বাংলার লোক উৎসব 🖋️ রীতা পাল

বাংলার লোক উৎসব
রীতা পাল

লোক উৎসব গ্রাম বাংলার জনগণের প্রিয় উৎসব। এর প্রচলন হয়েছিল মূলত ভোজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রাচীনকালে শিকারকৃত পশুর মাংস একত্রে বসে ভোজন করা ও নৃত্যগীত এর মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান পালিত হতো। পরবর্তীকালে কৃষি ও পশুপালন এর স্তরে এসে এই উৎসব একটা নতুন মাত্রা লাভ করে এবং বিভিন্ন সময়ে যুগের দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের লোক উৎসবের সৃষ্টি হয়।

চড়ক পূজা হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোক উৎসব। চৈত্রের শেষ এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ।
চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ ফুল ফল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবের প্রণাম করে। এছাড়া দেবতার অবিচল ভক্ত ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তারা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেয়। অনেকে পা দুটি ওপরে মাথা নিচের দিকে রেখে করে ঝুলে থাকে। এগুলি যথাক্রমে- বঁটি ঝাঁপ,কাঁটা ঝাঁপ ও ঝুল ঝাঁপ নামে পরিচিত। আরো আত্ম নির্যাতনের জন্য আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লৌহশলাকা সারাদিন জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলতো। এর নাম বন সন্ন্যাস। পিঠের দুদিকের চামড়া ভেদ করে একটা বেত প্রবেশ করাকে বলা হয় বেত সন্ন্যাস। আর চড়কগাছটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। এর এক প্রান্তের ঝোলানো দড়িতে একজন সন্ন্যাসী কোমরে কাপড় বা গামছা বেঁধে ঝুলে থাকেন। অপরপ্রান্তে কাষ্ঠখন্ডটিকে চক্রাকারে চরকির মতো ঘোরানো হয়। এই প্রক্রিয়াটির নাম বড়শি সন্ন্যাস।

“ভাদু আমার গরবিনী। ওলো আমার ভাদু মনি মাথায় দিব সোনার মুকুট,শাড়ি দিব জামদানি।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া,বীরভূম,পশ্চিম মেদিনীপুর,পশ্চিম বর্ধমান জেলার আমলাশোল মহকুমায় এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারীবাগে এই উৎসবের প্রচলন আছে।
পুরো ভাদ্র মাস ধরেই চলে ভাদু উৎসব। সঙ্গে গাওয়া হয় ভাদু গান। বিশেষতঃ গৃহবধূদের জীবনের কাহিনী এই গানের বিষয়বস্তু। তাছাড়া পৌরাণিক ও সামাজিকভাবে গানগুলি পাঁচালীর সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। সেই গানগুলোতে ফুটে ওঠে রামায়ণ,মহাভারত এবং রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের পৌরানিক কাহিনী। ভাদু উৎসব তথা এই গানের প্রচলন ঘিরে বেশ কিছু গল্প কথা শোনা যায় লোকমুখে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত যে গল্পটি সেটি হল – পঞ্চকোট রাজ পরিবারের রাজা নীলমণি সিংহ দেও এর তৃতীয় কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী। আসলে বিয়ে করতে আসার পথে হবু বর এবং বরযাত্রীরা ডাকাত দলের হাতে নিহত হয়। সেই শোকেই স্বামীর চিতায় নিজেকে শেষ করে দেয় ভদ্রাবতী। মেয়ের স্মৃতিকে মানুষের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে নীলমণি সিং দেও ভাদু গানের প্রচলন করেন।
ভাদু উৎসবে পূজারীরা ভদ্রেশ্বরীর একটি মূর্তি তৈরি করেন এবং সারা মাস ধরে তার নিত্য-গীতি পরিবেশন করেন। ভদ্রেশ্বরী কখনো কন্যা কখনো জননী রূপে পূজিত হয়। ভাদু ভাসান পর্ব অত্যন্ত বিষাদময়। ভাদু সংক্রান্তিতে উপোস করে মূর্তিসহ নদীতীরে সমবেত হয়ে মূর্তি বিসর্জন দেয়। বিবাহ প্রধান গান ভাদু উৎসবের মূল আকর্ষণ। এর কারণ হলো কুমারী ভাদুর স্মৃতি রোমন্থন করা।

রাঢ়বঙ্গের পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদনীপুর ও ঝাড়গ্রামের মানুষদের কাছে প্রধান উৎস হল “মকর উৎসব”। এই পরবে সবাই বাড়িতে ফেরে নতুন জামা পরে। পিঠে,মাংস-ভাতে জমে ওঠে ওঠে পার্বন । দিনের শেষে টুসু ভাসিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরেন। বছরের এই একদিন টুসু ফেরে বাড়িতে। সংক্রান্তির আগের দিন অর্থাৎ আউনি-বাউনি দিনে শুরু হয় টুসু পূজা। রাত জেগে মেয়ে টুসুকে সাজিয়ে চলে পালাগান। শীতের রাতেও সবাই মিলে জড়ো হয় উঠানে। সেখানে পিঠেপুলি,পায়েসের সঙ্গে চলে উৎসব উদযাপন। টুসুকে এলাকার মানুষেরা পুজো করে লক্ষ্মী রূপে। নিজের মেয়ের মত টুসুকে সাজায় নিজের হাতে। বাঁশে রঙিন কাগজ লাগিয়ে তৈরি হয় নানা রকমের রংবাহারি চৌডল। সেই চৌডাল জলে ভাসানো হয়। ঘরমুখী মানুষ আলাদা ছন্দে,আলাদা সুরে টুসু গান গায় এই পৌষ সংক্রান্তিতে। টুসু গান আসলে মানুষের হৃদয়ের কথা। লোক জীবনের সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না টুসু গানের সুরে উঠে আসে। টুসু কোন দেবী নয় গ্রাম বাংলার প্রতীক টুসু। চাষাবাদের সঙ্গে জড়িয়ে এই পুজো। টুসু গানের পরোতে পরোতে ধরা পড়েছে জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি। গানের কথা বুঝিয়ে দেয়,যেন তাকে যেতে দেওয়া হবে না। শীত চলে গেলে ভাষণ দেওয়া হবে। উৎসবের আগের রাতে হয় জাগরণের পালা।
“টুসু ধনকে জলে দিও না।
আমার মনে বড় বেদনা।
টুসু ধনকে জলে দিও না।”
এই গানের মাধ্যমেই হয় টুসুর বিসর্জন।

বাংলা নববর্ষ এখন জাতীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। এই উৎসব উপলক্ষে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারের গৃহিণীরা “আমানি” প্রস্তুত করে। একটা বড় হাঁড়িতে অনেকটা জলের মধ্যে আমা আর কিছু চাল ভেজানো থাকে এবং রাখা হয় একটি শক্ত আমের ডাল। ভোরবেলা বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে গৃহিণী তাদের ওই ভেজানো চাল খেতে দেয় আর আমের ডাল দিয়ে গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়। এতে শরীর ঠান্ডা হয় বলে বিশ্বাস। এদিন সবাই সাধ্যমত উন্নত ভোজের আয়োজন করে। এর মূলে তাদের এই বিশ্বাস কাজ করে যে,বছরের প্রথম দিন ভালো ভোজ হলে সারা বছর ভালো ভোজ হবে। এই উৎসবকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন শহরে,নগরে ও গ্রামাঞ্চলের মেলা হয়।
পহেলা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মালম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও লক্ষী দেবীর পুজো করেন। ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব এর সমন্বয় কষে এইদিন নতুন খাতা খোলেন। এইদিন খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করবার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় শুভ হালখাতা কার্ড এর মাধ্যমে এবং দোকানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। এছাড়াও অম্বুবাচী,নবান্ন,পৌষ পার্বন,কুল কুলতি ইত্যাদি লোক উৎসবের প্রচলন আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *