রাশিয়া: এক স্বপ্ন উড়ান (তৃতীয় পর্ব) © সায়ন্তন ধর

রাশিয়া: এক স্বপ্ন উড়ান (তৃতীয় পর্ব)
© সায়ন্তন ধর

ট্রেনের বাঁ দিকের জানালার ধারে বসার জায়গা পেলাম। বেশ কিছুটা পথ চলার পর দূর থেকে দেখা গেল বৈকাল হ্রদ। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম সুপেয় জলের হ্রদ। আমেরিকার পঞ্চহ্রদের মোট জলের চেয়েও বেশি জল বহন করে এটি। এটি পৃথিবীর গভীরতম হ্রদও। এই হ্রদটিকে পৃথিবীর স্বচ্ছতম এবং প্রাচীনতম হ্রদ বলেও গন্য করা হয়। এটি পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম হ্রদ। এটি একটি গ্রস্ত উপত্যকার মধ্যে অবস্থিত। বৈকাল হ্রদের তীর ধরে রেল লাইন বিস্তৃত হয়েছে। হ্রদের জল কখনও কখনও মনে হচ্ছে যেন ট্রেনের চাকা ছুয়ে ফেলবে। অনবরত ঢেউ এসে পড়ছে। বৈকালের তীরে অসংখ্য পর্যটকেরা আইস স্কেটিং করছে, কেউ কেউ হ্রদের জলে সুদৃশ্য নৌকোয় চড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই হ্রদের তীরে জাবাইকালস্কি জাতীয় উদ্যান রয়েছে। একদিকে যখন নীল জলরাশি ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে অপর দিকে শুভ্র বরফাবৃত মাটির উপর হলুদ পাতা যুক্ত ‘নাম-না-জানা উদ্ভিদ’ – যেন হলুদ রঙের আবীর খেলছে। হ্রদের জলে অসংখ্য পরিযায়ী ‘মঙ্গোলিয়ান গাল’ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। ‘নেরপা’ বা বৈকাল সীল মাঝেমধ্যেই জল থেকে উঠে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে আবার গভীর জলে দুবে যাচ্ছে। দীর্ঘ এ বৈচিত্র্যপূর্ণ পথ পাড়ি দিলাম এভাবেই। সকাল সকাল রওনা দেওয়ার পর রেল পথের সাথে বৈকাল হ্রদের দূরত্ব যখন বাড়তে লাগলো তখন বৈকালিক আলোয় বৈকাল হ্রদের দিকে শেষবারেরে মত দৃকপাত করলাম। জল ছাড়িয়ে দূরে সায়ন পর্বত দেখা দিল। সূর্যের রক্তিম আভায় নীল জল তখন লাল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকেই। আর বেশ কিছুক্ষণ রেল যাত্রার পর উলান-উদে স্টেশনে নামলাম। এরপর গন্তব্য ইয়াকুটস্ক শহর। উলান-উদে থেকে এর দূরত্ব ২৬০০ কিমি। যাত্রাপথে পড়বে ইয়াব্লোনয় ও স্ট্যানোভয় পর্বত। সাইবেরিয়ান এই পর্বত দুটি চিরতুষারাবৃত। গড় উচ্চতা প্রায় ১৫০০ মিটার হলেও ৫০ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশের উপরে অবস্থান হওয়ায় এখানে পারমাফ্রস্ট হয়। এভাবে প্রায় একটানা ৩৬ ঘণ্টা যাত্রার পর ইয়াকুটিয়া রিপাবলিকের রাজধানী ইয়াকুটস্কে পৌঁছলাম। ইয়াকুটিয়া রিপাবলিকটি আয়তনে ভারতের সমান। এই অঞ্চলে রাশিয়ানদের তুলনায় ‘সাখা’ উপজাতির মানুষের সংখ্যা বেশি। ১৯১৭ এর নভেম্বর বিপ্লবের আগে জারের শাসনকালে এই শহরের প্রিজন ক্যাম্পে অপরাধীদের রাখা হত। চারিদিক তুষারাবৃত বলে তারা প্রিজন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যেতে পারত না। এক সময় এখানে বন্দীদের বনের গাছ কাটার কাজ করতে হত। এভাবেই হঠাৎ একদিন কেউ পেয়ে গেল সাদা সোনার খনি। আইভরি বা হাতির দাঁত একটি খুবই দামী সম্পদ। কিন্তু সেটা সংগ্রহ করতে গেলে হাতিকে প্রাণ দিতে হয়। তুষার যুগের আগে উলি ম্যামথেরা এই অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াত। বরফের নীচে তাদের দেহ আজও অবিকৃত অবস্থায় শায়িত অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভাবে সংরক্ষিত। ম্যামথের দাঁত এবং হাতির দাঁতের গুণগত মান একই হওয়ায় এবং মৃত ম্যামথের দাঁত সংগ্রহে আইনগত বাঁধা না থাকায় সেই অঞ্চলকে সাদা সোনার খনি হিসেবে চিহ্নিত করা হল। ম্যামথের দাঁত সংগ্রহের জন্য বরফ এবং বরফের ঠাণ্ডায় জমে থাকা শক্ত মাটিকে খনন করার কাজে জলের জেট স্প্রে ব্যবহার করা হত। ফলস্বরূপ নির্বিচারে ভুমিক্ষয় তো হতোই সাথে জল সম্পদের অপচয়ও ঘটত। এছাড়া এই ধরনের উলি ম্যামথ ও উলি রাইনোর জীবাশ্ম গুলি নৃতত্ত্ববিদদের গবেষণার বিষয়। তাই বর্তমানে নির্বিচারে ম্যামথের দাঁত বা রাইনোর খড়্গ সংগ্রহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইয়াকুটস্কের ম্যামথ মিউজিয়ামে গেলে এখন সেই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের দাঁত, হাড়, জীবাশ্ম দেখা যায়। রাশিয়ার যার মিখাইল রোমানভ ‘রোমানভ’ রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই প্রথম গোলাপ গাছ এনে রাশিয়ায় গোলাপ বাগান তৈরী করিয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রহে ছিল বহু মূল্যবান চারটি হীরে যাদের নাম ছিল – অগ্নি, পৃথ্বী, মরুৎ এবং অপ্। মনে করা হয় এই অঞ্চলেই কোন এক গুহায় যত্নসহকারে এগুলি রক্ষিত আছে। এই গল্প শুনলাম স্থানীয় যুবক আইসেনের কাছে। ইয়াকুটস্ক শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লেনা নদী। এই নদী পেরিয়ে আর একটু পূর্বে এগোলেই ভারখোয়ানস্ক পর্বত। এখানকার ভারখোয়ানস্ক শহর রাশিয়ার দ্বিতীয় শীতলতম স্থান। আরও পূর্বে এগিয়ে গেলাম পৃথিবীর দ্বিতীয় তথা মনুষ্যবসতিপূর্ণ শীতলতম স্থান ঐমিয়াকণ। যার পাশ দিয়ে বয়ে ছলেছে ইন্দিগীর্কা নদী। আরও পূর্বে এগিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম বেরিং প্রণালী। যার দক্ষিণে বেরিং সাগর, উত্তরে উত্তর মহাসাগর এবং আরও পূর্বে আলাস্কা। জারের রাজত্বকালে আলাস্কা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আলাস্কায় সীল শিকারের উদ্দেশ্যে সীল শিকারীরা বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে সীলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় আলাস্কাকে জারেরা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়। এরপর বেরিং প্রণালী থেকে সমুদ্রপথে রাশিয়ার উত্তর উপকূল বরাবর পশ্চিমদিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। ওব ইনিসি লেনা – প্রতিটি নদীর মোহনা অঞ্চলে শীতকালে বন্যা হয়। সুমেরুবৃত্তের মধ্যে অবস্থান হেতু নদীগুলির মোহনা জমে বরফ হয়ে যায়। কিন্তু উৎস অঞ্চলের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের উপরে থাকায় জল উত্তর অভিমুখে প্রবাহিত হয়। মোহনা বরফাবৃত থাকায় জল সমুদ্রে পৌঁছতে পারে না। ফলে মোহনার আগেই বিস্তৃত অঞ্চল প্লাবিত হয়। রাশিয়ার প্রধান ভূখন্ডের সাথে কিছু দ্বীপ ও উপদ্বীপ রয়েছে। যেমন ওখটাস্ক সাগরের সাখালীন দ্বীপ, কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জ এবং কামচাটকা উপদ্বীপ।নোভায়া জেম্বোলিয়া,সেভারনাইয়া জেম্বোলিয়া, নিউ সাইবেরিয় দ্বীপপুঞ্জ, রাঙ্গেল দ্বীপ প্রভৃতি উত্তর মহাসাগরের দ্বীপগুলি চির তুষারাবৃত। এভাবে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জের মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে পশ্চিমে মুর্মানস্ক ও ক্যারেলিয়ায় এসে পৌঁছোলাম। এই অঞ্চলটি স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চলের অংশবিশেষ বলা যেতে পারে। আর একটু দক্ষিণ মুখে এগোলাম। হাতের ঘড়িতে রাত দশটা, সূর্য ডুববো ডুববো করছে। শহরটির নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। এই শহরেই ২০১৮ সালেই ফুটবল বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, যেখানে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানী, স্পেন, ইটালির মতো বিশ্বজয়ী দেশ এই রাশিয়ার মাটিতেই পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিলো। সেন্ট পিটার্সবার্গের মাটি ছুঁয়ে মনে হলো এই রাশিয়াতেই বিশ্বজয়ী বীর নেপোলিয়ন ওয়াটার্লুর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, এই রাশিয়াতেই তদানীন্তন বিশ্বত্রাস জার্মানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছিলো। এটা যেন এমন একটা মিথ, যা সমস্ত প্রাকৃতিক বাঁধা অতিক্রম করে রাশিয়াকে বারবার বিশ্বজয়ীর শিরোপা এনে দিয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে বেশ কয়েকটি অন্তর্দেশীয় সীমানা পেরিয়ে চলে এলাম কালিনিনগ্রাদ। এটি রাশিয়ার একটি ওবলাস্ট যা মূল ভূখন্ড থেকে দূরে লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডের সীমানায় অবস্থিত। সেখান থেকে চলে এলাম ইউরোপের রুটির ঝুড়ি ইউক্রেনে। ইউক্রেন বললেই মনে পড়ে যায় চেরেনোবিল বিস্ফোরণের কথা। শুনেছিলাম আগামী বহু শতক ধরে এখানে কোনরকম জীবনের স্পন্দনই থাকবে না পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার কারণে। কিন্তু চেরেনোবিলে গিয়ে দেখলাম কংক্রীটের বৃহৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতের চারপাশে সবুজের সমারোহ,যেন গাছেদের ঘরবাড়ি সেখানে। এখানে ওখানে যত্রতত্র খরগোশ, কাঠবেড়ালী, শেয়াল, হরিণ, নেকড়ে প্রভৃতি খাদ্য খাদক সম্পর্কিত প্রতিটি জীবই অকুতোভয়ে বিচরণ করছে। হয়তো এ বিষ্ফোরণ আদতে ধ্বংস নয়। বরং আদিম প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে। এ যেন আশীর্বাদ। এখানে দাঁড়িয়েই হঠাৎ মনে পড়ে গেলো ১৯০৮ সালের টুংগুসকা বিষ্ফোরণের কথা। ৩০ শে জুন সকাল সাতটা সতেরো মিনিটে ঠিক কি যে হয়েছিলো তা আজও রহস্যাবৃত। তবে মনে করা হয় কোন বিরাটাকার উল্কাপাএর ফলে এ বিষ্ফোরণ। ইউক্রেণ থেকে কৃষ্ণ সাগরের তীর ছুঁয়ে ককেশাস পর্তমালা পেরিয়ে কাস্পিয়ান সাগরে এলাম। এটি তো সাগর নয়,এটি আসলে হ্রদ। পৃথিবীর সর্বোবৃহৎ হ্রদ কাস্পিয়ানকে তাই কাস্পিয়ান হ্রদ না বলে কাস্পিয়ান সাগর বলা হয়। এখানে ইউরাল নদীর মোহনায় কিছুক্ষণ থেকে নৌকোয় করে স্রোতের বিপরীতে যাত্রা শুরু করলাম। এর উৎস তথা ইউরাল পর্বতের কাছে এসে গন্তব্যে অর্থাৎ উফা শহরে পৌঁছোলাম। মনোশ্চক্ষে দেখলাম শহরটিকে। এরপর সেখান থেকে ১০০০ কিমি পশ্চিমে গোর্কি নামটা খুব টানলো। চলে গেলাম সেখানে। সেখানে ক্রিশ্চানদের একটি সমাধিক্ষেত্রে বসে ভূপেন হাজারিকার গানের কয়েকটি পঙক্তি গুনগুন করে গাইলাম – “আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভল্গার রূপ দেখেছি/অটোয়া থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধুলো মেখেছি/আমি ইলোরার থেকে রঙ নিয়ে দূর শিকাগো শহরে দিয়েছি/গালিবের শের তাশখন্দের মিনারে বসে শুনেছি/মার্ক টোয়েনের সমাধিতে বসে গোর্কির কথা বলেছি/ বারে বারে আমি পথের টানেই পথকে করেছি ঘর/ তাই আমি যাযাবর …”

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *