আগের মতো আর কিছুই ঠিক হয়না রে। যা হাত থেকে গড়িয়ে যায় তা আর ফিরে আসে না।
তা এই অসময়ে একা এলি যে বড়ো! মণ্ডলদাদা তোকে এই দুপুরের তাতে এ্যাত্তোখানি পথ একা আসতে দিলো!”

“সে বাড়ি নেই রে। মহাজনের নৌকাতে গেছে।”

” অ! সেই শেষকালে বাপদাদাদের রাস্তাটাই আপন করে নিলো তাহলে!”

” কি করবে বল, পাঁচ পাঁচটা পেট। চালাতে তো হবে।
আমি ও তোর কাছে আজ একটা দরকারে এসেছি বকুলফুল। আমাকেও একটা কাজ দেখে দে তুই। তোর মীন ধরার কাজ। অতসীর বাপের ফিরতে এখনো কম করে সাতদিন তো লাগবেই। এদিকে ঘরে চাল বাড়ন্ত।”

” ও কাজ তুই পারবি না। তুই এখন বাবুঘরের বিবি হয়ে গেছিস। ও বড়ো কষ্টের কাজ। বিদ্যেধরীর নোনাজল ঘাঁটতে হয়। শরীলটায় আর কিছু থাকে না। পায়ে হাতে হাজা, পেচ্ছাপের দ্বারটায় সাদা জল ভাঙতে ভাঙতে হেজে গিয়ে ঘা হয়ে গেছে। সারাদিন জ্বালাপোড়া। তবু পোড়াপেট তো শোনে না। এই দ্যাখ না, আমি যেতে পারছি না। সব জেনে শুনেও মেয়েটাকে পাঠাতে হচ্ছে। একবেলা নুন পান্তা খেয়েও তো টিকে থাকতে হবে।”

“সেকি চাঁপি যাবে! ও তো দুধের বাচ্চা রে! আমার অতসীর বয়সী!”

” দুধ! পান্তোই জোটে না তো দুধ! তার আবার দুধের বাচ্চা! কেউ একমুঠো চাল দিয়ে সাহায্য করবে! তুই দিবি! ও না গেলে খাবো কি আমরা! ওর তো আর মাথার ওপরে বাপ বেঁচে নেই। ” কাশির দমকে শেষ কথাগুলো জড়িয়ে যায় সন্ধ্যামণির।

দোলনচাঁপা তাড়াতাড়ি একঘটি জল নিয়ে ছুটে আসে।
“আহ্ মা অতো কথা বলো কেন তুমি? চুপ করে শুয়ে থাকো।
ও আমার অব্যেস আছে মাসি। মায়ের সাথে সাথে আমি গিয়েছি কয়েকবার। আমার সাথে তো তোমাকে যেতে দেবে না মাসি। আমি আসিমা খালার দলের সাথে যাই। খালা চাইলে তুমি যেতে পারো। তুমি একটু মায়ের কাছে বসো। আমি খালার সাথে কথা বলে আসছি।”

“আসীমাকে চিনতে পারলি বকুলফুল?” সন্ধ্যামণি জিজ্ঞাসা করে।

“না। কে? এপাড়ার ব‌উ?”

“মতিন খুড়োর মেয়ে। আমাদের সাথে চারক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল। একটু খোনা সুরে কথা বলতো। সামনের দাঁতটা উঁচু মতো ছিল। আমরা ওকে আড়ালে পেত্নী বলতাম। মনে নেই তোর!”

” ও, সেই কালিপেত্নি!
তার তো অনেকদূরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল শুনেছিলাম। ”

“ফিরে এসেছে। ওর‌ও কপালটা আমার মতোই ছেঁড়াফাটা।ওর সোয়ামি ওকে তালাক দিয়ে দিয়েছে। পাতে চুল পরেছিলো বলে মেরেধরে ছেলে সমেত তাড়িয়ে দিয়েছে। আসলে আর এক শাকচুন্নি ঘাড়ে চেপেছিল। তাই অজুহাত দিয়ে পুরনোটাকে তাড়ালো।”

ওমা…. মা.. সর্বনাশ হয়ে গেছে।” চোখ কপালে তুলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে আসে দোলনচাঁপা।
“জাভেদ ভাই মা…”বলেই হাঁফাতে থাকে দোলনচাঁপা।

” আহ্, মোলো যা! জাভেদের কি হয়েছে তা বলবি তো!”
উত্তেজনায় চৌকি আঁকড়ে সন্ধ্যামণিও উঠে বসেছে।

“জাভেদ ভাই বোধহয় মরে গেছে।” হড়বড়িয়ে বলে ওঠে দোলনচাঁপা।

“রকম দ্যাখো মেয়ের ! মরে গেছে মানে কিরে! চোদ্দো বছরের জোয়ান ছেলে! আধছেঁড়া কথা বলিস কেন!”
সন্ধ্যামণির গলা দিয়ে বিরক্তি ঝরে পরে।

একটু দম নিয়ে দোলনচাঁপা বলতে থাকে, ” জাভেদ ভাই তো এবারেও ওসমান চাচাদের ইজারা নেওয়া পুকুরটায় পদ্ম তুলতে গিয়েছিল। সেখানে গোখরো কামড়েছে।”

“সে কি রে! কি বলছিস কি তুই! বাড়িতে নিয়ে এসেছে নাকি ছেলেটাকে?” সন্ধ্যামণি এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে।

” না, না একেবারে গোসাবার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। নীলচে মেরে গেছে। সবাই তো বলছে পদ্মগোখরোর কামড়। বিষ একেবারে মাথায় উঠে গেছে। প্রাণ আর নেইকো।”

” আসীমা! আসীমা কোথায়!”

” খালা তো খবর শুনেই দৌড়েছে।
তোমার কথা বলতে পারিনি গো মাসি। খালার সাথে আমার দেখাই হয় নি।”

” এখন কি ওইসব কথা বলার সময়। বড় হচ্ছিস বুদ্ধি যে কবে হবে তোর!
এখন কি হবে বলতো শিউলি! ওই ছেলের মুখের দিকে চেয়ে আসীমা বেঁচে আছে যে। আবার নিকাহ্ তে বসলো না পর্যন্ত।”

“আমি আজ আসি বকুল ফুল।” শিউলি ধীরে ধীরে বলে ওঠে।

“আসবি? আয়.. আসীমা তো কবে কাজে যেতে পারবে বোঝা যাচ্ছে না। আমি একটু সুস্থ হয়ে নি। তারপরে মহাজনকে তোর হয়ে বলবোখনি।”

ঝিকিমিকি রোদ্দুরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কখন যেন কাদার ছিটে লেগেছে তার গায়ে। অকাল সাঁঝের কালশিটে মারা আকাশটাকে সাথে নিয়ে শিউলি ঘরে ফেরে।

্্্্্্

আজ দুদিন পেটে একটা দানাপানি পড়েনি শিউলির। ছেলেমেয়ে দুটো আর শাউরিবুড়িকে কাল দুপুরে শেষ ভাত দিয়েছিল। পুকুরের ধার থেকে কিছু শাকপাতা নিয়ে এসে সেদ্ধ করে তাই দিয়ে চালিয়েছে আজ দুপুরটা। অবুঝ ছেলেটা ভাত ভাত করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছে। কাল কি হবে ভাবলেই হাত পা ঠাণ্ডা মেরে আসছে। কার কাছে গিয়ে হাত পাতবে? সব বাড়িতেই যে সেই এক‌ই হাহাকার আর শূন্যতার গল্প।

দিশেহারা শিউলি সমানে রিলিফের বাবুদের কাছেও গেছে। যদি কিছু চাল পাওয়া যায়। কিন্তু খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। ওদের কাছে যে রেশনকার্ড নেই। সব যে ওরা খুইয়ে বসে আছে। কি যে করে ও এখন …
“হে মা শেতলা,হে মা বিশালাক্ষী একটা উপায় বলে দাও মা। কোন রাস্তায় গেলে অন্তত ছেলেমেয়ে আর বুড়িটার মুখে কিছু তুলে দিতে পারবো।”

পাশের বাড়ির দাসেদের বড়ব‌উ মল্লিকা শম্ভুখুড়োর গুদামের কথা বলছিল। সেখানে গেলে নাকি কিছু উপায় হলেও হতে পারে।

ওর মুখটিপে হাসিটা শিউলির ভালো লাগেনি। কিন্তু কোনো উপায়ই যে নজরে আসছে না আর। চারপাশেই তো আঁধার। ছেলেমেয়ে দুটোর মুখের দিকে আর তাকাতে পারছে না। বুড়িটাও শাপশাপান্ত করতে করতে ঝিমিয়ে পরেছে।
ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে রাতভোর শুধু ভেবেছে আর ভেবেছে। তারপর সকাল হতেই ছুটেছে শম্ভুখুড়োর গুদামের দরজায়। আছড়ে পড়েছে খুড়োর পায়ে
” অন্তত কয়েক কেজি চাল আমাকে ধার দাও খুড়ো। বাচ্চাগুলো আর বুড়িটার মুখের দিকে চেয়েই আমাকে দয়া করো‌। অতসীর বাপ বিদ্যেধরী থেকে ফিরলেই আমি সুদসমেত তোমার দেনা শুধে দেবো খুড়ো।”

” সব‌ই তো বুঝলাম মণ্ডলব‌উ। কিন্তু তুইও আমার অবস্থাটা বোঝ। একদিকে সরকারি নিয়মের কড়াকড়ি। বেনিয়ম ধরা পরলেই দোকানের কাগজ বাতিল করে দেবে। অন্যদিকে দেশকালের অবস্থা গতিক‌ও বিশেষ সুবিধার নয়। সবাই তেতে আছে। তোদের আবার রেশন কার্ড নেই। আমি কি করতে পারি বল দিকিনি। আমার তো হাত-পা সব বাঁধা।”

“সেসব আমি জানিনা খুড়ো, তুমি আমার বাবার মতো। তোমাকে আমায় চালের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। আমি তো বলছি তোমায় সব দেনা আমি শুধে দেবো। এই সময়ে তুমি আমাদের বাঁচাও খুড়ো।”

শম্ভুখুড়ো শিউলিকে ধরে তুলে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকে, ” এই এক জ্বালা। আমার মনটা আবার ভীষণ নরম। লোকের দুঃখ কষ্ট সহ্যি করতে পারি না। তুই একবার রাতের দিকে আয় দিকিনি। দেখি তোর জন্য কি করতে পারি। তবে হ্যাঁ, লুকিয়ে আসবি বুঝেছিস। কেউ দেখে ফেললে বিপদ আছে। ”

শিউলি বুঝতে পারছিল ওর ইছামতীর দুকুল ছাপানো লাবণ্য খুড়োর চোখে নেশা ধরিয়েছে। নিজেকে আঁচড়ে কামড়ে রক্ত বার করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্ত অতসীর বাপকে দেওয়া কথাটা যে তাকে রাখতেই হবে।

্্্্্্্

কাল সমস্ত রাত ধরে শিশির ঝরেছে। দূরের কোণে মেঘটা আবার জমাট বাঁধছে। সাদা ধবধবে শিউলি ফুলগুলো রাস্তার কাদায় একেবারে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। ইছামতীর পাড় ভাঙছে। ধুয়ে যাচ্ছে রঙ। ডুবে যাচ্ছে পুরোনো বিচুলির কাঠামো। সেসব ছাপিয়ে ফুটন্ত ভাতের গন্ধে চারদিক মম করছে।
দূর থেকে দেবীর বোধনের সুর তখন বাতাসে…
” যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা….
নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমঃ নমাঃ……”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *