রেলি সাইকেল —– শামছুন্নাহার রুবাইয়া

রেলি সাইকেল
শামছুন্নাহার রুবাইয়া
৩০/০৩/২০২১

গ্রামটির নাম পানকাতা,ডাকঘর বাগুয়া,ধনবাড়ি টাংগাইল।তখন ১৯৬৫ সাল,একটা সাইকেল কিনে এনেছিলেন আমার চাচা শশুর দিলদার আহমেদ ঢাকা থেকে,আমার চাচা শশুর ঢাকাই থাকতো।তখন সচরাচর সাইকেল চোখে পড়তো না।একটা সাইকেল দেখার জন্য কতদূর দূরান্ত থেকে লোক আসতো।যার ঘরে এমন জিনিস থাকতো তাকে মানুষ ধনী ভাবতো।আগের দিনের এক আশ্চর্য চমক মনে করতো সবাই। কালের বিবর্তনে সব পরিবর্তন হয়,শিল্প,সংস্কৃতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সব।আমার শ্বশুরের নাম মো.মতিউর রহমান। আমার শ্বশুর আর চাচা শ্বশুর যখন পৃথক হয়ে যায়, তখন সাইকেল টা আমার শ্বশুর দেড়শো টাকায় কিনে নেন।আমার শ্বশুর মহারাণী হেমন্ত কুমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।চৌদ্দ মাইল দূরে এই স্কুল অবস্থিত।তিনি প্রতিদিন সাইকেলে করে স্কুল যেতেন।ছুটিরদিনে আমার শ্বশুর আর তার বন্ধু সিরাজ মিলে সাইকেল চালিয়ে যেতেন ময়মনসিংহ এবং জামালপুর সিনেমা দেখতে ,উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের ছবি বলে কথা।

তখন গোলাভরা ধান থাকতো,মাঠে ফসলের দোলা,বিলে নৌকা আর মাছ ধরার ধুম।দুধেল গরু হাচাড় দিতো দুর্বাঘাসের মাঠে।সকালে শোনা যেতো হুক্কার গুড়গুড়ানি শব্দ। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির এক অপূর্ব নিদর্শন পাওয়া যেত।আহ্ কি দিনগুলোই না ছিলো!গরুর গাড়িতে কাপড় বেঁধে নতুন বউয়ের যাত্রা। পাখিদের কলতানে মুখরিত সন্ধ্যা,অপূর্ব এক পরিবেশ।পিঠের উৎসবে অতিথিদের পদচারণায় গমগম করতো বাড়ি।কি চমৎকার জীবনাচার করতেন সে সময়কার অভিজাতরা!

খুব ভোরে উঠে প্রতিদিন পরিচর্চা করতেন সেই সাইকেল।কালো রঙের রেলি সাইকেল ধুয়েমুছে পরিস্কার রাখতেন,মবিল দিতেন চেইনে,আমার বর যখন ছোট ছিলেন তখন তিনি ভারী দুষ্ট ছিলেন,মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে পালাতেন, আবার এক্সিডেন্ট করে ভেঙে নিয়ে আসতেন,কয়েকবার তার হাতও ভেঙেছে। এই নিয়ে বকাঝকা আর মারও খেয়েছেন বহুবার,শ্বাশুড়ির মুখে শোনা।যখন আমার বর অষ্টম শ্রণীতে পড়েন ১৯৮৭ সাল।তখন শ্বশুর মশাই মোটর সাইকেল কিনেন।এটাও আমার বর এটাও নিয়ে নষ্ট করে আনতে ভীষণ দুষ্ট ছিলেন।এতে শ্বশুর মশাই রাগ করে আর মোটরসাইকেল কখনও চালাননি, এটা আমার বরই চালাতো,তখন ধনবাড়ি বাজারে মাত্র দুটো মোটরসাইকেল ছিলো।স্কুলে যেত মটর সাইকেল করে।

চাচা শ্বশুরের পাঁচ মেয়ে দুই ছেলে,আমার শ্বশুরের একছেলে এক মেয়ে।যদিও পাঁচজন মারা গেছে আমার শ্বাশুড়ি বলতেন, এই দুইজনই টিকেছে।তিনি আরও বলতেন আমার বরের জন্মের পর তিনি চল্লিশ রাত ঘুমান নি।যদি মরে যায়,তাই তিনি তাকে কখনও বকতেন না।শ্বশুর আর চাচা শ্বশুরের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা কাজ করতো,একজন একটা করলে আরেকজন আরেকটা করতেন।চাচাশ্বশুর বলছেন রেড়িও কিনবো এবার ঢাকায় গিয়ে,পরের দিন আমার শ্বশুর সেটা কিনে আনলেন ময়মনসিংহ থেকে।চাচাশ্বশুর ছেলেমেয়ের গান শিখাতেন মাস্টার দিয়ে তো সেও হারমনিয়াম কিনে ছেলেমেয়েদের শিখালেন।উনি ঢাকায় বাসা করলেন, ইনি ধনবাড়ি।টিভি কিনলেন ন্যাশনাল সেই তখন সাদাকালো,তখন যেন এটা অমূল্য ধন।

আমার বিয়ে হয়েছে ১৯৯৮ সালে,তখন থেকেই দেখেছি আগের জিনিস গুলোও যেমন পাকাপোক্ত মানুষগুলোও অসম্ভব মেলবন্ধনে কতটা সমৃদ্ধ,উদারচিন্তা আর মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চাকচিক্যময় জীবন যাপন করতেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। দুশ্চিন্তা শঙ্কা এগুলো একসাথে মিলেমিশে সামাল দিতেন।পরের উপকারে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সবাই। আহ্ কি বিধিমালা প্রয়োজন ছিলো তখন?

শ্বশুর অবসরে আসলেন ২০০৩ সালে।তিনি এই সাইকেল নিয়ে যেতেন আসতেন। কতকিছু এলোগেলো তার সেই রেলি সাইকেলের প্রতি এখনও মায়া রয়েছে,প্রেমের যোগসূত্রে বাঁধা সেই সাইকেল। বাড়িতে গেলেই তিনি এটাকে পরিচর্যায় লেগে যান।অদ্ভুত মায়ার টান । আট বছর হয় আমি তাকে সাইকেল চালাতে দেই না।শ্বাশুড়ি মারা গেছেন তার স্মৃতি ও অস্পষ্ট আবেগ মূর্ছা।তার সকল হৃদযন্ত্রের, ব্যস্ততা, মনোযন্ত্রনা বুঝতে পারি।কতটা ভালোবাসেন সেই সাইকেলটা আজ-ও। তার কাছে গেলেই যেন, ফেলে আসা স্মৃতির নিবিড় বন্ধনে চোখে জলে আসে, অস্ফুটে সুরে কি যেন বলেন!আমার মনে হয়, তিনি একথায়ই বলেন, বয়স কাউকে ক্ষমা করেনা।সব শৈশব কৈশোর যৌবনের হৃদয়ভেদী ইতিটানে।

ইট পাথরের বাড়ি,এসি,নেট,ইন্টারনেট শপিংমল এতকিছুর মধ্যে সেই আগের দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, ফেলে আসা অবকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।বাসা বেঁধেছে মরণ বেদি, সুখী হয়ে উঠার মন কারো নেই। স্বস্তিতে নিশ্বাস নেওয়া আর ফেলাও যায় না। সাতাত্তর বছরের সাইকালটা আজ সঙ্গী বিহীন ঘরের এক কোণে ঝিমায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *