তারার আলোয় পথ চলা — সোমা রায়

তারার আলোয় পথ চলা
সোমা রায়

প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরতেই একরাশ মনখারাপ ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিদিন। সৌমেন তখন চটপট জামাকাপড় পাল্টে চায়ের জল চাপিয়ে দেন গ্যাসে। ওর কাজের মেয়ে আর আধঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে জেনেও ও মনখারাপকে মাথায় চাপতে দেন না।
চায়ের জল টগবগিয়ে ফুটে উঠতেই ডোরবেল বেজে উঠল। কী মন হল, চা পাতা না দিয়েই গ্যাস সিম করে চলে গেলেন দরজা খুলতে।
প্রথমে চার পাঁচ সেকেন্ড স্মৃতি হাতরেই জোর ধাক্কা, “তুই!!”
দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। ইস্, কতদিন পর দেখা!! হ্যাঁ, তা পঁয়ত্রিশ বছর তো হবেই!!
দেবেশ বলল, “আমি ভাবলাম তুই চিনতেই পারবি না!! যা মুটিয়েছি!”
বহুদিন পর হাসলেন সৌমেন, “তা যা বলেছিস রে!! সেই প্যাংলা দেবেশ এখন একদম ভব্যিযুক্ত ব্যক্তি।”
হাসলেন দেবেশ। সৌমেনের হাসিটা দেখে কেমন যেন মনে হল। কী যেন একটা নেই। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। হাসিতে কোন প্রাণ নেই।
কিন্তু সৌমেনের ভীষণ ভালো লাগছে দেবেশকে পেয়ে। ওর একার জীবনে এবং সুদূর বিদেশে ছেলের ওখানে যাওয়ার আহ্বান বারবার ফিরিয়ে দিয়ে এখন মিতার অবর্তমানে মোটামুটি টিকে আছেন।
আবার বেল বেজে উঠতেই চমকে গেলেন। দরজা খুলে দিতেই রমা ঢুকল। তড়বড়িয়ে বলে উঠলেন, “এই দেখ, চায়ের জল চাপিয়ে একদম ভুলে গেছি। শিগগির দুকাপ চা বানিয়ে আনত। ”
দেবেশ বলল, ” মিতাবৌদির ব্যাপারটা শুনেছি। আসব আসব করে একটু দেরি হয়ে গেল। ।”
আবার সেই প্রসঙ্গ!! তবু উত্তর দিতেই হবে, “হ্যাঁ রে, সেরিব্রাল। কিচ্ছু করা গেল না। ” তারপর কথা ঘুরিয়ে দিলেন, “তোর খবর বল। কদিন আছিস?”
দেবেশ আস্তে বললেন, “থাকতেই তো এসেছি। ”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ রে। বেলা খুব জেদ ধরেছিল। মেয়ে যদিও চেন্নাই থেকে আসতে দিতে চাইছিল না কিন্তু ও কারো কথা শুনল না ”
“বেশ করেছিস ”
চা এসে গেল। খেতে খেতে দেবেশ বলল, “যে জন্য আসা, বেলা বারবার বলে দিয়েছে আজ সন্ধ্যায় যেতে। একবারে ডিনার সেরে ফিরবি। ”
মনটা ভরে গেল সৌমেনের। বহুদিন পর সন্ধ্যেটা আর একা কাটাতে হবে না। বলে উঠল, “যাবো ”

(২)
বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল দেবেশ। আগে কতবার এসেছে বাড়িটায়। গন্ধটা সেই একইরকম থেকে গেছে।
দেবেশ হাত ধরে টানল, “আয় আয়, বেলা অপেক্ষা করছে। ”
ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন সৌমেন। এ কোন বেলা!! অত সুন্দর মেয়েটা যেন এতটুকু হয়ে গেছে। গায়ের টকটকে ফরসা রঙে যেন একপোচ কালি!!মুখচোখ ভেঙে যেন মনে হচ্ছে বয়সের গাছপাথর নেই। মাথায় একটা রুমাল বাঁধা।
সৌমেনকে দেখেই একগাল হাসি। হাসিটা কিন্তু একইরকম আছে। বলল, “কী দেখছেন সৌমেনদা!!বেঁচে আছি এখনও পর্যন্ত। ক্যান্সার। কেমো চলছে। ”
সৌমেনের হাত ধরে দেবেশ বসিয়ে দিল। বলল, “তাও তো এখন অনেকটাই ভোলা রে। উঠে বসছে, কথা বলছে। শ্বশুরের ভিটেতে এসে খুব ভালো আছে। ”
গল্প শুরু হয়ে গেল। সব পুরনো দিনের কথা। কখন যে রাত হল, ডিনার সারা হল, বোঝাই গেল না।

(৩)
লম্বা লম্বা পা ফেলে ফিরছিলেন সৌমেন। নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিলেন দেবেশদের। নিঃসঙ্গতার সঙ্গে লড়াই আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের কী আকাশ পাতাল তফাত!! ওদের লড়াইটা কত যে কঠিন!!
আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। তারায় ভরা আকাশ। হালকা আলোয় ছায়াচ্ছন্ন পথ। সেই পথেই বহুদিন পর ওর হাঁটায় গতি এসে গেল।
-×-

আমার প্রকাশিত গ্রন্থ
আত্মবীক্ষণ(ছোটগল্প সমগ্র)
শোণিতকথা (উপন্যাস)
পরিযায়ী মেঘ ( উপন্যাস। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হবে )।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *