শুধুই কি কইমাছের প্রাণ? কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়।

#শুধুই কি কইমাছের প্রাণ?

কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়।

আমি রমা। আমার বয়স এখন পঁচিশ। শিক্ষিকা। উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। গঠন সুন্দর। রঙ শ্যামলা।

না, না পাত্র চাই না। এমনি বললাম,সব কিছুরই তো শুরু থাকে, এটা সেই রকম।
এখানে জাত,গণ,রাশি কিছু বলি নি। গৃহকাজে নিপুনা বলি নি । অবশ্য বলার দরকার নেই ,ঐ যে চাকুরীরতা । এখন চাকুরীরতা মেয়ের হেভি ডিম্যান্ড। ঐটাতেই সব ঢাকা।
তবুও আর একটা কথা বলি ,সকলে বলে আমার মুখটা খুব মিষ্টি, হ্যাঁ, খুব সুইট,নাক টিকালো নয়,খাঁদা,চোখ পটলচেরা নয় ,তবে চোখের দৃষ্টি বেশ বুদ্ধিদীপ্তা।
আমার মেজকাকি তো সবসময় বলেই ফেলে,রমা ভারী মিষ্টি দেখতে,এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যাবে। ছোট থেকেই কাকির কাছ থেকে শুনছি।
বেশ ভালই লাগতো , মনে মনে মিঠা মিঠা হাসতাম। ভাবতাম ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্তুর আসবে।

তা এখন তো জানে না , সেই স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত কত ছেলের চাউনি আমার দিকে। বেশ সুনজর। রাজপুত্তুর পরে আসুক । লাইফটা তো এনজয় করি।
তা ধান ভানতে শিবের গীত গাইবো না। বেশী কথায় নাই কাজ । বেশী কথা ভালো না।

তা বলছিলাম কি, ছোটোবেলাতে মানে এই ছয় দিন বয়স যখন , তখন আমাকে পেঁচো ভূতে পেয়েছিল।মা বলে, গল্পটা।

না, না, গল্প নয়। একেবারে সত্যি।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে আমাদের গ্রাম। প্রত্যন্ত গ্রাম । কাছাকাছি বাস স্টপেজ আসতে পায়ে হেঁটে পঁয়তাল্লিশ মিনিট । পাক্কা দুই মাইল।
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা বলছি।
আমাকে কিনা ছয় দিন বয়সেই ভূতে ধরেছিল।
ভূতদের ছোট বাচ্চা, বিশেষ করে আঁতুড়ের বাচ্ছা দের খুব পছন্দ। কচি কচি তো সব। তো ঐ কাটোয়া হাসপাতাল থেকে প্রথমে ট্রেন তারপর ডুলি । ডুলি করে একেবারে ঘরে।
বাড়িতে কান্না আমার থামে না।সকলে বলছে আমার হার্ট খুব ভালো। এতো গলার জোর!

টানা দুই দিন কেঁদেই চলেছি। মায়ের দুধ মুখে নিতে পারছি না। ভারী দুধ।ভারী তো হবেই, আমি তো টানছি না।
দিদা বলছে ডুলিতে আসার সময় কেউ ধরেছে। ধরেছে তো বটেই। তা না হলে মেয়ের কান্না থামে না?
ডাকা হোক,হরিহর রোজাকে। একটু মন্ত্র বলে ঝেরে দেবে। একটু মন্ত্র পড়া জল ছিটিয়ে দেওয়া হোক।

সব হলো। হরিহর রোজা এলেন। অনেক মন্ত্র বলে চলে গেলেন ,আর চলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, কোনো ভয় নেই। ধারে কাছে কেউ ঘেঁসতে পারবে না ।

মা কাঁদছে। মেয়ের কান্না থামে না। মেয়ে কিছু খায় না। বুক ব্যাথায় টনটন করছে।
পাশের বাড়ির পিসিমা এসব ব্যাপারে একটু আধটু জানে। লোকে জানুনি শুনুনী মেয়ে বলে একটু সমীহ করে চলে ।
পিসিমা এলো। মা বলে , মায়ের বুক থেকে গরম জলের সেক দিয়ে দুধ বার করে। দুধ নরম হয়। তবুও আমি দুধ খাই না।
কান্নার শব্দ শক্তি হারিয়ে ক্ষীণ হয়ে আসছে। আর কাঁদা যাচ্ছে না।
সকলে মিলে ,মানে এই মেয়ে মহলে শুরু হয়ে গেছে কানাকানি, চুপি চুপি বার্তা। এ মেয়ে আর বেশীক্ষণ নেই। মা’কে শোনানো যাবে না। হাজার হোক মা তো! যত ছোটই হোক না কেন।

মামার ছেলে আমার থেকে ছয় মাসের বড়ো। তাকে খুব সাবধানে রাখা হয়েছে।
হঠাৎ মামী ভাবে ,তার দুধ খায় কিনা দেখা যাক।
ছয়মাসের ছেলে তার মায়ের দুধ খেয়ে বেশ নরম করে দিয়েছে।
মামীর দুধ এই বাচ্ছা মেয়েটি টানতে শুরু করে। দু’দিন ধরে অভুক্ত, ক্ষুধার্ত শিশু। সে কী টান! মামীর তো ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা। সত্যিই এ মেয়েকে
ভূতে পেয়েছে। ছয়মাসের ছেলে যা না টানে এতো তার তিন গুণ বেশি টানছে।
মেয়ের কান্না আরো জোরালো হলো।
বাড়ি শুদ্ধ লোক ভয়ে কাঁটা। সকল গুণিন , ব্যর্থ।

প্রহর গোনা শুরু। কাউন্ট ডাউন। কিছু করার নেই।

হঠাৎ বাড়িতে মামা হাজির। অফিস ছুটি। মেয়ে মহলের কথা শুনে তো ‘থ’।
রীতিমতো অবাক! বকাবকি করছে সকলকে।
মেয়ে বলে , মেরে দিতে চাইছে সকলে ? ধিক, মেয়ে মহলকে!

কলকাতা থেকে সেই প্রত্যন্ত গ্রামে এসে,এই কথা শুনে , কোনো কথায় কান না দিয়ে গরুর গাড়ির সন্ধানে বেরিয়ে যায়। মিনিট দশেকের মধ্যে ঐ আঁতুড়ের মেয়েকে নিয়ে চলে যায়,গরুর গাড়িতে।
নিকটবর্তী স্টেশন পাঁচুন্দী থেকে কাটোয়া শহর । সোজা চাইল্ড স্পেশালিস্ট এর কাছে।

তিনি মাকে খুব বকলেন। বললেন, লেখাপড়ার সার্টিফিকেট গুলো বাড়ি গিয়ে পুড়িয়ে দিতে।
এ-তো আধমরা করে নিয়ে এসেছেন। বাঁচাতে না পারলে তো আমাকেই মারবেন ?
যতোসব।

কি আর বলবেন, বিড়বিড় করে গালাগালি দিচ্ছেন । জোরে তো আর দিতে পারেন না।

কিচ্ছু না, তেমন কিছুই হয়নি। সামান্য নাভির কাছে একটু ইনফেকশন। একটা ওষুধ নিয়মিত লাগালেই ভালো হয়ে যাবে। অথচ আর একদিন দেরি করলে
বাঁচানো যেতো না, এতোটাই ওঝা,গুণিন ডেকে কেস ক্রিটিক্যাল করা হয়ে গেছে।

মা কাঁদছে, মামা জোর হাত করে রিকোয়েস্ট করছে, আর ডাক্তার বাবু ততোধিক ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ ক’রে সেই ছয়দিনের পেঁচোয় পাওয়া মেয়েকে বাঁচিয়ে তুললেন।

আমিই সেই রমা। শিক্ষিকা। বয়স পঁচিশ। সুস্বাস্থ্য।
নিটোল গড়ন। উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। নজর কাড়ি সকলের। এনজয় করি আর অপেক্ষা করতে থাকি ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্তুরের।

কি বুঝলেন?
সত্যিই কি মেয়েদের কইমাছের প্রাণ?

২৮.৬.২০২১.
১২-১৫ পি.এম.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *