কথা দিয়েছিলে ছবি ব্যানার্জী

#ধারাবাহিক উপন্যাস
কথা দিয়েছিলে
ছবি ব্যানার্জী
পর্ব–এক

দ্বৈপায়ন সেদিন অফিস বেরোনোর সময় খুব সামান্য ব্যাপার নিয়ে স্ত্রী তনুকার সংগে একচোট ঝগড়া করে ফেলল।সে এমনিতে খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ।ন বছরের বিবাহিত জীবনে বাচ্চা আসেনি বলে তার কোনো হেলদোল নেই।ওরা দুজনেই অনেক ডাক্তার দেখিয়ে কোনো লাভ হয়নি।ফল্টটা তনুকার হলেও দ্বৈপায়ন সেটা স্ত্রীর কাছে গোপন করেছে।বরং তার বন্ধু ডাক্তারকে দিয়েও বলিয়েছে তাদের দুজনের বাচ্চা ধারণের ও বাচ্চার জন্ম দিতে কোনো অসুবিধা নেই।ন বছরের বিবাহিত জীবন হলেও তনুকার বয়স মাত্র উনত্রিশ।কলেজে পড়তে পড়তেই উদ্দাম প্রেমের জোয়ারে বিয়ে করে আর লেখাপড়া শেষ করে করা হয়নি। দ্বৈপায়ন দুর্গাপুরে স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করে।দেশে বাড়ির অবস্থা বেশ স্বচ্ছল।দ্বৈপায়ন চেয়েছিল তনুকে দুর্গাপুরের কলেজে ভর্তি করে দিতে কিন্তু তনুকা আর কলেজে ভর্তি হতে চায়নি।

প্রথম চার বছর তাদের বিবাহিত জীবন প্রায় ঝড়ের বেগে কেটে গেল।তারপর থেকেই তনু মা হবার জন্য প্রায় পাগলামি শুরু করল।তখন থেকেই ডাক্তার দেখানো চলতে থাকল।দ্বৈপায়ন কিছুদিন পরেই তনুর ফল্ট বুঝতে পেরে তার এক বন্ধু গাইনি ডাক্তারের কাছে আগেই বলে তনুকে শান্ত করেছে।

সেদিন তনু কাজের মাসির সংগে তার কথামতো এক তান্ত্রিকের কাছে যাওয়ার কথা।সে নাকি যাগযজ্ঞ করে, মন্ত্রপূত শিকড় বেঁটে খাইয়ে বহু অলৌকিক কান্ড ঘটিয়েছে।সেই কাজের মাসীর জানা বহু মেয়ের দশ বারো বছর পর ও মা হয়েছে।এর আগে তনু বহু মন্দিরে মানত করে গলায় হাতে কবজ মাদুলি পরেছে।সেটা নিয়ে দ্বৈপায়ন কখনও কিছু বলেনি।তাদের কম্পাউন্ডের ভিতরে সবার গায়ে লাগা একতলা বাংলো টাইপের একতলা বাড়ি।পাশাপাশি বাড়ি থেকে দুটো বছর দুইএর দুরন্ত বাচ্চা প্রতিদিন তনুর কাছে আসে। ওদের মাদের সংগেও তনুর গলায় গলায় ভাব।

ওদের বায়না দুরন্তপনা তনু সামলায়।দ্বৈপায়ন ও খুব খুশি হয় তনু আনন্দে আছে দেখে।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে তনু একটা নিজের বাচ্চার জন্য নিঃশব্দে হাহাকার করে।সেদিন ঐ তান্ত্রিকের কাছে যাওয়া আর শিকড় বাকড় বেঁটে খাওয়ার কথা শুনে দ্বৈপায়ন মেজাজ হারালো।বলল–তনু এবার তোমার পাগলামি কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।এসব কি শুরু করেছো?তুমি কি ভেবেছো এইভাবে তুমি মা হতে পারবে?তনুও সমান মেজাজ দেখিয়ে বলল–তুমি আমার স্বাধীনতায় একদম হাত দেবে না।আমি যাবোই।।নবছর হতে চলল একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারলে না।তোমার মুরোদ আমার জানা আছে।দ্বৈপায়ন মেজাজ হারিয়ে বলে ফেলল–তুমি কোনোদিনই মা হতে পারবে না এটা ডাক্তারের কথা।আমার যথেষ্টই মুরোদ ছিল।বলেই মনে মনে বলল–এটা আমি কি করলাম?কিন্তু তীরের মতো মুখ থেকে তখন কথা খসে গেছে।তাড়াতাড়ি চুপচাপ অফিসে চলে গেল।

অফিসে সেদিন কাজে মন বসাতে পারল না।অনেকটা আগে অফিস থেকে ফিরে এসে তনুকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে গভীর অনুশোচনায় বলল–তনু আমি দুঃখিত।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।তনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–এটা তুমি শুরুতেই জানতে তাই না?– শোনো পৃথিবীতে কি সবার বাচ্চা হয়? কই আমার তো কোনো আফসোস নেই?বিশ্বাস করো আমি তোমাকে বলবার জন্যে সময় নিচ্ছিলাম।ভেবেছিলাম তোমার পরামর্শ নিয়ে একটা বাচ্চা এডপ্ট করব।–তনু বলল–আমিও তোমাকে বাজে কথা বলেছি।হয়তো বাচ্চা না হবার জন্য তোমাকে মনে মনে দোষারোপ করেছি।আমি ও অনুতপ্ত দীপ।

দ্বৈপায়ন বলল–চলো তনু আমরা চার পাঁচদিন দার্জিলিংয়ের কোনো নির্জন গ্রামে বেড়াতে যাই।সেখানে আমরা কটেজে থাকব আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করব ।প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।তনু আমি তোমাকে আমার থেকেও ভালোবাসি। প্লিজ বাস্তবকে মেনে নাও।

ওরা দার্জিলিংয়ের কোনো একটা গ্রামে একটা চমৎকার কটেজে উঠল।কাজগুলো বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ।অনেক দুরে বড় বড় পাহাড়।প্রকৃতি যেন বড় যত্ন করে নিপুন হাতে সবকিছু সাজিয়ে রেখেছে।কটেজের পিছনে ছোট্ট একটু বাগান।তনু বাচ্চা মেয়ের মতো আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠল।বহুদিন পর তনুর আনন্দ আর হাসি দেখে দ্বৈপায়ন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

দুদিন পর খুব ভোরে উঠে তনু বাগানে ঘুরছিল। হঠাৎ একটা ফুলের ঘন ঝোপ থেকে মৃদু একটা কান্নার আওয়াজ কানে এল।প্রথমটায় বাচ্চা কুকুরের শীতে কষ্ট পাওয়ার আওয়াজ মনে হয়েছিল।কাছে যেতেই দেখল ছেঁড়া ন্যাকড়ায় জড়ানো একটা সদ্যোজাত ফুটফুটে বাচ্চা।ন্যাকড়াটা সরিয়ে দেখল মেয়ে।তনু দুহাতে বুকে জড়িয়ে বাচ্চাটাকে ঘরে নিয়ে এসে ঘুমন্ত স্বামীকে জাগিয়ে বলল–এই দীপ ওঠো।দ্যাখো এই বাচ্চাটা পিছনের বাগানে পড়ে ছিল। জানো ওর চারিদিকে কত রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ছিল।মনে হচ্ছিল প্রজাপতিরা ওকে ডানা দিয়ে আগলে রেখেছে।প্রজাপতির আর এক নাম তিতলি।তাই আমার মেয়ের নাম রাখলাম তিতলি।

দ্বৈপায়ন বলল –তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?ওকে এক্ষুনি স্থানীয় থানায় নিয়ে যেতে হবে।তনু বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠে বলল–খবরদার বলছি থানায় যাবে না।ও আমার মেয়ে।ভগবান আমাকে দিয়েছেন।তুমি আজকেই দুর্গাপুর ফিরে যাবে।আমি ওকে নিয়ে কলকাতা বাপের বাড়ি যাব।তুমি ওখানে সবাইকে বলবে তোমার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট ছিল।আমি ঠিক সময়ে ফিরব।দ্বৈপায়ন বল –পাগলামি কোরোনা।তুমি চাইলে এই বাচ্চাকে আইন মেনে দত্তক নেব।–না আমি সবাইকে জানাতে চাই তিতলি আমার গর্ভজাত সন্তান।তুমি আমি আর আমার বাবা মা ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানবে না।তুমি কথা দাও আমাকে।–বেশ কথা দিলাম।কিন্তু ওর বার্থ সার্টিফিকেট? ভেবোনা ওটা আমার বাবা ম্যানেজ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *