# কান্নাহাসির দোলদোলানো ——- মহুয়া বৈদ্য

# কান্নাহাসির দোলদোলানো / মহুয়া বৈদ্য

১.

গান নিয়ে কিছু কথা লেখার ইচ্ছে হল। তেতাল্লিশ বছরের জীবনে, অনেকটাই জুড়ে বসে আছে গানের চর্চা। ক্লাস টু থেকে অনার্সের প্রথম বর্ষ, টানা ১১ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে গানের মধ্যে ডুবে ছিলাম একরকম। একটু বড় হওয়ার পর আমার কোনো বন্ধু ছিল না, খেলতে যাওয়া ছিল না। স্কুল–গল্পের বই–পড়ার বই–গান… এইই ছিল আমার জগৎ। বোনের সাথে টুকটাক খেলাধুলো চলত অবশ্য, পুতুল খেলাই খেলতাম তখন। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর মা একদিন টান মেরে পুতুলের বাক্স ফেলে দিলেন, বললেন যথেষ্ট বড় হয়েছ, আর পুতুল খেলা নয়। খুব দুঃখ হয়েছিল। আমার সাজানো পুতুলের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেল, পুতুলদের জন্য বানানো গয়না জামাকাপড় এদিক ওদিক ধুলোয় লুটোপুটি খেতে লাগলো। কিন্তু জীবনে যা কিছু ঘটে মঙ্গলের জন্য। পুতুল খেলার ঘর ভেঙে যেতে আমি আঁকড়ে ধরলাম গান আর গল্পের বইকে। দুটি জায়গাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার প্রিয় হয়ে উঠল –” কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে”। গোটা স্কুলজীবন এইগুলি নিয়েই ভরে ছিলাম, কোথাও কিছু কম পড়েছে এমন মনে হত না। মনে পড়ে ক্লাস সেভেনে স্কুল ছুটি হওয়ামাত্র ছুটে বেরিয়ে এসে অটোতে বসতাম, কারণ ভিড় বেড়ে গেলে অটো পাবো না, আর বিকেলে হারমোনিয়াম এর সাথে বসতে দেরী হয়ে যাবে। স্কুলের ছুটির দিনগুলিতে সারাদুপুর আমি আর হারমোনিয়াম… এমনি চলেছে,মনে পড়ে। সেই গানের সাথেও সুদীর্ঘ ১২ বছরের ছেদ পড়েছিল। কি করে বেঁচে ছিলাম কে জানে! মনের গতি আসলে খুবই বিচিত্র। তারপর একরকম জোর করে গানে ফেরা…পুরোনো বন্ধুর কাছে ফেরা …” বন্ধু কী খবর বল! কতদিন দেখা হয় নি!” এই চড়াই-উৎরাই এর গল্প কম নয়! মাঝের যে সুদীর্ঘ সময় আমি নিজেকে ভালোবাসিনি, গানকে, পড়াশুনাকে ভুলে ছিলাম, আজ এখন নিজেকে তার জন্য ক্ষমা করতে পারি না। এই বিশ্রী যাপনের জন্য আমি শুধুমাত্র নিজেকেই দায়ী করি, হ্যাঁ, আমি ই দায়ী। তবে এ ও বিশ্বাস করি, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। সবকিছুই হয়তো আলো হয়ে বসে থাকে জীবনের অভিজ্ঞতায়।

একেবারে শুরুর কথায় চলে যাই।
তখন আমাদের সবে নতুন বাড়িটুকু হয়েছে, বারুইপুরের নবীন চন্দ্র রোডে। বাড়ি করতে গিয়ে মা- বাপির বেশ কিছু দেনা হয়ে গেল। মা এর মাইনে হওয়ামাত্র পাওনাদারদের বকেয়া টাকা কিস্তিতে শোধ দেওয়া হত। তারপর বেশ টেনেটুনেই দিন যেত। আমার বাবা পেশায় উকিল হলেও রোজগারের ব্যাপারে খুবই উদাসীন ছিলেন। এরই মধ্যে আমার মা কলকাতায় গিয়ে হারমোনিয়াম আনলেন। সঙ্গে ছিলেন বাবা, পাড়াতুতো ভারতীমাসি আর আমার প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক শ্রদ্ধেয় চঞ্চল প্রামাণিক। তখন আমার ক্লাস টু।

আমার মায়ের গান শেখবার খুব ইচ্ছে ছিল। আমার দাদুকে বারবার বলেও, তাঁর সে ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। গানের ব্যাপারে দাদুর বক্তব্য ছিল, গান মানেই শুধু “তুমি-আমি আর আমি-তুমি”। এর বাইরে কোনো কথা দাদু গানে শুনতে পেতেন না! সুতরাং মেয়েকে তিনি কিছুতেই প্রেমের বন্যায় বয়ে যেতে দিলেন না।
বিয়ের পর একবার মায়ের গান শেখবার সমস্ত বন্দোবস্ত হয়েছিল। হারমোনিয়াম কেনা হবে, এমন সময় বাপি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হারমোনিয়ামের টাকায় তখন বাপির চিকিৎসা চলল। এরপর আর মা গান শেখার উদ্যোগ নেন নি, তাঁর স্বপ্ন তিঁনি আমার মধ্যে দিয়েই পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন।

আমার বাপির ঠাকুর্দা সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ ছিলেন। বাড়িতে কলের গান ছিল। গানের চর্চা হত। একটি জার্মান রিডের হারমোনিয়াম ছিল, যেটিকে আমার মদ্যপ ঠাকুর্দা পরে বেচে দেন। ফলে বাপি কখনোই গান শেখেন নি। তবে দরাজ গলায় বাপির গান আমরা দুবোন ছোটবেলায় খুবই শুনেছি।

সুতরাং, আমার গান শুরু হল এমন পরিবেশে, যেখানে সুরের প্রতি সকলের ভালোবাসা আছে, কিন্তু হারমোনিয়াম কেউ বাজাতে পারেন না।

মা-বাপির সঙ্গীত প্রীতির জন্য বাড়িতে খুবই রেডিও বাজত। বিবিধ ভারতীর সকাল-সন্ধ্যার বাংলা গানের অনুষ্ঠান বাজেনি এমন কোনো দিন আমার মনে পড়ে না। মায়ের পছন্দের তালিকায় ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মান্না দে,হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর হ্যাঁ, প্রতিমা বড়ুয়ার লোকগান মা খুব শুনতেন। রবীন্দ্রসংগীতও বাজত কোনো কোনো দিন, কলকাতা ক তে।

একেবারে ছোটবেলায় কিছু কিছু গান শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছিল। ” আয় খুকু আয়”, “পালকীর গান” খুব গেয়ে বেড়াতাম মনে পড়ে। রেডিও নিয়ে নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারা পৃথিবীর গান শোনা খুব আমোদের ব্যাপার ছিল। এইরকম গান শুনতে শুনতে হঠাৎ আমি একদিন সারাদিন গেয়ে চললাম ” সে তো পাইলো টিকা টিনা দিতে তার পৈতা”। এই অদ্ভুত শব্দবন্ধ কোন ভাষার রেডিও স্টেশন থেকে পেয়েছিলাম তা জানি না। এমন কি গানটির অই একলাইনের সুর ও আমার এখনো মনে আছে। সবাই হেসে গড়াগড়ি খেল, কিন্তু আমি সেই গান গাওয়া থামালাম না।

রেডিও ব্যাপারটাই ছিল আমার কাছে তুমুল বিস্ময়ের। খুদি খুদি হাত দিয়ে রেডিওর পিছনের নব খুলে ফেলে অবাক হয়ে ওর ভিতরের বোর্ডের সজ্জা দেখতাম। বাপি রেডিও স্টেশনের গল্প বলত। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম কি করে এত কথা গান এসব আমার কাছে চলে আসে! রেডিও বোর্ডের ভিতর ছোট্ট ছোট্ট লুডোর ছক্কার মতো বাক্সে লিলিপুটের মতো লোকজন ঢুকে বসে আছে, এই ভাবনা খুব আনন্দ দিত। অলস দুপুরে আমার এই কল্পনা পাখা মেলে দিত। ভাবতাম, বাক্স ভেঙে লিলিপুটের মতো মানুষ পেলে তাদের নিয়ে বেশ পুতুল খেলা যাবে।

মায়ের প্রথম স্কুলের চাকরি হয় চাম্পাহাটির ভিতরের দিকে। তখন শুধুমাত্র একটিই বাস সার্ভিস ছিল, ৯৭-এ, যাতায়াতের খুব সমস্যা ছিল। এসময় আমি বড়মাসি র কাছে দুপুরবেলা থাকতাম। বড়দিদি, শিখাদি তখন তানপুরা বাজিয়ে রেওয়াজ করত আর টমি দাদা তবলা বাজাত। দুটিই খুব ভালোলাগার ব্যাপার ছিল মনে পড়ে। অন্য কুচোরা গানের সময় জ্বালায় বলে বসতে পেত না, কিন্তু আমি থাকতে পারতাম, কারণ চুপ করে শুনতাম। সন্ধেবেলা বাপি সাইকেল নিয়ে আসত বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। সাইকেলের সামনে একটা ছোট সিটে আমি বসতাম আর বাপি সাইকেল চালালেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বাপি আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য আইপিটিএ র গান এবং অন্যান্য বৈপ্লবিক গান জোরগলায় গাইতে থাকত। ” উড়া রে উর্দ্ধে লাল নিশান, বাজা রে ডঙ্কা বাজা বিষান” মুখস্থ হয়ে গেছিল। বিশেষত ” জাগ জাগ জাগ তোরা জাগ” বার বার রিপিট করত বাপি, আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য হয়ত। আরো গাইত” হেই সামালো ধান হো, কাস্তে তে দাও শান হো”। গাইত,” কমরেড লেলিনের আহ্বান, চলে মুক্তিসেনা দল”, গাইত, ” হৌ হৌ হৌ হৌ অস্তপারে অই দেখা যায় সৈনিকেই বউ” আর
” ইন্টারন্যাশনাল” তো অবশ্যই। ” কারার ওই লৌহকপাট ” ও শুনেছি বাপির গলায়। কোনোদিন গান না শেখা বাপির গলা তখন ছিল খুব ভরাট এবং দরদী। কিন্তু এত দীপ্ত গানও আমায় তখন জাগিয়ে রাখতে পারত না। আমি যথারীতি ঘুমিয়ে যেতাম,আমার পা ঝুলে যেত এবং সেই পা সাইকেলের স্পোকে ঢুকে রক্তারক্তি কান্ড হত। চার থেকে পাঁচ বার এমন কাটাকুটি হয়েছে, তার মধ্যে একবার পা ফালা হয়ে চার পাঁচখানা সেলাই পড়েছিল।

গানের কথায় ফিরি। মা কলকাতা থেকে এত বড় একটা কালো বাক্স করে হারমোনিয়াম নিয়ে ফিরল। শুনলাম, ফেরার পথে কলকাতা থেকে টানা ট্যাক্সি করে ফিরেছে। মায়ের আমাকে গান শেখানোর ইচ্ছে যে কতখানি প্রবল ছিল এই ঘটনা থেকে বুঝতে পারি। সেই সময় অত টানাটানির সংসারে তিনি এতগুলি টাকা নির্দ্বিধায় খরচ করেছিলেন।
কালো বাক্স এনে তক্তপোশের উপর রাখা হল। ডালা খুলতেই দেখি ঝকঝকে নতুন হারমোনিয়াম, তার গা থেকে ভুরভুর করে পালিশের গন্ধ বেরোচ্ছে। আলতো করে একবার ছুঁয়ে দেখলাম, গন্ধে বর্ণে আবেশে সেই মুহূর্তে খুব ভালোবেসে ফেললাম তাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *