##গল্প : সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ — কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়

##গল্প : সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ

কলমে : মালা মুখোপাধ্যায়

–আরে তোরা দাঁড়া—

–আই। শুরু হয়ে গেল।

–তুই এতো লেটু কেন?

— যাঃ, চলে গেলি? আমার মনে হয় শাড়িটা ঠিক
মতো পরা হলো না। যদি খুলে যায় ! তোদের ধরে দিলাম আর তোরা চলে যাচ্ছিস। একটু দাঁড়া না প্লীজ।

কে কার কথা শোনে। স্কুলে হেডস্যার বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছেন। তারপর ওদের গীতিনাট্য আছে। সাজা হয়ে গেছে। মালা পরা সব রেডি। গন্ডোগোল পাকাচ্ছে ঐ মহুয়া। ওর আর কিছুতেই মন বসছে শাড়িতে । বড্ডো খুঁত খুঁত স্বভাব ওর। তুই থাক বলে একটি সাজের ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে স্কুলের মাঝখানে যেখানে স্টেজ বাঁধা হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে তার পাশে মুখটা আড়াল করে একে একে সবাই হাজির।

অগত্যা বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বেরোতে যাবে আর দেখা হয় ওর ক্লাস ফ্রেন্ড ইন্দ্রনাথ এর সঙ্গে। ধাক্কা লাগবো লাগবো করেও ধাক্কা লাগে নি। দু’জনেই খুব সামলে নিয়েছে। মাঝে মোটে একচুল ফাঁক।
দু’জনেই একসঙ্গে বলে ওঠে ,জোর ধাক্কা থেকে বেঁচে গেলাম।

–তোর মুখ ওমন কেনো? প্যাঁচার মতো? ইন্দ্র হতবাক !

–তুই এখানে?

–আরে তোকে খুঁজতেই আসা । কাকিমা মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোর ছবি তুলবে বলে, আমাকে পাঠালো , কোথায় তুই খুঁজে পাচ্ছেন না।

–ইন্দ্ররে । আমার শাড়ির নিচেটা একটু ধর না রে।

–আমি?

–অবাক হচ্ছিস কেন? এখানে তুই ছাড়া আর কে আছে? শুধু নিচের কুঁচিটা একটু ধর।

–কেউ দেখে ফেললে আমার অবস্থা কি হবে? আর তোরও। আমি পারবো না। চললাম।

–ধ্যাত্। তোকে কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যালে নাইট্রোজেন রিং টা দিলাম। আমার তৈরি করা টিউব নিয়ে গিয়ে স্যারকে দেখালি? আর আমার বিপদে একটু হেল্প করবি না?

হেডস্যারের বক্তৃতা শেষ । হাততালি পড়ে গেল।
মহুয়া ব্যাকুল হয়ে বলে , ইন্দ্র মাকে নিয়ে এলেই তো পারতিস। ঐ দ্যাখ হাততালি পড়ে গেল। এবার যেতে হবে। কেন যে মায়ের নীল রঙের পিওর সিল্ক পরতে গেলাম? বড্ডো পিচ্ছিল।
ইন্দ্রের একটু মায়া হলো। তাছাড়া ওকে তো মহুয়া হেল্প করে । ওর ওকে হেল্প করা উচিত।
নীচু হয়ে কুঁচি গুলো একটা একটা করে ধরে থাকে। তারপর বলে,নে এবার উঁচু করে পরে নে। তা না হলে নাচতে গিয়ে পড়ে যাবি।

মহুয়ার ছিল সাজের দিকে খেয়াল। আর ইন্দ্রের কেমন একটা অনুভূতি শুরু হয়। খুব মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে ওর মনের মধ্যে। এতো কাছে থেকে এতো সুন্দর একটা বেল ফুলের মতো গন্ধ কখনো পায় নি। বুকের ভেতর কী রকম যেন হচ্ছিল! ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করলেও পা সরছে না।

নিচের কুঁচি ঠিক ঠাক হয়ে যাওয়ার পর মহুয়া হঠাৎ করে পিছন ফিরে শাড়ির উপরের দিকে প্লিট করতে করতে বলে ব্লাউজের সঙ্গে সেপ্টিপিনটা এঁটে দিতে পারবি?

–আমি? আবার ইন্দ্র আঁতকে ওঠে।

–নে দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি দে। শাড়িটা ধরে আছি।

–তাই বলে তোর ব্লাউজে? অসম্ভব!

–দে , কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো। দেরি হয়ে গেল।

–আঃ পিনটা ফুটে গেল হাতে।

–ঢেঁড়স–

–আমি ছাড়া আজ কিন্তু তোর গতি হলো না? চুপ। আগে আঁটতে দে।

একজনের মুখ আর একজনের কাঁধ খুব কাছাকাছি।

–ইন্দ্র—ইন্দ্র—বলে ডাকতে ডাকতে আসে বিকাশ। বিকাশ দেখলো এই অবস্থা। ও দেখে নি পিন আটকানো, ওর চোখে যা ঠেকল, আর ও যা বুঝলো তা ১০০% সঠিক ভেবে নিয়ে বলে ,কি রে ? কি করছিস? বিদ্যাপতি না চন্ডিদাস কার সাহিত্য ?
ভাগ্যিস ডাকতে এসেছিলাম। আহা! কী অপরূপ দৃশ্য দেখিলাম !

–দেখলি ? মহুয়া ? এবার তুই উত্তর দে । ইন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলে। মনে মনে বলে এই সময়েই তোকে আসতে হবে রে?
এবার স্কুল রটে যাবে। কেউ বিশ্বাস করবে না। যা ভাবে ভাববে। এই মহুয়া এবার যা। শুরু হয়ে গেছে।
মহুয়া চলে গেলে বিকাশ বলে , ইন্দ্র কবে থেকে?
ডুবে ডুবে ? এ্যাঁ?

গীতিনাট্য শুরু হয়ে গেছে। কী দারুণ দেখাচ্ছে। ঠিক যেমন টিভিতে দেখাই সেই রকম সেজেছে সব। দারুণ পারফরম্যান্স। প্রচুর হাততালি।
ইন্দ্র আজ নতুন করে দেখলো মহুয়াকে। নিজের মোবাইলে অনেক গুলো ছবি তুললো। তোলায় যায়। এতো অনুষ্ঠানের ছবি। সবাই তুলছে।
হাতে পিন ফোঁটার টনটনে জ্বালাটা বুঝতে পারছে মাঝে মাঝে। মনেও কি কিছু ফুটেছে?

ইন্দ্র ভাবে,বেশি ফুটতে দিলে হবে না। সবে ক্লাস ইলিভেন। এখন কিছু হলে আর ঘুরে দাঁড়াতে হবে না। ইহকাল পরকাল সব ফর্সা হয়ে যাবে। আর চোখের সামনে মহুয়া চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি।

কি সব ভাবছে আবোল তাবোল? একটা শাড়ি ধরেছে বলে এতো কিছু ভাবতে হবে? ওরে পাগলা এরপর তোর আবৃত্তি আছে। আফ্রিকা আবৃত্তি করতে হবে। মোটা ভাঙা ভাঙা হেঁড়ে গলায় শুরু করবে ,উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে—
কেন যে গলাটা ভাঙলো? গলা ঠিক আর আগের মতো বসে নেই ।
গতবারে কিন্তু খুব সুন্দর প্রশ্ন কবিতা আবৃত্তি করেছিল। আর এবার কেমন হবে কে জানে!
এমন সময় বিকাশ বলে , কিছু খাইয়ে দিলে কাউকে কিছু বলব না।

-খাওয়াতে পারবো না।

–সবাইকে বলে দেবো।

–কি বলবি?

-যা দেখলাম।

–কি দেখলি?

-যা দেখালি ।

-সেটাই বল।

মাইকে ইন্দ্রনাথের নাম ঘোষণা হলো। ইন্দ্রনাথ স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়।

আজ ঠিক একবছর পর মহুয়া বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছে গতবছর কত আনন্দ করেছে। আর এবার লক্ ডাউন। তারমধ্যে পরীক্ষা শেষ হয় নি। এ কী বিরক্তি কর ! সবাই বুঝতে পারবে না ভুক্তভোগী ছাড়া। আর একটুও ভালো লাগছে না।
এবার তো সব অনুষ্ঠান বন্ধ। মেনে চলতে হচ্ছে কষ্ট করে । যারা মানছে না তারা দেশদ্রোহী।
একটা তীব্র বিদ্যুৎ ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে বেশ জোরে বাজ পড়ার শব্দ।
জানালা থেকে সরে এসে ফোনটা হাতে নেয়।
বন্ধুদের মেসেজ করবে একে একে।
দেখে অনলাইনে আছে ইন্দ্র। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ পাঠায়।
-গতবছরের পঁচিশে বৈশাখের সেই স্কুলের অনুষ্ঠানের কথা খুব মনে পড়ছে। তার সঙ্গে তোকেও। আই মিস ইউ।

সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রের কাছ থেকে একটি ছবি আসে।
দেখে গতবছরের নাচের ছবি । সেখানে শুধুই মহুয়ার ছবি।

৪.৫.২০২১.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *