মাধবদেবপুর রাজবাড়ি —- মীনা দে

মাধবদেবপুর রাজবাড়ি
মীনা দে

আমরা থাকতাম একটা আধা মফস্বল শহরে।
আমাদের ছোটবেলায় গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যের পর বাইরে রোয়াকে বসে আড্ডা দেবার বেশ একটা রেওয়াজ ছিল। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় ঘরের ভেতরের থেকে বাইরেটাই বেশি আকর্ষনীয় হয়ে উঠত সকলের কাছে। গায়ে গায়ে লাগা বেশকিছু একতলা বাড়ি নিয়ে এক একটা পাড়া। আমাদের বাড়িটাই একটু বড়ো ছিল আর সামনে দুখানা বেশ বড়ো বড়ো রোয়াক ছিল। সেইখানে পাড়াতুতো দাদারা এবং কাকুরা সবাই একত্রিত হতেন সন্ধ্যে সাতটার পর।
আমরা ছোটোরাও মাঝে মাঝে জায়গা করে নিতাম তাদের সেই আড্ডায় আর আমাদের আবদার থাকতো ভূতের গল্প বলার। আমাদের বাড়ির সামনেই একটা ল্যাম্পপোস্ট ছিল তার যৎসামান্য আলো ওই জায়গাটুকু যা হোক একটু আলোকিত করে রাখত। বাদবাকি সমস্ত জায়গা অন্ধকারের ঘেরাটোপে যেন ঢাকা । সারাক্ষণ ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক ছাড়া বিশেষ শব্দ শোনা যেত না। আর এই সব কিছু ভূতের গল্প শোনার জন্য মোক্ষম পরিবেশ ছিল। আমরা ছোটরা সবাই বড়োদের একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে বসতাম। কারণ ভয় তো পেতাম খুব তবু শোনা চাই। ওই ভয় পাওয়াটার মধ্যেই তো মজাও যে ছিল।

এইরকমই একদিন পাড়ার এক দাদা শুরু করলেন তাঁর এক চরম অভিজ্ঞতার কাহিনী ।
তপেন মন্ডল নাম ছিল তাঁর। তা আমাদের তপেনদারা তিন বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছিলেন মাধবদেব পুর বলে একটা জায়গায় । সেখানে নাকি বহু পুরোনো দিনের একটা রাজবাড়ি আছে যেটা দেখার মতো। প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো কিন্তু এখনও নাকি দেখলে নতুনের মতো মনে হয়।

তপেনদারা তিনবন্ধু মিলে তো পৌঁছলেন সেখানে। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল। কলকাতা থেকে তিন চার ঘন্টার পথ। তাঁরা ভেবেছিলেন দুপুরে বেরিয়ে পড়লে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যেতে পারবেন। কিন্তু ট্রেন লেট করায় তা আর সম্ভব হলো না। পৌঁছতে পৌঁছতে দিনের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে এলো। যাইহোক তাঁরা পৌঁছে একটু হতাশই হলেন কারণ অতবড়ো বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির কোনো ব্যবস্হা নেই। মানে সেই দেঢ়শো দুশো বছর আগের ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন করতে চাননি তাঁদের পরের পরের কোনো প্রজন্মই। পর্যটক যাঁরা আসেন তাঁদের কাছে এটাও নাকি একটা মস্তবড়ো কারণ, সেই আগের পরিবেশটাকেই তাঁরা উপভোগ করতে চান। বেশ একটা অন্যরকম ফিলিং হয়। প্রত্যেক ঘরে এবং বারান্দায় তখনকার দিনের লম্বা চিমনি থাকা বাতিদান রয়েছে । শুধু মস্তবড়ো যে হলঘরটা সেখানে একটা ঝাড়বাতি শোভা পাচ্ছে, যদিও তার অনেকগুলো বাতিই আর জ্বলে না। তপেনদারা ঠিক করলেন এখন আর পুরো বাড়িটা দেখার দরকার নেই কাল সকালেই দেখা যাবে। আজ বরং ছাদে গিয়ে গল্পগুজোব করা যাক। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। তাঁরা পৌঁছে গেলেন বিরাট সেই বাড়ির বিরাট ছাদে। সৌভাগ্যবশত সেই দিনই ছিল পূর্ণিমা । ছাদটা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল। তিনজনে কেয়ারটেকারের দিয়ে যাওয়া চা জলখাবার সহযোগে গল্পে,আড্ডায় মেতে উঠলেন। হঠাৎ তাঁদের চোখে পড়ল বেশ কিছুটা দূরে যেন সাদা থান পরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। যেহেতু পূর্ণিমার রাত তাই আশপাশের ঝোপঝাড়ও অল্পবিস্তর চোখে পড়ছে, হঠাৎ সেই সাদা থান পরা মহিলা তাঁর ঘোমটায় ঢাকা মাথাটা তাদের দিকে যেই না ঘুরিয়েছে তখনই তার একটা চোখ দেখা যাচ্ছে লাল হয়ে যেন জ্বলছে। মাঝে মাঝেই মাথাটা ঘুরিয়ে তাদের দিকে দেখছে আবার নামিয়ে নিচ্ছে। তিনজনের প্রচণ্ড ভয়ে গলা দিয়ে কোনও শব্দই বের হচ্ছে না। আর ওই দিকে একবারও না তাকিয়ে তিনজনেই ছাদ থেকে নেমে সোজা ঘরে গিয়ে দরজা জানলা বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ তাঁরা কেউই কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর কোনোমতে রাতের খাবার খেয়ে তিনজনেই আপদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়লেন।

সকালে যখন তাঁদের ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখেন যে কাল রাতের মাধবদেবপুরের সঙ্গে আজকের মাধপদেবপুরের যেন আকাশপাতাল ফারাক। চারিদিকে কত রকমের গাছ গাছালি ফুল ফল সরু সরু কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। মানুষজন কম হলেও বেশ চোখে পড়ছে। তিনজনেই ফ্রেস হয়ে প্রাতঃভ্রমনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। বেশ খানিকটা হাঁটার পর তাঁদের চোখে পড়ল একটা কাকতাড়ুয়া ছোট ছোট একই রকমের কিছু গাছপালার মধ্যে ,যার সবটাই একটা সাদা কাপড় জড়ানো। আর মাথায় একটা লন্ঠন ঝোলান রয়েছে, যেটা তখন নিভে গিয়েছে। তাই না দেখে রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার কারণ টা বুঝতে পেরে সকলেই হো হো হো করে প্রচন্ড খানিক হেসে নিলেন। লন্ঠন সমেত কাকতাড়ুয়ার মাথাটা হাওয়াতে যতবার নড়েছে ততবার মনে হয়েছে পেতনী বুঝি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকেই দেখছে। তাঁদের মন থেকে ভয়ের মস্তবড়ো পাথরটা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *