উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী
উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন
লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী
পর্ব- দ্বাদশ (১২)
ধারাবাহিক
সত্যের যখন নিদ্রাভঙ্গ হল,তখন সূর্য্যি মামা প্রায় মাথার উপরে উঠেছে।আকাশে হালকা মেঘের আভাস।সূর্যের আলো কখনও প্রকট হচ্ছে কখনও বা অস্তগামী সূর্যের ন্যায় ধিমিয়ে পড়ছে।এ যেন রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা চলছে।এদিকে রন্জ্ঞন ততোক্ষণে স্নান করে ঠাকুর কে স্মরণ করে আহারাদির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওদিকে রমা বৌদি তাঁদের জন্য রন্ধনকার্য সমাধা করে সহাস্য বদনে তাঁর পরম আদরের ঠাকুরপো দের জন্য পঞ্চব্যন্জ্ঞন রান্না করে একে একে তা পরিবেশনে রত।সত্যর মুখ অন্যান্য দিনের তুলনায় অধিক গুরুগম্ভীর দেখে রমা বৌদী কৌতুক বশতঃ প্রশ্নটা তাঁর দিকেই ছুঁড়ে দিলো-“কি হল,সদা সহাস্য দূরন্ত ভাই টি আমার অমন শান্তশিষ্ট টি হয়ে গেল কেন?বলি হ্যাঁ গো এখনও তো সংসারের যাতাকলে পড়তে ঢের বিলম্ব রয়েছে,তাই তো সেইদিন স্বীকার করলে,তা এখন চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ টি কিসের জন্য একটু বলো তো দেখি।”বলা বাহুল্য তাঁদের এই রমাবৌদি টি ছিলেন মাটির মানুষ।ন্যায় অন্যায় বোধ ও বিচারবুদ্ধি প্রবল।তিনিও কিছুটা সত্যর পন্থাতেই বিশ্বাসী।তাঁর বাপ,ঠাকুরদার অর্থপ্রাচুুর্য্য এবং সংস্কার বরাবরই সুনিপুণ ছিলো।তাই বাল্য কাল থেকেই রমা স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যতায় অধিক বিশ্বাসী।তখন কার দিনেও সে মাধ্যমিক পাশ দিয়েছিলো,যে টা কে তখন আই.এস পাশ বলা হোতো।তাই সত্যব্রত ভাবলো,এটাই সুযোগ,রন্জ্ঞন আমার কথা ফেলে দিলেও রমা বৌদির কথা ফেলতে পারবে না।সে আর সত্য দুজনেই এই বৌদি টি কে নিজের দিদির ন্যায় সম্মান করে ও মায়ের ন্যায় ভক্তিও করে।এদিকে ওদের থেকে কালেজ এর দুই ক্লাশ সিনিয়র নীতেশ যে রমা বৌদির স্বামী সেও আজ বিশেষ কাজের অছিলায় বাইরে বেরিয়েছে।তাই সত্যব্রত এখানে আসা অবধি,ওই ডেরা,মহল্যা,উমার মতোন অনাথিনীর করুন পরিস্থিতির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলো।সত্য জানতো,আর কেউ বুঝুক না বুঝুক,তাঁর রমা বৌদী টি মনের দিক থেকে বড্ড খাঁটি মানুষ।সে সত্যকে ঠিক বুঝবে।সব বর্ণনা,গল্প,ঘটনা শোনার পর রমাবৌদি চোখের অশ্রু সংবরণ করে একটি কথাই বললো,”আ হা!ঠাকুরপো বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে যদি তোমার মতোন উদারচেতা পুরুষ মানুষ যার,বিচার-বুদ্ধি সহনশীলতা সব কিছু সমান,যে নারী কে প্রকৃত রূপেই সম্মান করে,শ্রদ্ধা করে এমন পুরুষ যদি থাকতো,তাহলে,নারীদের লাঞ্চনা গন্জ্ঞনার স্বীকার হোতে হোতো না।হয়তো পতিতা-পল্লী বলে কোনো অন্যায় প্রতিষ্ঠান আজ এই সমাজের চোখে স্বতন্ত্র ভাবে বিরাজ করতো না।ভাই এতো দিন আমি তোমায় স্নেহ করতাম,তোমার চিন্তাভাবনা কে সম্মান করতাম,কিন্তু আজ থেকে আমার চোখে তোমার সম্মান আর শ্রদ্ধা দুটোই বেড়ে গেল।তুমি তো সম্পর্কের সম্মানে আমার চাইতে ছোটো,নইলে আজ অন্তত একটা প্রণাম করতুম তোমায়।কত্ত উঁচু মন হলে,মানুষ এভাবে ভাবতে পারে।তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত ই নিয়েছো ভাই।আমি তোমার পাশে আছি।আর রন্জ্ঞন কেও বলবো,পুরুষ মানুষ হয়ে যখন জন্মেছো ভাই টি,তখন ভয় কিসের?বন্ধু তোমার জন্য এতোদিন যেমন সব কিছু করেছে,আজকে তার এই পূণ্যের অভিযানে তুমিও সামিল হয়ে পড়ো।দেখবে জীবনে আর কোনো গ্লানি থাকবে না,কেউ তোমায় কাপুরুষ বলবে না।শুধু নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আর বন্ধুর ভরসা টা রেখো।”
রন্জ্ঞন এর চোখেও দেখা গেল জলের বিন্দু।আসলে রঞ্জন সত্যব্রতর কাছে ওই মহল্যা আর উমার করুন অবস্থার কাহিনী শুনতে শুনতে তাঁর বোন রন্জ্ঞনার মুখ টা তাঁর চোখের কাছে বারেবারে ভেসে উঠছিলো।সত্যিই তো,ঈশ্বর না করুন,তাঁর ঘরেও তো উমার বয়সীই একটি মেয়ে আছে,আজ যদি তাঁর এ হেন কোনো বিপদ হোতো,তাহলে কি বাল্যসখা সত্য হাত গুটিয়ে বসে থাকতো।না কি রন্জ্ঞন বোস ই এই সমস্ত ঘটনার প্রতিবাদের সম্মুখীন না হয়ে মেরুদন্ডহীনের মতোন পালিয়ে পালিয়ে বাঁচাতো।সত্য তথাপি রন্জ্ঞন কে নীরব থাকতে দেখে বললো,”দ্যাখ রন্জ্ঞু,আমি জানি,তোর মতোন ছেলে ওইসব ডেরায় আগে কখনও যাই নি,শুধু তুই কেন আমিও তো যাই নি।তবুও ছোটো থেকেই আমার মধ্যে একটা প্রতিবাদী স্পৃহা আছে,যেটা তোরও আছে,কিন্তু সুপ্ত অবস্থায়। আমি জানি তুই ভয় পাচ্ছিস।সেরকম যদি হয়,তো আমি তোর উপর কোনো চাপের সৃষ্টি করবো না।তুই ছেড়ে দিই।আমি অন্য কোনো পথ অবলম্বন করবো না হয়।তবুও তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোকে দিয়ে কোনো কাজ করাবো না।”
রন্জ্ঞন বললো,”সত্য তোর এই বন্ধু টা একটু ভীতু হোতে পারে রে,কিন্তু বিশ্বাস কর,অকৃতজ্ঞ আর পিশাচ নয়।আজ আমার বাড়িতেও তো উমারই বয়সী এক ভগিনী আছে।সে যদি এই বিপদের সম্মুখীন হোতো।তাহলে তুই কি পারতিস এত্তো সহজে হাল ছেড়ে দিতে?ছোটো থেকে এই রন্জ্ঞন বোস কে সব্বাই ভীতু,মেরুদণ্ডহীন একজন পুরুষ বলেই জেনে রইলো।কারণ জীবনে কখনও তো কোনো বাস্তবোচিত লড়াইয়ের সম্মুখীন হোতে হয় নি।তাই মেরুদণ্ড টা ঠিক মতোন সোজা হয় নি রে বন্ধু। আজ যখন সুযোগ পেয়েছে রন্জ্ঞন বোস তখন সেও সত্যের কাঁধে কাঁধ রেখে দেখিয়ে দেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কাকে বলে।তুই শুধু বল,আমায় কি করতে হবে।”
সত্য এতোক্ষণে তার বাল্যসখা প্রিয় বন্ধুটিকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বললো,সাবাস!তোর মধ্যে এই সাহস টাই দেখতে চেয়েছিলাম।তুই যে রাজী হয়েছিস।তোর পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন ভাবে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করবি বলেছিস,এতেই আমি ভীষণ আনন্দিত রে।বিশ্বাস কর।”
রন্জ্ঞন উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”
কাজ টা কি তা তো বলবি মরতে।”
সত্যব্রত বললো,”আগে আমি দিনের আলোয় তোকে ওই ডেরা চিনিয়ে দিয়ে আসবো।কারণ ওরা প্রতিদিন ম্যহেফিলের পর একটি মানুষকেই মানে আমাকে যদি প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি মেয়েরই জন্য খরিদ্দার স্বরুপ টাকা দিতে দেখে,তাহলে আমার প্রতি ওদের সন্দেহ টা বেড়ে যাবি।আর আমি যদি না যাই,তাহলে উমার খরিদ্দার অন্য কেউ হলে উমা কে আবার সেই একই অত্যাচারের সম্মুখীন হোতে হবে।যা আমি চাই না।তাই আমি চাই আমরা পালা করে,উমার খরিদ্দার রূপে গিয়ে এবং পরের কয়েকদিন ছদ্মবেশ ধারণ করে সেখানে যাবো।কিছু বেশী অর্থেরও প্রয়োজন।আজ আমিই সেখানে যাবো।কিন্তু তোকে সব আটঘাট বুঝিয়ে দেবো কাল তুই যাবি উমার রক্ষার্থে।আর কি বলবি,কেমন আচরণ করবি,কিভাবে পোষাক পড়বি আর কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবি সব আমিই বলে দেবো।বাড়তি বুদ্ধি খাটাবি না।আর মনে ভয় বা সংকোচ রাখবি না।আবারও সত্য রন্জ্ঞন কে উদ্দেশ্য করে বললো,অর্থের জন্য একটা তার অর্থাৎ পত্র আমাদের বাড়ির ঠিকানা সহযোগে ম্যানেজার বিমল বিশ্বাস মানে বিমল কাকুর কাছে টাকার অঙ্ক টা কষে পাঠিয়ে দিস।কারণ এসমস্ত ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে বেশ ব্যায়বহুল অর্থের প্রয়োজন।বুঝলি?”
রন্জ্ঞন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রদান করলো।তার পর দুজনে ছদ্মবেশে বেশ দূপুর দূপুরই বেরোলো রন্জ্ঞন কে সঠিক জায়গা চেনাতে।
ক্রমশ (চলবে)