শিউলি ঝরা শৈশব —- সোমা রায়

শিউলি ঝরা শৈশব
সোমা রায়

বাগানে নেমে প্রত্যয় ছবি তুলছিল। প্রতিটি দিক প্রতিটি কোণ। যেন কোথাও এতটুকুও দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়। এখনও দোতলার ছবিগুলো নিতে পারেনি কারণ চাবি ওর কাছে নেই। রয়েছে মামার কাছে। ওরা এলে তবেই যেতে পারবে।
ও দেখল বাগানের দক্ষিণপূর্ব কোনের শিউলিগাছটা গোটা জায়গা জুড়ে যেন সাদা ফুলের চাদর বিছিয়ে রেখেছে। বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠল। দিদু ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সাদা খোলের তাঁতের শাড়ি পরে একটা একটা করে ফুল কুড়িয়ে ঝুড়ি ভর্তি করে ফেলত। প্রত্যয়ও ঠিক উঠে যেত। তখন কতই বা বয়স ওর! ছয় সাত বছর। ও-ও হাত ধুয়ে ফুল কুড়তে শুরু করত। সে যে কী আনন্দ! দিদুর গায়ের মিষ্টি গন্ধ, জর্দাপানের গন্ধ আর ফুলের গন্ধ মিলেমিশে একটা অন্যরকম আবেশ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। তলার ফুল কুড়নো হয়ে যেতেই প্রত্যয় ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে দিদুর সাথে গাছ ঝাঁকাত। বরফের কুচির মত ফুল ঝরে পড়ত ওর চুলে চোখে সারা গায়ে।


শিউরে উঠল প্রত্যয়। চোখটা জ্বালা করে উঠতেই চোখ ঘোরাল বাগানের পশ্চিমে। লেবুগাছটা এখনও আছে। বড় বড় গন্ধরাজ লেবু। দিদু ডাল দিয়ে ভাত মাখত ওই লেবুর রস দিয়ে। তারপর কুরকুরে আলুভাজা দিয়ে খাইয়ে দিত ওকে। ওটা এখনও প্রত্যয়ের প্রিয় খাবার। মামাবাড়ি এলেই ওর সব দায়িত্ব দিদুর। মা তখন ছোট্ট মেয়ে।
“পাপুন”
চমকে ফিরে তাকাল প্রত্যয়। বাবা।
“শোন। পুরোটা ভিডিও করে নে না! খুব ভাল হবে তাহলে।”
“মা বলেছে সব জায়গার ছবি নিতে। একটা কোণও যেন বাদ না যায়!”
“বাইরে থেকে বাড়িটার ছবি নিয়েছিস তো!”
“নিয়েছি।”
ক্যামেরায় চোখ রেখে এবার বাগানের মাঝখানে চলে এল। বড় আমগাছ কাঁঠালগাছ আর নারকেলগাছের ছবি নিতেই বাবার কথাটা মনে হল। বাবা ঠিক বলেছে। ছবি তো প্রচুর নিল। এবার ভিডিও করলে হয়! সবটা একসাথে নেওয়া যাবে। ও চটপট শুরু করল। বাহ! দারুণ আসছে। বাবাকে সুদ্ধ ভিডিও করে নিল। বাবা লাল সিমেন্টের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে। ওকে হাত দেখাল। চা খাচ্ছে। নিচের ভাড়াটে জেঠি চা করেছে। দুপুরেও ওরাই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।


“পাপুসোনা চলে এসো। একটু মিষ্টিমুখ করো।”
জেঠি ডাকতেই প্রত্যয় পা বাড়াল। মেঝেতে পাতা আসনে বসতেই এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি বড় বড় রাজভোগ আর কালাকাঁদ। পাশে দুটো মুচমুচে আলুর চপ। জেঠির ব্যবহারে ওর দিদুর আদল। দিদু ওকে পাপুসোনা ডাকত।
মিতুদিদিও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, “পাপুসোনা কত বড় হয়ে গেছে! তবে একদম ছোড়দির মুখটা কেটে বসানো। তোমার এবার কোন ক্লাস হল?”
“ইঞ্জিনিয়ারিং লাস্ট ইয়ার।”
“ওরে ব্বাবা! সেই ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ার!”
জেঠি বলল, “দিন কী বসে থাকে! দশটা বছর কী কম!”
“মারা এখনও এল না!”
বাবা বলল, “সই সাবুদ ছাড়া আরও ফর্মালিটিজ আছে। একটু সময় তো লাগবেই। চলে আসবে।”
জেঠি বলল, “পাপুসোনা, দাদু দিদু না থাকলেও আমরা তো আছি। যখন খুশি বাবা মাকে নিয়ে চলে আসবে। থাকবে। এ বাড়ি তোমাদেরই জানবে, কেমন!”
হাসল প্রত্যয়। মায়ের কথাটা মনে পড়ে গেল। সকালে গাড়িতে আসার সময় মা বলছিল আপনমনে, “এই শেষবার, যাব নিজের বাড়িতে। তারপর আর ওটা নিজের বাড়ি থাকবে না। যত ভাল ব্যবহার করুক আর ভালবাসুক, ‘আমার’ এই বোধটা আর থাকবে না। একটা ফুল বা ফল পাড়তে গেলেও ইতস্তত লাগবে।”
খাবার শেষ করে প্রত্যয় আবার মোবাইলে ছবি তূলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওপাশে পুঁইমাচা থেকে লকলকে ডগাগুলো চকচক করছে। মা মাসিমনির খুব প্রিয়। ও চটপট ছবি নিয়ে নিল। তারপর কাঁঠালগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াল। কী বিশাল! মনে মায়ের মুখে শোনা ওদের প্রিয় কুকুর ঝাম্পির কথা,
“জানিস পাপু, ঝাম্পির অভিমান হলেই কাঁঠালগাছের তলায় গিয়ে বসে থাকত। আমরা কত ডাকাডাকি করতাম কিন্তু কিছুতেই আসত না। শেষে দাদা গিয়ে ওই পালোয়ানকে কোলে করে নিয়ে আসত।”

(২)
(২)
মা এসেই বাগানে নেমে পড়ল। মামা মাসি আছে বলে, নইলে প্রত্যয় নিশ্চিত, মা কেঁদে ভাসাত। যা ভেবেছে তাই, প্রথমেই গেল শিউলিতলায়। কুড়িয়ে গন্ধ নিচ্ছে। মাসিমনিও নেমে গেল। সব গাছে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। এবার আমগাছের তলায় দাঁড়িয়েছে। চট করে প্রত্যয় নেমে এল, “দাঁড়াও দাঁড়াও। মাসিমনি আর তুমি দুজনে ডালটা ধর তো।”
ছবি তুলে নিল। মামাও নেমে পড়ল। দুই বোনকে দুপাশে নিয়ে ছবি নিতে বলল কাঁঠালতলায়। সবুজে সবুজ চারপাশ। এত সুন্দর ছবি উঠছে! প্রত্যয় তিনতলা বাড়িসুদ্ধ তিন ভাইবোনের ছবি তুলল। ওয়াও! দারুণ!
মামা বলল, “সব ছবি পাঠাবি পাপুন, আমার হোয়াটস অ্যাপে।”
ওদিকে জেঠুও মিষ্টির থালা নিয়ে দৌড়ে এলেন। নিজে হাতে তিন ভাইবোনকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন। বোঝাই যাচ্ছে জেঠুর খুব আনন্দ এতদিনে বাড়িটার মালিকানা পেয়ে। বলতে গেলে জলের দরে বাড়িটা পেয়ে গেলেন। আপাত সৌম্য স্নিগ্ধ মানুষটি কিন্তু সাংঘাতিক বুদ্ধি ধরেন। যাক, ভালই হয়েছে। অন্য কাউকে বিক্রি করলে হয়ত আর কোনদিনও মাদের আসা হত না। জেঠু জেঠি থাকলে ওরা অন্তত আবার আসার কথা ভাবতে তো পারবে!
“এবার চল সব উপরে। পাপুন আয়।”
দাদু চলে যাবার পর একে একে দশটা বছর কেটে গেছে। তারও চারবছর আগে দিদু চলে গেছে। এই দশ বছরে মামা দু একবার গেলেও মা বা মাসিমনি কেউ যায়নি। আশ্চর্য না! প্রত্যয় কতবার বলেছে, “চল না মা!”
মা বলেছে, “কার কাছে যাব? ও বাড়িতে আমি একা একা ঢুকতে পারব না।”
“তাহলে বল না মামা মাসিমনিকে! সবাই মিলে চল।”
কতবার প্ল্যান হয়েছে কিন্তু একসাথে কারও সময় হয়নি। সবাই কাজকর্ম স্কুল কলেজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর বড় ছুটি মানেই পাহাড় সমুদ্রে দৌড়নো। মাদেরও বিশ্রাম মেলে। ফলে যা হয়!
উঃ! কী ঝুল আর ধুলো! প্রত্যয় মাস্ক পরে নিল। ওর ধুলোয় অ্যালার্জি। জেঠু, মিতুদিদি, দিদির বর আর পুচকি মেয়েটাও হাজির। মা প্রথমেই অ্যালবামগুলো বের করল। তারপর চলে গেল বই বাছতে। অজস্র বই। সব দিদুর কেনা। দিদুর মত মাও বইপাগল। মাসিমনিও।
প্রত্যয় অবাক হয়ে প্রতিটা ছবি নেওয়ার সাথে সাথে দেখছিল ঘরগুলো একইরকম আছে। অথচ মানুষগুলো নেই। দুটো মানুষ না থাকায় এতজন সত্ত্বেও সব কেমন খাঁখাঁ করছে। ও এঘর ওঘর ঘুরতে ঘুরতে একসময় বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ বুঝতে পারছে মা কেন আসেনি এতদিন। অসহ্য লাগছে। মা বই নিয়ে ব্যস্ত আছে, ভাল হয়েছে। নইলে কান্নাকাটি শুরু করে দিত।
হঠাৎ পিঠে হাত পড়তেই চমকে তাকাল। মা। ও মাকে জড়িয়ে ধরল। পিছন পিছন মামা মাসিমনিও এসেছে। তিন ভাইবোন একসাথে জড়িয়ে ধরল প্রত্যয়কে।

(৩)
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে তিনটে বেজে গেল। মিতুদিদি মাংসটা কী রান্না করেছে! দারুণ। আর খেতে বসে ও হতবাক হয়ে গেল ডাল আলুভাজা আর গন্ধরাজ লেবু দেখে। গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাকে জোর করে ফিরিয়ে দিল বুকের মধ্যে। মারাও শান্ত হয়ে খেতে বসেছে। খাবার মুখে দিতেই মন ভাল হয়ে গেল। আর এতক্ষণের খিদেটাও মাথা চাড়া দিয়েছে। জেঠু আবার মিষ্টি দইও এনেছেন। মাদের প্রিয়।
কল পাম্প করে হাত ধুতে গিয়ে মনে পড়ল গরমকালে সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে এই কলের জলে গা ধোয়ার কথা। দাদু পাম্প করত আর পাথরের মত ঠাণ্ডা জল উঠত। কী আরাম! কী আরাম!
মা হাত ধুয়ে দৌড়ল পুঁইমাচার দিকে। প্রত্যয় চেঁচাল, “কী হল?”
“নিয়ে যাব।” মায়ের চোখে ছেলেমানুষি।
জেঠু দৌড়লেন ছুরি নিয়ে। মোটা মোটা পুঁইডাটা দিয়ে দিলেন বড় ব্যাগে। দিলেন নারকেলও।
বেরোবার আগেই পাশের বাড়ির সবাই এল দেখা করতে। হল আরেক প্রস্থ জড়াজড়ি। সবাই বলছে থেকে যেতে। জানে প্রত্যয়, শুনতে সত্যিই ভাললাগে। কিন্তু আবার কবে সেই দিন আসবে কে জানে! আদৌ আসবে কী!
সবার কথার মাঝখানে প্রত্যয় নিঃশব্দে চলে এল তিনতলায়। তিনতলায় একটাই বড় ঘর। তারপর গোটা ছাদ। ওহ! এত আলো, এত বাতাস আর এতটা আকাশ ও কোথাও দেখেনি। ওর খুব খুব খুব প্রিয় জায়গা। ও দেখল ছাদের আলসেতে বড় বড় গাছ গজিয়েছে।
মনে পড়ল, এই ছাদে মাদুর পেতে ওকে নিয়ে শুয়ে শুয়ে দিদু চেনাত কালপুরুষ ধ্রুবতারা সপ্তর্ষিমণ্ডল। বলত, “জানিস পাপুসোনা, আমি না কোনদিন ছাদে ঘুমতে পারিনা।”
“কেন দিদু?”
“মনে হয়, গোটা আকাশটা যেন আমাকে গ্রাস করে নেবে। মনে হয়, গোটা আকাশটা যেন আস্তে আস্তে নেমে আসছে আমার উপরে।”
বুঝতে পারত না তখন প্রত্যয়। কখন যেন ঘুমের রাজ্যে চলে যেত। ও আকাশের দিকে তাকাল। না। নারকেল গাছগুলো উঁচু হয়ে দক্ষিণের অনেকটা আকাশ ঢেকে ফেলেছে। ঠিক। ও জানে আর কোনদিনও ওর গোটা আকাশ দেখা হবেনা। কারণ ওর গোটা আকাশ ও দেখেছিল দিদুর চোখ দিয়ে। দিদুর সাথে সাথে ওর আকাশটাও হারিয়ে গেছে। এখন চারদিকে এখন বুক খাঁখাঁ করা এক দমবন্ধ পরিবেশ।
“পাপুন পাপুন!”
কে! কে ডাকছে!
“তুই এখানে? সবাই তোকে খুঁজছে। বলবি তো! চল চল। বেরতে হবে।”
আবারও চমকে উঠল। বেরবে! আর আসবে না! কে জানে! ও বাবার পিছন পিছন নেমে এল মুখ কালো করে। নামতেই মা দৌড়ে এল, “ছাদে গিয়েছিলি, বললি না! আমিও যেতাম।”
প্রত্যয় কোনরকমে বলল, “আর যেতে হবে না। খুব নোংরা হয়ে আছে।”
“তাই! কতদিন আকাশটা দেখিনি!”
ধক করে উঠল বুকটা। ঠিক বলেছে মা। সত্যিই কোলকাতায় এমনভাবে আকাশ দেখা যায় না।
“দাদা। এবার না বেরলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।” ড্রাইভার তাড়া লাগাল। ও-ও অবাক এত সুন্দর বাড়ি দেখে। বলল, “কী দারুণ বাড়ি দাদা! বিক্রি করে দিলেন! রাখলে মাঝে মাঝে এসে থাকতে পারতেন।”
বাবা বলল, “ওদের বাড়ি, আমি কী বলব বল! আমারও খুব ভাল লাগত বাড়িটা।”
প্রত্যয় জানে বাবা ঠিক বলেছে। কিন্তু সত্যিই অত দূর থেকে এত বড় বাড়ি দেখাশুনো করা সম্ভব না। এরপর সবার বয়স বাড়লে আরও অসম্ভব। কিন্তু থাকলে ওর চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হত না।
আবার চমকে উঠল। তাই ক কী! যদি ধরেও নেয় এ বাড়ি থাকল কিন্তু সবাই একসাথে আসতে পারবে এমন তো নাও হতে পারে! এতদিন যা দেখেছে তাতে প্রত্যয় এটা বুঝে গেছে যে সবার একসাথে আসা অসম্ভব। তাহলে এই দশ বছরে সেটা হত। ধরে নিল ও বাবা মা এল। কিন্তু ওই খাঁখাঁ ঘরে ও কী টিকতে পারত! যার পরতে পরতে দাদু দিদুর স্মৃতি! প্রতিটি ক্ষণে বুঝিয়ে দিত নেই নেই নেই। কোথাও নেই।
“পাপুন” মায়ের বিহ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে ও নিজের সম্বিত যেন ফিরে পেল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চল।”
স্পষ্ট দেখল মায়ের চোখ আস্তে আস্তে জলে ভরে উঠছে। ও আর সময় নিল না। চটপট মাকে গাড়িতে বসিয়ে পাশে বসে পড়ল। মাসিমনিও অন্য গাড়িতে বসে। যাবে মালদা। মামা ওদের সাথেই ফিরবে।
আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে মামাবাড়ি। আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে শৈশব। দাদু দিদুর স্নেহমাখানো দুটি চোখ। হঠাৎ প্রত্যয়ের মনে হল, গোটা বাড়িটা যেন একরাশ অভিমান নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। ও জলভরা চোখদুটো ফিরিয়ে নিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *