জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া © সায়ন্তন ধর

জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া

© ✍ সায়ন্তন ধর 
(দ্বাদশ পর্ব)

…প্রথম যেদিন ভ্রমণ শুরু করেছিলাম এই নদীর উচ্চগতি দেখেছিলাম। আজ দেখছি বহুদূর বিস্তৃত বেশ চওড়া নিম্নগতি। ব্রেমেনের পরিচিতি রয়েছে চাকুরীজীবীদের শহর হিসেবে। আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলি বেশিরভাগই কর্পোরেট ভবন। রাস্তাগুলো ঝাঁ চকচকে হলেও দুপাশে ওক, বীচ, ম্যাপলের সারি। তাদের ছায়া ও ঝরে পড়া পাতায় ম্যাস্টিক রোডে নকশা তৈরি হয়েছে। ১৯২৩ সালের কোন এক বসন্তদিনে এই নকশা আঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হ্যাচেজ চকোলেট কোম্পানির স্থপতি ঝরে পড়া ওক, ম্যাপলের পাতাগুলিকে লক্ষ্য করলেন। এখনও ওই চকোলেট কোম্পানি পাতার আদলে চকোলেট তৈরি করে, যা পৃথিবী বিখ্যাত। পথ চলতে হঠাৎ দেখি ঠিক যেন নীল সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে রুপোলি তিমি। ওটি আসলে তিমির অনুকরণে গড়া ব্রেমেনের ইউনিভার্সাম সায়েন্স সেন্টার। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে দিলাম। এরপর এলাম বোটানিকা তে। এটি ব্রেমেনের রডোডেন্ড্রন পার্কে অবস্থিত একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। কাচের ঘরে প্রবেশের পরই একটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হল। পাশ্চাত্য ছেড়ে চলে গেলাম যেন সুদূর প্রাচ্যে। এশিয়ান ফ্লেভারের প্রথম উপকরণ জাপানী উদ্যান ও ট্র্যাডিশনাল বাড়ির আদল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা অদ্ভুত মেলবন্ধন রয়েছে এখানে। সেখান থেকে বোর্নিওর গাঢ় সবুজ হয়ে নিউগিনি, সেখান থেকে হিমালয়। বুদ্ধিস্ট প্রেয়ার হুইল, চাইনিজ চা চক্র, বুদ্ধদেবের শায়িত মূর্তি সঙ্গী ছিল পুরো পথে। পাহাড়ি সংকীর্ণ রাস্তা, অতল খাদ, ঝর্ণা, রডোডেন্ড্রনের লোকাল ও এক্সোটিক ভ্যারাইটিতে এক মন অন্য রকম করে দেওয়া পরিবেশ। আবার বলা যায় বিদেশে গিয়ে দেশের অভিজ্ঞতা নেওয়া। শুধু নাম না জানা গাছপালাই নয়, নানা রকম পশু-পাখি, প্রজাপতি রয়েছে এখানে। একটি মৌমাছি কলোনিতে কর্মীদের কাজের নানা প্যাটার্ণ, তাদের রাউন্ড ড্যান্স বা ওয়াগেল ড্যান্স শুধু ছোটদের নয় বড়দের কাছেও বেশ মজার ও শিক্ষনীয়। ইন্সেক্টিভোরাস সূর্যশিশির, কলসপত্রী বা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে দিন কেটে গেলো। একরাশ মুক্ত অক্সিজেন সংগ্রহ করে সেদিনের মত ভ্রমণে ইতি টানলাম। পরদিন স্থানীয় লাইব্রেরীতে গেলাম। চোখে পড়লো Grimms’ Fairy Tales. ছোটবেলায় চিরায়ত শিশু সাহিত্যের গ্রীম ভ্রাতৃদ্বয়ের গল্প পড়েছিলাম। জ্যাকব ও উইলহেলম্ গ্রীম ব্রেমেনের বাসিন্দা ছিলেন। ২১০ টি গল্পের মধ্যে একটি হল Town musicians of Bremen. মনে পড়ে গেল গল্পটি। চারটি গৃহপালিত প্রাণী (গাধা, কুকুর, বিড়াল ও মোরগ) সারাজীবনের আনুগত্য ও কঠোর পরিশ্রমের পরেও অবহেলিত ও লাঞ্ছিত ছিল। তারা ঠিক করে ব্রেমেনের টাউন মিউজিশিয়ান হবে। কারণ ব্রেমেন স্বাধীনতার শহর। যদিও তারা কখনওই ব্রেমেনে পৌঁছাতে পারেনি, তবুও তাদের মূর্তি সিটি হলের সামনে ১৯৫৩ সালে স্থাপন করেছিলেন বিখ্যাত স্থপতি জেরহার্ড মার্কস। সেই স্ট্যাচু দেখে চলে এলাম মার্কেট স্কোয়ারে টাউন হলের সামনে। সেখানে নগররক্ষীর ন্যায় ডান হাতে খোলা তলোয়ার ও বাম হাতে ইম্পেরিয়াল ঈগল চিহ্নিত ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রোল্যান্ড। আশেপাশে পুরোনো ও নতুন অট্টালিকার মিশেল। কারুকার্যময় সুবিশাল চার্চ একদম যেন ছবির মত। এমন সময় বেশ জোরে বৃষ্টি নামলো। লাঞ্চ টাইম, তাই মাথা বাঁচাতে আর উদরপূর্তি করতে চলে এলাম ALEX Bremen Domshof রেস্তোরাঁয়। এলাহি আয়োজন, আমারও জার্মানি সফর শেষ হয়ে আসছে তাই ভাবলাম একটু ভালোমন্দ খাওয়া যাক। অর্ডার দেওয়ার পর কাঁচের দেওয়াল দিয়ে অঝোরধারা দেখছি। আধঘন্টায় বৃষ্টি অনেকটা ধরে এলো, টেবিলে চলে এসেছে রুটি, ফ্রেঞ্চফ্রাই, মিক্সড ডাল, চিকেন স্টু, স্যালাড (ক্যাবেজ, ব্রকোলি, স্পিনাক, লেটুশ, বীট ও পার্সলে পাতা কুচি কুচি করে কেটে লবন ও ওলিভওয়েল দিয়ে তৈরি) আর সবশেষে আপেল ও ডালিম সহযোগে অপূর্ব কাস্টার্ড। খাওয়া শেষ হলে বিল মিটিয়ে বাইরে এসে আমার অবাক হওয়ার পালা। বিদেশের অচেনা আকাশে চেনা সাতটি রং যেনো কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে সে ইন্দ্রধনু এক ঐন্দ্রজালিক মায়া তৈরি করেছে। বিকেল হয়ে এসেছে চললাম ব্রেমেনের সবুজের ঠিকানা নুপস পার্কে। রো বোটে সারা বিকেল ভেসে থাকলাম জলে। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, বৃষ্টির পর সে হাওয়ায় ঠান্ডার আমেজ। সেই রাতটা ব্রেমেনে কাটিয়ে পরদিন ব্রেমেন বন্দর থেকে নৌকো নিয়ে রওনা হলাম উত্তর সাগর অভিমুখে। ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ এর মত এখন দেখার পালা উত্তর সাগরীয় দ্বীপগুলিকে। মোহনার বাঁ দিকে রয়েছে ১২টি দ্বীপ সমন্বিত পূর্ব ফ্রিজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। আর উত্তরে ডেনমার্কের ঠিক পাশেই রয়েছে ১৩ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত উত্তর ফ্রিজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। এই ফ্রিজিয়ান দ্বীপগুলির অধিবাসীরা ফ্রিজিয়ান ভাষায় কথা বলে। এছাড়াও আছে ১০টি দ্বীপের সমষ্টি হ্যালিজেন দ্বীপপুঞ্জ ও দুটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত হেলিগোল্যান্ড। উপকূলীয় এলাকা , , কটন গ্রাস, মার্শ জেনশিয়ান জাতীয় বীরুৎ সমৃদ্ধ। উপকূল, দ্বীপপুঞ্জ ও অগভীর ওয়াডেন সাগর নিয়ে তিনটি জাতীয় উদ্যান তথা রামসর সাইট রয়েছে। ওয়াডেন সাগরে নৌকো নিয়ে ভাসার সময় পরিচিত হলাম অনেক অ্যাকয়োটিক ফ্লোরার সাথে। , , গাছগুলি দেখলাম। গাছটি অনেকটা পার্সলে পাতার মত। . নামক সামুদ্রিক ঈল ঘাসগুলি ওয়াডেন সাগরে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে বেশিরভাগ জায়গায়। বার্নাকল হাঁসেরা সেখানেই ভেসে বেড়াচ্ছে। ওদের প্রিয় খাদ্য এই ঈল ঘাসগুলি। ওয়াডেন সি বীচে পরিযান করে এসেছে একঝাঁক সীল। আকাশে চরকিউড়ান দিচ্ছে আর্কটিক টার্নের দল। এরপর হেলিগোল্যান্ডে নৌকো ভিড়ালাম। দূষণমুক্ত সুন্দর এ দ্বীপে কোন গাড়ি নেই (অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারব্রিগেড ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া) সাইকেলও নেই। পদব্রজে ঘুরে নিলাম পুরো দ্বীপটি। এর নৈসর্গিক দৃশ্য, স্বচ্ছ জল ও পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত মন কেড়ে নিল। এবার ফেরার পালা, বিদায় জানানোর পালা প্রিয় জার্মানিকে।

মানস ভ্রমণ শেষে বিদায় জার্মানি
স্বর্ণ ঈগলের দেশ বিদায় তোমাকে
স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যে তুমি ভূবন মোহিনী
সৌন্দর্য্য পিয়াসী আমি, ভুলোনা আমাকে।

দেখেছি সাগর হ্রদ ক্ষেত আদিগন্ত
নিম্নভূমি জলাশয় ওকের অরণ্য
সুউচ্চ গিরিশিখর তুষারে আবৃত
ভূ-বৈচিত্র্যে অপরূপা রূপসী অনন্য।

শিল্প সংস্কৃতি বিজ্ঞানে অব্যাহত ধারা
পজিটিভ এনার্জিতে গড়ে ওঠা দেশ
কিভাবে যে ফেলে দিলে দিকে দিকে সাড়া
উন্নতি সোপান গড়ো ভুলে হিংসা দ্বেষ।

অনিন্দ্যসুন্দর তুমি বড় মনোহর
বিদায় জানিয়ে চলি আপনার ঘর।

(সমাপ্ত)

© ✍ সায়ন্তন ধর
০৩/০৯/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *