গল্প– হলমার্ক — কলমে — #শ্বেতা_ব্যানার্জী

গল্প– হলমার্ক

কলমে — #শ্বেতা_ব্যানার্জী

জানো, পিং শব্দটার জন্য আমি বেঁচে আছি। ক্ষীণ কন্ঠস্বরে স্যাণ্ডেরিটা কথা শুরু করে—
জানি গো,জানি,আমারও কী তোমার কাছে আসতে সাধ যায়না, কি করবো বলো? নানান কাজের ঝামেলায় জড়িয়ে থাকি,কিন্তু দেহ-মনের বাস তোমায় ঘিরে…
প্লিজ মুখ ফেরাও সোনা —-
একমুখ হাসি নিয়ে পাশ ফেরে স্যাণ্ডেরিটা।
বলো আজ কেমন আছো?
ভালো ছিলাম না, এবার ভালো হ’লাম।
দ্যাখো স্যাণ্ডি, হ্যাঁ স্যাণ্ডেরিটা’কে আমি এই নামেই ডাকি, আমাদের ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুত্ব এতটা রক্তমাংসের হয়ে যাবে কোনোদিন আমার স্বপ্নেও আসেনি।
হ্যাঁ ঠিকই,আমি অসুস্থ কিন্তু সেকথা
এখন আর মন ও শরীর বলেনা। দ্যাখো, তুমি ফিজিক্যালি আমার থেকে অনেকদূরে….
তবুও মনে হয় আমরা হাত-ধরাধরি কথা বলছি, ভগ্ন,ক্লান্ত, অবসাদ ভরা জীবনের ক্লান্তি মেখে কথা গুলো বলে স্যাণ্ডেরিটা।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি ওকে থামিয়ে দি’।
কারণ ওর কথা গুলো জড়িয়ে যাচ্ছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে… জিভের আড়ষ্টতায় লালা ঝ’রে পড়ছে।
তবুও সে বলতে থাকে… কাল এতো দেরি করো না। তার গলার সুরে একরাশ সোহাগ তরঙ্গ তুলে যেন আমায় ভিজে দিতে চাইছে।
আসবো সোনা, আমিও আবেশ মিশিয়ে বলি…
ততক্ষণ তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতন সিস্টারের কথা শুনবে,আর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে।
আমার যে ঘুম আসেনা—-
সারা শরীর জুড়ে সাপের ছোবল, প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণা, এরা যে আমায় জাগিয়ে রাখে,কী করি বল!!
আচ্ছা, আচ্ছা, আমি তোমার গালে একটা মিষ্টি চুম্বন রাখছি, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
ও- কে যেন আজ কথায় পেয়েছে, ও বলতে শুরু করে..
জানো সিদ্ধার্থ,হ্যারি আবার বিয়ে করলো কারণ আমি ওকে স্বপ্নের স্বাদ দিতে পারিনি বলে, কিন্তু তখন আমি কাঁদিনি এ-ই ভেবে স্বান্তনা পেয়েছিলাম.. যাক, অবশেষে সারারাতের পৈশাচিক নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেলাম। সেদিন আমি মুক্তির স্বাদ পেয়ে জিতে গেছি ভেবে খুব হেসেছিলাম —-
ভেবেছি অনেক জীবনটা’কে নিয়ে —
কিন্তু কোনোদিনই ওকে বোঝাতে পারিনি দেহ ছাড়া এই জীবনে অনেক কিছু পাবার থাকে।
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি,আজ আর নয়, কাল আবার কথা হবে…।
ও’বলে না,আমায় বলতে দাও, জীবনের তিল তিল
ক’রে ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের কথা আমি তোমাকে বলে যাবো।
প্লিজ, মন দিয়ে শোনো; এখন আমার একমাত্র মেডিসিন তুমিই..।
ওর কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছু বলতেও পারিনা, বাধা দিতেও পারিনা। ও অনেক কষ্টে গেঙরিয়ে কথা গুলো বলতে থাকে…।

হালকা বাতাসে যেমন পর্দার দোলন তেমনই এক দোলন আমি অনুভব করতাম স্যাণ্ডেরিটা’কে দেখে। প্রথম প্রথম একদিন কথা না বললে খুব অস্থির লাগতো, তারপর আমার মনে এক অপরাধবোধ জাগলো, চিন্তাও করলাম;
অসুস্থ মানুষকে যদি একটু ভালোবাসা দিলে সে ভালো থাকে, ক্ষতি কী!! কীসের অপরাধ—
সে তো সূদুর ভেনিসে, আর আমি এ-ই বাংলায়।
তবুও একটা অসুস্থ প্রাণ যদি বেঁচে থাকে আমার ভার্চুয়াল সান্নিধ্যে।
এখন সে আমার কথায় হাসে, তার আঙুল, হাত-পা
প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাড়া দেয় আমি বুঝতে পারি।
আমি শেলি,কীটস আওড়াই ও আমার সঙ্গে চেষ্টা করে বলার।
আমি বলি,জানলা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দ্যাখো; কি অপূর্ব তার প্রকাশ
“Beauty is truth, truth beauty; that is all ye know on earth, and all ye need to know—”

ও’বলে, জানো; শেলি ও কীটসের স্মৃতি বিজড়িত
কবর হ’লো রোমের প্রটেস্ট্যান্ট কবরখানা। সেখানে সাইপ্রেস গাছের ছায়ায় কবিদ্বয় চির নিদ্রায়।
আমারও ইচ্ছে করে সেই তীর্থভূমি তে যদি একটু
জায়গা পেতাম —–
গিন্নির কাছে কিছু বলতে পারিনা, আবার অপরাধ বোধেও ভুগিনা,ভাবি’ আমিতো সেবা করছি একটা মৃত্যু পথযাত্রীর।এটাও তো চিকিৎসা,মনোচিকিৎসা।
একদিন স্যাণ্ডি আমাকে বললো, সিড্ আমার ভিতর যে আগুন আছে তাকে তুমি জ্বালিয়ে দাও।
তুমি প্রমাণ করে দাও আমি হিমশীতল জীবন্ত লাশ নই। আমার দাবি মিটিয়ে ঘুমন্ত সুপ্ত শিখায় তুমি
আগুন জ্বালো—-
আমাকে আদিম সুখের সন্ধানে নিয়ে চলো…
তুমি বন্য হও। এই জীবন্ত শরীর এক মানুষী বৃষ্টিতে ভেসে যাক…
আমার আজীবনের গ্লানি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাক। আমাকে মুক্তির পথ দেখাও…

আমি অভিমানের ভান করে বলি—-
ওও আমি তা’হলে!!
না,না,সিড, তুমি আমার, একান্ত ভাবেই আমার।
স্যাণ্ডি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে —
আমার যে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,
তা-ই আমি এই পৃথিবী থেকে প্রকৃত প্রেমিকের ভালোবাসা নিয়ে যেতে চাই।
আমার কফিনের প্রত্যেকটি পেরেকে লেগে থাকবে
তোমার স্নেহের পরশ, তোমার চুম্বন,তোমার নিঃশ্বাসের ওঠানামা। আমি সব,সব কিছুই বন্দী করে নিয়ে যাবো কফিনের ডালা বন্ধ করার আগে— —

আমি কল্পনায় ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যা-ই..
আমার ওমে ওর অসুস্থ শরীর তিরতির কাঁপতে থাকে, অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস চোখের জল হয়ে ওঠে।
চোখের পাতা যখন আয়না হয়ে ধরা দেয় তাকে
তখন অবৈধ ঘোষণা করা যায়না। আমি অবাক হই
সে যখন বলে, বয়স নয়,ভালোবাসার অপর নাম
চিরযৌবন।
আমার জীবনের আস্বাদ তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ, তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির থাকতে পারিনা।
নিজেকে উজাড় করে ভরিয়ে তুলি তা’কে।
জানিনা ভার্চুয়াল সুখ কতটা দিতে পেরেছিলাম —
কিন্তু তার মুখে আত্মতৃপ্তির মৃদু হাসির হদিস আমি পেয়েছিলাম।
কার্যত এক অর্থে লাইফ সাপোর্ট নেওয়া মানুষ, অথচ কি স্বর্গীয় আনন্দ বুকে নিয়ে সে সাগরে ভাসিয়েছিল জাহাজ…
আর, আমি খুঁজি সেই জলের তল; সব দুঃখ, বেদনা ভুলিয়ে দিতে।
সে বলে, সিড, আমাকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখো। আমি পৃথিবীর স্পর্শঘ্রাণ নিতে চাই, তোমাকে আরও কিছুদিন আমার করে রাখতে চাই।
সে আপনমনে বলতে থাকে —-
‘আমি অলৌকিকে বিশ্বাসী
Myrtke গাছে আসুক পাতা
আরোগ্য পাক জীবনের জলধারা
যন্ত্রণা রূপান্তরিত হো’ক নীল সমুদ্রের
উজ্জ্বল ঢেউয়ের মালায়—-
ও হাঁফাতে থাকে, চোখ স্ফীত হয়ে ওঠে, চোখের কোণে জল চিকচিক করে কিন্তু গড়িয়ে পরেনা।
শুধু সারা শরীর দুমড়ে মুচড়ে জীবনের শেষ লাইন খোঁজে —
মানুষ যখন বুঝতে পারে তার যাবার সময় হ’লো
তখনই হয়তো বেশি করে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে
এই জগতের ডালপালা।
আমার মনে হয় ও-কে বুকে চেপে ধরে আমার সমস্ত শ্বাস- প্রশ্বাস দিয়ে ওর প্রাণবায়ুর আয়ূ বাড়িয়ে দি’।
আমি অক্ষম, আমি পারিনা তার ফুসফুসে জীবন ভরে দিতে।
আমার স্যাণ্ডেরিটা, যা’কে আমি আমার স্ত্রীর মতন মর্যাদা দিয়েছি, প্রেমিকার মতন সম্মান করেছি,
করুণা নয়, জীবনের মানে গেঁথে উপহার দিয়েছি;
আগলে রাখতে চেয়েছি তার আরোগ্য কামনা করে।
তা’কে আমি উপেক্ষা করিনি, ভরিয়ে দিয়েছি আমার সবটুকু দিয়ে।।
তার জীবন নদী সাজিয়ে দিয়েছি রমণীয় উপবনে—
—– স্যাণ্ডেরিটা’র কোন জ্ঞান নেই,দু’চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বুকের উপর হাতদুটো ক্রশ করে রাখা। শিয়রে রাখা “গীতাঞ্জলি” ও বলতো,তোমাদের কাছে গীতা যেমন পবিত্র আমার কাছে গীতাঞ্জলি।

ও’কে ওইভাবে আমি বেশিক্ষণ দেখতে পারছিলাম না। ফোনটা বন্ধ করার আগে আমার কবিতার
চারলাইন শেষ উপহার দিলাম —–
আমি ধর্ম মানিনা,
আমি ধার্মিক নই,
শুধু তোমাকেই ভালোবেসে–
আমি ধর্মপ্রাণ হই।
গুড বাই স্যাণ্ডি, পরম শান্তির ধামের দিকে এগিয়ে
যাও….
“বিদায় জীবনের অনিবার্য ” তা’কে অস্বীকার করি কি করে! তুমি যাও প্রিয়তমা,
আমি আসছি…।

আমি অদৃশ্য শক্তি দিয়ে ওর সারা শরীর জুড়ে
ক্রুশচিহ্ন আঁকি…..।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *