মানব-রতন। ( দ্বিতীয় পর্ব ) ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
ধারাবাহিক গল্প।
মানব-রতন।
( দ্বিতীয় পর্ব )
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
ঘটনার সূত্রপাত সকালে মুরগী বেচতে গিয়ে।সকালে দোকান খোলে রতন।খরিদ্দাররা আসেন,হাতে পাকানো খবরের কাগজ।কয়েকদিন ধরেই পেপারে দিল্লীর দুই প্রভু-ভৃত্যের নরমাংস ভক্ষণের খবরে উত্তাল হয়ে উঠেছে টিভি মিডিয়াও।নরমাংস না বলে নারী ও শিশুমাংস বলাই ভালো।তারা নাকি নারী ও শিশুদের অপহরণ করে কিডনি এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ
পাচার করে।জেরায় তারা কবুল করেছে যে মাংসগুলো তারা রান্না করে খায়।খুবই নরম ও
সুস্বাদু। ঐ বিভৎস খবর নিয়েই চলতে থাকে উত্তপ্ত
আলোচনা।পাশেই আশুর চায়ের দোকানেও কিছু
সর্বজ্ঞানী বসে আছেন,চায়ের ভাঁড় নিয়ে। একজন
বলেন-” আরে বাবা,খাদ্যই তো!মানুষের মাংসকে বলে মহামাংস।তান্ত্রিকরা নাকি খান বলে শুনেছি।
এরাও হবে হয়তো তান্ত্রিক ফান্ত্রিক কিছু।”-আরেক
জন বলেন-“ক্যানিবলদের কথা জানেন তো?এরা
অনেকটা সেই রকমই।”-একজন রসিক মানুষ বলে
ওঠেন-“খবরটা সত্যি ত?নাকি পেপারের বিক্রি বাড়ানোর কারসাজি!হাঃহাঃ।”-রতন অবাক হয়ে ঐসব ভয়ংকর খবর শুনছিল, অভ্যস্থ হাতে মুরগি
কাটছিল,ওজন করছিলো বেচছিল।তার অজান্তেই
যে খবরটার মারাত্মক প্রভাব ভাইরাসের মতো তার
হৃদয়ে প্রভাব ফেলবে ক্রেতাগণ তা জানবেন কী করে? রতনের উত্তপ্ত মস্তিষ্কই যে খবরটির অমন পৈশাচিক ছায়াছবি সৃষ্টি করেছে,তা রতনই বা বুঝবে কেমন করে?ঘুমিয়ে পড়ে রতন খালি পেটে।
বিকেলে স্বপ্না বলে-“যাও,বন্দুদের সঙে এট্টু ফুত্তি কর গা।কী যে হইচে,বুইতি পাচ্চিনিকো। বন্দুদের সঙে কতাবাত্তা কলি মাতাটা ঠাণ্ডা হবে। মনটাও হাল্কা হবেনে।”–
হাটের পরে মাঠ।সেই মাঠের শেষে পুকুরপারে বসে জমাটি তিন তাসের আড্ডা।সব্জিওলা মদন,ঘরামি রাজা,মাছআলা খুদে,খাসিআলা রমজান,ভ্যান
-চালক বুড়ো ইত্যাদি সবাই আছে।তার সঙ্গে আছে বাংলু,চুল্লু,পাউচ,ছোলাচাট,এমনকি পাঁটার ভুঁড়ি-
চচ্চড়ি ও মুরগির গিলাঝাল।জুয়ার আসর জমে ওঠে।একদান জিতে খুদে হাতের একটা অশ্লীল ভঙ্গী করে খামচে টাকা তোলে।মুখে গানের কলি—
-“খামচে নিল বুকের কলিজা।”–চমকে ওঠে রতন, তার মাথার মধ্যে যেন বিস্ফোরণ ঘটে যায়।দুপুরে
কল্পদৃষ্ট যুবতীর লাশ ভেসে ওঠে চোখের ওপর।সামনে বসে আছে যেন খুদে নয়,মাহিন্দার।খবরের কাগজ পড়া বাবুরা ওই নামটাও তো রতনের মাথার মধ্যে গেঁথে দিয়েছে।আচমকাই খুদের গালে প্রচণ্ড এক চড় কসিয়ে গর্জে ওঠে রতন-“চোপ, শালা জানোয়ার কোথাকার!”-।বন্ধুরা হতভম্ব হয়ে
তাকিয়ে থাকে।রতন কোন দিকে না তাকিয়ে এক টানে চুল্লুর পাউচ ছিঁড়ে গলায় ঢেলে নেয় তরল অগ্নি।
টলতে টলতে বাড়ি ফেরে রতন,গলায় গান-
-“খাবলে নিল বুকের কলিজা।”-স্বপ্না স্বস্তির নিশ্বাস
ফেলে।এই-ই তো স্বাভাবিক রতন।এটাই রতনের অভ্যস্থ রূপ,যা স্বপ্নাকে দুশ্চিন্তাপীড়িত করে না। স্বপ্নার গালে টোকা দিয়ে মাতাল আবার গেয়ে ওঠে
-“পাগলি বিউটিফুল।”-
রাতে মাংসভাত খেয়ে শুতে যায় রতন।স্বপ্না বসে থাকে ধর্ষিতা হবার জন্য।তাদের মতো বৌদের
কাছে স্বামীর সোহাগ,ভালবাসা রুক্ষ কর্কশ হলেও
এতেই গর্বিতা তারা।ধর্ষণ ও ভালোবাসা তাদের কাছে সমার্থক।কিছুক্ষণ পরে রতন অনুভব করে তার শরীর সারা দিচ্ছে না।সেই শুন্যবুক মৃত যুবতী দেহটিকে যেন স্বপ্নার মধ্যে আইডেনটিফাই করে রতন।তার পরাজিত পৌরূষ হাহাকার ধ্বনি তুলে কেঁদে ওঠে-“স্বপ্নারে,তোরে যদি কেউ ধরি নে যায়?”-তার প্রলাপের কোন মানে বোঝেনা স্বপ্না। শুধু আহতহৃদয়,মাতাল,নিষ্ঠুর মুরগিওলার স্তিমিত পৌরূষকে জাগ্রত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যায়।
( ক্রমশঃ)