**মেয়েমানুষ** বিভাগ- গল্প —– কাবেরী ঘোরাই

**মেয়েমানুষ**
বিভাগ- গল্প
কাবেরী ঘোরাই

(১)

স্বপ্না বাসন গুলো মেজে সব বাসন নিয়ে ঘরে ঢোকে বলে,” বৌদি ও বৌদি কাল পরশু আসতি পারবোনি গো , মেয়ের পরীক্কা ইস্কুলে, সেই দশটায় যাবো আর মেয়েকে নিইয়ে ঘরে ফিরবো তা ধরো তিনটে বেজে যাবে গো”! অতসী আকাশ থেকে পড়ে , চোখ গোল গোল করে বলে , ” সে কিরে ?? বলিস কি?? দুদিন??? তা কি পরীক্ষা দিচ্ছেরে তোর মেয়ে?” স্বপ্না মুখ মুছে বলে ইস্কুল ফাইনাল গো , কেন জানোনিকো?? খপরে তো সব বলি দিচে, আসলে মেয়ের বাপই যায় গো কিন্তু কাল আর পরশু ওর কি কাজ আছে তাইই আমাকে যেতে হবেগো”!! অতসী বলে, ” তা বলে কাজ কামাই করে!!! এর কোনো মানে নয়?? অন্য কেউ ও নেই যে তাকে বলবো যে করে দিয়ে যা!! আশ্চ্যর্য !! আমার ছেলের ও ক্লাশ টেষ্ট চলছে কি হবে বলতো!! উফ!! জাষ্ট ভাবতে পারছিনা , আমি কিন্তু মাইনে কেটে নেবো এই দুদিনের আর হ্যাঁ পরশুর সব এঁটো বাসন থাকবে পরের দিন এসে মাজতে হবে কিন্তু!” স্বপ্না চুপ করে এগিয়ে যায় দরজার দিকে তার কাজ হয়ে গেছে , বৌদি ফোনে দাদা কে বলছে মেয়ে কি এমন বিদ্যেধরী হবে তার ঠিক নেই মা বাড়ি বাড়ি ছুটি নিয়ে বেড়াচ্ছে!!আমার মনে হয় সব বাহানা কোথাও যাবে মনে হয় !!মাইনে কেটে নেবো বলেছি!! স্বপ্না রাস্তায় নেমে ঘাম মুছতে মুছতে এগোয় তাদের স্বপ্ন দেখা বারণ কিন্তু একবার ছুয়েঁ দেখতে তো দোষ নেই!!!

(২)

অনন্তিকা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে , আর থাকা যায়না আজই শেষ শুধু, দিনের পর দিন সারা পরিবারের ভার তার কাঁধে দিয়ে সবাই ঘুরে বেড়িয়েছে সে কোনোদিনও কিছু বলেনি হাসি মুখে সবার সব বায়না একা হাতে সামলেছে কিন্তু আজ যখন সবাই জানতে পেরেছে তার আরো একটা দিক আছে সবাই রে রে করে তেড়ে এসেছে !! তার যেনো কোনো শখ আহ্লাদ থাকতে নেই !! অন্য রা যাই বলুক সুব্রত ও চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনেছে সবার কথা!! ছেলে মেয়ে হয়নি বলে সবাই তাকে কাজের লোক বানিয়ে দিয়েছে কবেই!! সুব্রত ও তাই মনে করে কিন্তু সুব্রত র মেডিকেল রিপোর্ট টা কি কেউ দেখতে চেয়েছে!! কথায় কথায় বাচ্চার কথা তুলে সারা বাড়ির অপমান কে সে উপহাস ভেবে উড়িয়ে এসেছে এতোদিন!! সব জেনেও নিজের দোষ টাই যেনো ইচ্ছে করে প্রমাণ করেছে সে কেন?? কারণ এ বাড়ির সবাই কে , নিজেকে সে এ বাড়িরই একজন মনে করতো , কিন্তু সূর্বণ র কথা শুনে যখন সে আবার আবৃত্তি র প্রোগ্রাম করতে শুরু করলো তখন কাউকে বলেনি , লুকিয়েই করতো যতটা করা যায় ,কিন্তু সেদিন হঠাৎ রবীন্দ্রসদনে তার ননদ আর তার বন্ধু রা তাকে দেখে ফেলে প্রোগ্রাম করতে ব্যাস!!! শুরু হয়ে যায় শূলে চাপানো!! আর সয়নি অনন্তিকা বেড়িয়ে এসেছে আজ আর বলেও এসেছে সে বাঁজা নয় তার দায় টা অন্য কারো ঘাড়ে বর্তায় আজ থেকে সে বাঁচবে শুধু নিজের জন্য…!!!

(৩)

সিমি দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে , বয়স টা দিন দিন বাড়ছে !! তবু সে সুন্দরী এখনো। মা ঘরে ঢোকে বলে, কিরে হাত মুখ ধুস নি এখনো?? যা ধুয়ে আয় খাবার দিয়েছি তো!! সিমি আনমনা ভাবে বলে, হুঁ আসছি যাও তুমি। মা চলে যায়। সিমি মুখ হাত পা ধুয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ টা মোছে , কোন ছোটবেলায় বিয়ে করেছিলো বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে!! ভেবেছিলো সিনেমার হিরো হিরোইন দের মতোই একটা জীবন হবে কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে যায় ছ মাসে র ভেতর !! বুঝতে পারে যার জন্য সব ছেড়ে এসেছে সে অন্য কারুর !! তাও হারেনি লড়াই করেছে চার বছর সংসার টাকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য ততদিনে টুকাই এসে গেছে তাদের মাঝে!! তাকে নিয়ে বাঁচবে বলে সিমি আশা করেছিলো কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস টুকাই মারণ রোগে আক্রান্ত জন্মাবধিই!! প্রথমে বোঝা যায়নি আস্তে আস্তে বুঝতে পারে!! সেই সুযোগে তার পতিদেব ও কেটে পড়ে তার নতুন পাখি কে নিয়ে!! সিমি বেড়িয়ে আসে টুকাই কে বুকে নিয়ে !! এসে ওঠে সেই বাপের বাড়িতেই শুরু হয় অন্য লড়াই , অন্য জীবন!! কেউ আসেনা সাহায্য করতে !! বৃদ্ধ বাবা মা আর সিমি টুকাই!!! কাজ করতে নামে সিমি কিন্তু পড়াশুনো তো মাত্র এইট অবধি কিন্তু হ্যাঁ রূপে একটু মরচে পড়লেও এখনো আগুন!!! তাই পোড়াচ্ছে সে এক এক করে এক একজন কে !!!! বাড়িতে বলা আছে দোকানে কাজ করে যখন যেরম ডিউটি পড়ে, রাতে কোথাও পড়লে অসুবিধে হয় , টুকাই এখন অনেক সুস্থ আগের থেকে, সিমি অন্য কিছু আর ভাবেনা ছেলেটা কে তো বাঁচতে হবে!!!

(৪)

মা রেগে হন হন করে ঘরে ঢুকে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে বললো,” কতবার কতবার বলেছি তোমায় মেয়ের এবার বিয়ে দাও , তা শুনলে তো!! ছি ছি ছি নাও বোঝো এবার একগাদা ছেলের সাথে বসে মেয়ে কিনা বিড়ি খাচ্ছে!!” বাবা একবার আড় চোখে মিতুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো , মিতুল বইটা দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলো, মা বলেই যাচ্ছে মেয়ে হলে কি কি করতে হয় তা না হলে কি কি সর্বনাশ হয়!! উফফ!! মা র গলা রান্না ঘর থেকে ভেসে আসছে!! বাবা এবার মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,” নাহ!! বিয়েটা দিতেই হবে এবার দেখছি!!!” মিতুল ছুট্টে এসে বাবা কে জড়িয়ে ধরে বললো ,” না না না তাহলে কিন্তু এই বুড়ো বয় ফ্রেণ্ডের সাথে কাট্টি হয়ে যাবে !!! তখন আমার বুড়ো বয় ফ্রেণ্ড কোথায় যাবে!!!” বাবা বললো,” উঁহু ওসবে ভুলছিনা বুড়ো বয় ফ্রেণ্ড আর একটা গার্ল ফ্রেণ্ড নিয়ে আসবে তখন!!” মিতুল চোখ গোল গোল করে বললো,” কিইইইই তাই বুঝি?? তা সে কি আমার মতো এই বুড়ো বয় ফ্রেণ্ড এর সেবা করবে? মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াবে , তার খুচরো পয়সার হিসেব রাখবে? তার চশমা হারালে খুঁজে দেবে?? মা কে লুকিয়ে দুটো কানাই এর দোকানের দুটো দরবেশ খাওয়াবে? লুকিয়ে মুভি দেখতে যাবে??” বাবা হেসে বললো , দেখি সব হবেনা কিছু হবে তাতেই কাজ চালাবো !” মিতুল এবার চোখ ছলছল করে বললো ,” ঠিক আছে ঠিক আছে চলেই যাবো আর আসবো না কক্ষোনো !!” বাবা হেসে মিতুলের মাথায় টোকা মেরে বললো ,” তোর মা আসছেরে আবার শিগগিরি চোখ মোছ পাগলী” !!! এসব দিন ফুরিয়ে গেছে বহু আগেই , মিতুল এখন দাঁড়িয়ে আছে বম্বে ক্যান্সার হাসপাতালে !!! তার চিরকালের বয় ফ্রেণ্ডের সময় শেষ হয়ে আসছে বড় দ্রুত!!! মা অসহায় ভাবে বসে আছে ভেতরে একটা চেয়ারে মিতুল আর সৌরভের ছেলেকে নিয়ে !! বিয়ে ঘর সংসার সবই গুছিয়ে করছে মিতুল তার সাথে একটা চাকরী ও … কিন্তু সৌরভ আর সে দুজনেই অন্য গ্রহের বাসিন্দা , মিল হয়নি কোথাও , মিতুল বুঝেছে ছেলে সাজা আর ছেলে হওয়ার তফাৎ !! জন্মগত অধিকার থাকে মেয়েদের মেয়ে মানুষ বলার!!! কিন্তু সেতো শুধু মেয়ে মানুষ নয় তার বাবা মায়ের আদরের মেয়ে , তার ছেলের মা , আরো অনেক কিছু ই আর সবচেয়ে বেশী তার বয়ফ্রেণ্ডের গার্লফ্রেণ্ড!!! হাতের জ্বলন্ত সিগ্রেট টা ছুঁড়ে ফেলে সে এগোয় ICU র দিকে যদি যেতে না দেয় তার বয় ফ্রেণ্ড কে তাহলে কার কি বলার আছে!!!

#নীল_বৃষ্টি
স্বত্ব- সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *