” দশমীতে বোধন” কলমে–নীরা

” দশমীতে বোধন”

কলমে–নীরা

দূর্গা পূজোর আর খুব একটা দেরি নেই,সামনের সপ্তাহে তো বিশ্বকর্মাপূজো, তারমানে হাতে গোনা দিন… রাতের নিঃস্তব্ধতায় বারান্দায় বসে সৌমির হঠাৎ ই মনে পড়ে গেলো রাঁচির সেই দিন গুলোর কথা।সেদিন ছিল বিশ্বকর্মা পূজো তখন ও বারো ক্লাসের ছাত্রী,টুবাইদার সাথে হঠাৎ ই খুব ভাব হয়েছে,আসলে টুবাইদা খুব মজার মজার কথা বলে সৌমির খুব ভালো লাগে, বিশ্বকর্মা পূজোর দিন টুবাইদা ওকে বাড়িতে ডাকে….ফাঁকা বাড়িতে দুজনে অনেক মজা করে, বয়স সন্ধির অনাস্বাদিত আনন্দ ও পায়….ও তখন শরীরি ভাষার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতো না ,ফল যা হবার তাই হলো।
জীবনের ঐ অধ্যায়টা কে জীবন থেকে বাদ দেবার জন্য বাড়ির লোকের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে পুরুলিয়ার এক অক্ষ্যাত গ্রামে লোকচক্ষুর অন্তরালে পিসিমার তত্তাবধানে একটি প্রাণ পৃথিবীর আলো দেখলো, কিন্তু মার স্নেহ বঞ্চিত হয়ে সে হারালো জন অরণ্যে।
মা সৌমির শুধু চোখে পড়েছিল বাচ্চার ডান কানের ছোট্টো লতি তে কালো দাগ, ব্যস ঐ পর্যন্ত ই….ওকে জানানো হয়েছিল বাচ্চা মৃত,ছেলে কি মেয়ে তাও ওকে কেউ বলেনি।
এর পর ওর আর রাঁচিতে ফেরা হয়নি, বাবা মা বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে আসেন,এবং সৌমী প্রাইভেটে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়,তারপরে সুপাত্র দেখে মা বাবা ওর বিয়ে দেন আজ প্রায় বারোবছর হলো।
এখনো সন্তানের মুখ দেখেনি সৌমি ,শান্তনু। শান্তনু খুবই উদার মনের মানুষ , নিজের কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকে। তবে সৌমী র একাকিত্বের বেদনা অনুভব করে।সময় পেলে সৌমী কে নিয়ে লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পড়ে।
এর মধ্যেই হঠাৎ শান্তনুর ট্রান্সফার অর্ডার এলো, পোস্টিং রাঁচিতে,খবরটা পেয়ে সৌমী র মনে একটু আনন্দ, কতো দিন পরে রাঁচি যাবে। যদিও ওরা এখন রাঁচি র যেখানে থাকে সেই জায়গা থেকে ওদের আগের বাড়ি অনেকটাই দূরে,তবুও পুরনো জায়গা…
‌‌ এই অফিসের দেওয়া বাংলোটা খুব সুন্দর বাড়ির সামনে বিরাট লন, পরিবেশ টা বেশ ভালো, বাঙালি দের একটা ক্লাব আছে তারা সব পূজো পার্বন করে, নানা রকম অনুষ্ঠান ও হয়। সৌমীর ভালো লাগে, কয়েকজন বন্ধুও হয়েছে।
কিন্তু তবুও আজ ও বিশ্বকর্মা পূজোর দিনে ওর ফেলে আশা অতীত ওকে কুরে কুরে খায়, এক এক সময় ভাবে এই পৃথিবীতে কোথাও তো সে নিশ্চয়ই আছে, কেমন আছে? কোথায় আছে?
এখন যতো দিন যাচ্ছে ‘মা’ ডাক শোনার বাসনা তত ই যেন বাড়ছে। দেখতে দেখতে পূজো এসে গেল, এবারে বেঙ্গলি ক্লাবের পূজোর সেক্রেটারি শান্তনু, ক্লাবের কাজে খুব ব্যস্ত, প্রতি বছর মা দূর্গার কাছে সন্তান কামনায় সন্ধি পূজোর প্রদীপ জ্বালায় সৌমী, এবার ও জ্বালিয়েছে, কিন্তু কই মা তো মুখ তুলে চাইছেন না।
নবমীর দিন ক্লাবে দরিদ্র নারায়ণ সেবা হয়,আর বস্ত্রবিতরণ করা হয়, এবারেও তার আয়োজন হয়েছে, সেক্রেটারি র স্ত্রী হওয়ার জন্য এবার সৌমী র হাত দিয়ে বস্ত্র দেওয়া হবে। সকাল দশটায় অনুষ্ঠান শুরু সেই মতো সব তৈরী, দুশো জন বিভিন্ন বয়সী পুরুষ মহিলা শিশু লাইনে দাঁড়িয়ে,…. একে একে সবার হাতে বস্ত্র তুলে দিচ্ছে সৌমী একেবারে লাইনের শেষে শত ছিন্ন মলিন বস্ত্র এক মহিলা ও একটি বছর পনেরোর মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কর্মকর্তাদের একজন বললেন,”দুজন নয় একজন পাবে ,কে নেবে বলো?”
মহিলা বলে আমায় না ওকে দাও পূজোয় নতুন কাপড় ও পরুক”, মেয়ে বলে ,”না মাকে দাও মায়ের আর এই ছেঁড়া শাড়ি ছাড়া কিছু নেই”এই সব কথার মধ্যে হঠাৎ সৌমী র চোখে পড়লো মেয়েটার কানের লতিতে কালো দাগ ,চমকে উঠলো সৌমী,ভালো করে মুখের দিকে চেয়ে দেখলো মুখটা খুব চেনা লাগছে,…আরে আরে এ তো টুবাইদা র মুখ যেন, সৌমী র মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।নিজেকে কোন রকমে সামলে নিল,ভাবলো তা কিকরে হয়, আজ থেকে পনেরো বছর আগের সেই ঘটনা ঘটেছিল তো পুরুলিয়ার এক গ্রামে আর এতো রাঁচি, কিন্তু তবুও ওর মন খচখচ করছে।ও কায়দা করে বাড়ি যাবার নাম করে ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় ঐ মা আর মেয়ের কে ধরলো।
ওদের নিয়ে একটু দূরে একটা গাছতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মা টির হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে বললো ,”একটা সত্যি কথা আমায় বলবে তুমি?এই মেয়ে কি তোমার পেটের মেয়ে?”ওরা একটু চমকে গেল, মা টি বললো “কেন একথা জিগেস করছো মা?না ও আমার পেটের মেয়ে নয় , কিন্তু ওর মাকে আমি মেয়ের মতো ভালোবাসতাম, কিন্তু সে যে কোথায় হারিয়ে গেল, তার আমানত তার মা বাবা আমার কাছে গচ্ছিত রেখে সেই যে চলে গেল আর কেউ ই ফিরলো না,আমি লোকের বাড়ি কাজ করে ওকে দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়ালাম আর খরচে পারলামনা, এখন আর বেশি কাজ করতে পারিনা ও বস্তির দুচারটে বাচ্চাকে পড়ায় তাই দিয়ে কোন রকমে চলে, কিন্তু তুমি এতো কথা জানতে চাইছো কেন?কে তুমি?”
এবার আর সৌমী র বুঝতে কিছু বাকি থাকলোনা,ভালো করে তাকিয়ে দেখে চিনতে পারলো ওর ছোটবেলার রমা পিসি কে যে ওকে বড় করেছে,এখন এতো দিন পরে ভগ্ন চেহারার রমা পিসিকে তাই প্রথমটা চিনতে পারেনি।
এবার পুরো ঘটনাটা ওর কাছে পরিষ্কার হলো, রমা পিসি বাল্যবিধবা ওদের দেশ তারকেশ্বরে ঠাকুমার কাছে ওর মা কাজ করতো,তারপরে ওরা তখন বাবার কর্মস্থল রাঁচি এলো তখন ঠাকুমার সাথে ও আসে, ততদিনে ওর মা বাবা গত হয়েছেন,তাই ওদের বাড়িতে ই থাকতো, এ সব কথা সৌমী মায়ের মুখে শুনেছে, জন্ম থেকেই ও রমা পিসি র কোলে পিঠে বড় হয়েছে।তারপরে ওর জীবনের অতো বড় বিপর্যয়ের পরে ও আর রমা পিসি কে দেখে নি, বাড়ি বিক্রির পরে মার কাছে শুনেছিল রমা পিসি গ্রামে ফিরে গেছে।
আজ এতো দিন পরে ওর কাছে সবটাই পরিষ্কার… কিন্তু সৌমী কে তো রমা পিসি চিনতে পারেনি, একে বয়স হয়েছে তার ওপর চোখে ছানি, সৌমী আর থাকতে না পেরে নিজের পরিচয় দিয়ে ওদের দুজনকে বাড়ি নিয়ে এলো।রমা পিসি ও এতোদিন পরে সৌমী কে পেয়ে ওর আমানত ওকে দিয়ে ভার মুক্ত হতে চাইলো কিন্তু একটা প্রশ্ন সবার মনেই উঁকি দিলো। শান্তনু কি সৌমী র অতীত জেনে সব মেনে নেবে?
অনেক রাতে শান্তনু বাড়ি ফিরে সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো,কপালে চিন্তার রেখা…রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। ভয়ানক চিন্তায় সৌমী ঘুমতে পারলোনা ,ভোরের দিকে একটু চোখলেগে গিয়েছিল সৌমীর, শান্তনুর ডাকে ঘুম ভাঙতেই শান্তনু এক গাল হেসে সৌমী কে জড়িয়ে ধরে বললো,”দেখলেতো মা দূর্গা আমাদের ইচ্ছে পূরণ করে আমাদের মেয়েকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিলেন,ডাকো আমার মাকে, আর আজ থেকে রমা পিসি আমাদের সংগেই থাকবেন” শান্তনুর এই সিদ্ধান্তে সৌমী আনন্দে কেঁদে ফেললো, ছুটে গিয়ে মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে শান্তনুর কাছে নিয়ে এলো… দশমী র সকালে চারজন সেজেগুজে ক্লাবে গিয়ে মাদূর্গাকে প্রণাম করে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পাবার গল্প বললো সবাইকে… দশমী তে মায়ের বিসর্জনের মধ্যে বিদায়ী সুরের বদলে আনন্দধারা বেজে উঠলো…

(কলমে–নীরা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *