তীর্থের পথে পথে হালিশহর — কোয়েলী ঘোষ

তীর্থের পথে পথে হালিশহর
কোয়েলী ঘোষ

সামনে বয়ে চলেছে কুল কুল ধারায় গঙ্গা নদী । এপার ওপার দু পার দেখা যায় স্পষ্ট । এখানে নদীর এত উচ্ছ্বাস নেই । আমরা কজন দাঁড়িয়ে আছি প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ হালিশহরে , স্বামী নিগমানন্দ মহারাজের আশ্রমে ।

সকালের লোক্যাল ট্রেন করে এসেছি ব্যান্ডেল জংশন ।সেখান থেকে নৈহাটি লোক্যাল ধরে নৈহাটি স্টেশনে এসে অটো করে এসেছি হালিশহর । কলকাতা থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এই প্রাচীন জনপদ । শিয়ালদা থেকে রানাঘাট লোকাল ট্রেনে আসা যায় হালিশহর স্টেশন ।

উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার হালিশহরের নাম ছিল কুমারহট্ট । কুমার উদয় নারায়ণ বন্ধুদের নিয়ে গঙ্গা স্নানে আসতেন ।সেই সময় বিরাট হাট বসত । কুমারহট্ট নাম সেখান থেকে এসেছিল ।
তাছাড়া একসময় কুমোর দের বাস ছিল । বিখ্যাত ছিল মাটির তৈরি জিনিস । গঙ্গার ঘাট থেকে হাঁড়ি কলসী চালান হত । সেই থেকে কুমার হট্ট নামটি প্রচলিত হয় ।


শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু , সাধক রামপ্রসাদ , রাণী রাসমণির স্মৃতি ধন্য‌ এই হালিশহর ।

মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডী মঙ্গল কাব্যে প্রথম হালিশহর নামটি পাওয়া যায় । হাবেলী শহর অর্থাৎ অট্টালিকা বহুল নগরী থেকে হালিশহর নামটি এসেছে ।

স্টেশন থেকে অটো এসে দাঁড়াল স্বামী নিগমানন্দ আশ্রমে । শীতের মরশুমী ফুলে ফুলে সাজানো বিস্তৃত প্রাঙ্গণ । দূর থেকে চোখে পড়ে শুভ্র মন্দিরের চুড়া ।
এখানেই স্কুল , ছাত্র নিবাস । নাম লেখা আছে ঋষিভবন ।
সামনে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের মূর্তি আর একটি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তি ।
মন্দিরের দরজা তখন বন্ধ হয়ে গেছে বলে গঙ্গার ঘাটে বসে আছি । ঘাটের দুদিকে দুটি মন্দির । মা গঙ্গা আর শিবমন্দির । কিছুক্ষণ‌ গঙ্গার স্তোত্র পাঠ করলেন প্রদীপদা । তারপর ঠিক হল ততক্ষণ ঘুরে নেওয়া যাক এই শহরের দ্রষ্টব্য কিছু ।

দুটি টোটো ভাড়া করে প্রথমে গেলাম চৈতন্য ডোবা । এখানে একটি বেশ বড় পুষ্করিনী আছে । চৈতন্যদেবের দীক্ষা গুরু ঈশ্বরপুরী এখানে থাকতেন । বড় বড় নারকেল গাছের ছায়া এসে পড়েছে পুকুরের জলে ।
পাশেই মন্দিরে গৌর নিতাই ,রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে অপূর্ব মূর্তি দর্শন করলাম ।

টোটো এগিয়ে চলল রাণী রাসমণির জন্মভিটের দিকে । গ্রামের ঘর বাড়ি পেরিয়ে টোটো দাঁড়াল উন্মুক্ত এক ছায়া ঘেরা প্রান্তরে ।
দিনটা ছিল শ্রী রামকৃষ্ণদেবের জন্মদিন । মঞ্চ বেঁধে গান হচ্ছিল । কিছুক্ষণ বসে গান শুনে মন পূর্ণ হয়ে উঠল ।
তারপর মন্দির দর্শনে গেলাম ।
এখানে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে একটি কালীমন্দির তৈরি হয়েছে । মায়ের মূর্তি অপরূপ ,কিছুক্ষন সেখানে বসলে মন শান্ত হয়ে যায় । অদ্ভুত এক আনন্দ অনুভব নিয়ে বাইরে এলাম ।
একদিকে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা । এই সেই রাসমণি ঘাট যার নির্মাণে রাণীকে অনেক বাধায় পড়তে হয়েছিল । সারাটি দিন এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু টোটো এতক্ষণ দাঁড়াবে না ।

সেই পথ ধরে এলাম কিছুটা তারপর বাঁদিকের রাস্তা ধরে এলাম সাধক রামপ্রসাদের ভিটে বা সাধনপীঠ । প্রাচীন এক বট বৃক্ষের কাছেই মন্দির ।

“মনরে কৃষিকাজ জানো না
এমন মানব জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা । ”

শাক্ত পদাবলীর পাতায় আছে অজস্র গান যা রামপ্রসাদী গান নামে খ্যাত । চাকরি করতে এসে তিনি হিসাবের খাতায় লিখে রেখেছিলেন শ্যামাসংগীত । নিজে প্রতিমা তৈরি করতেন । কথিত আছে মায়ের বিসর্জন দিতে গিয়ে তিনি বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন ।
সেই পূজিত মায়ের সামনে এসে সেই কালো রূপে মুগ্ধ হলাম । এখানে আমি আগেও একবার এসে পুজো দিয়েছি । সময় কম । ওদিকে নিগমানন্দ মহারাজের আশ্রমে প্রসাদের ব্যবস্থা আছে । তাই এবার আর পুজো দেওয়া হল না ।
মাকে প্রণাম জানিয়ে এলাম সেই আশ্রমে । মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হলো । মহারাজের মূর্তিতে প্রণাম জানিয়ে আমরা নানা পদের ভোগ প্রসাদ পেলাম ।
এবার ফেরার পালা । সেই পথে না এসে পাশেই নদীপথে ব্যান্ডেল আসার কথা বললেন একজন । এই নদীপথটি এতো মনোরম , দুদিকে গাছ পেরিয়ে লঞ্চ চলেছে । সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে জলে ।
লঞ্চের পথ শেষ হল । এলাম ব্যান্ডেল জংশন । সেখান থেকে লোক্যাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরা ।

অনেকে দুর দূরান্ত বেড়াতে যান কিন্তু বাংলার বুকে আছে কত ইতিহাস , কত মন্দির , তার গায়ে টেরাকোটার কাজ , পোড়ামাটির কাজ , সেগুলো আমরা দেখতে বা জানতে চাই না ।
সেইজন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা । মাত্র একদিনেই দেখে আসুন এইসব ঐতিহ্য মন্ডিত স্থান ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *