তীর্থের পথে পথে কোয়েলীর সাথে
তীর্থের পথে পথে কোয়েলীর সাথে
বীরভূমের এই লাল মাটির পথ খুব চেনা ।সেই শৈশব থেকে এ পথে গেছি বার বার । অনেক দিন পর আবার চলেছি সতীপীঠ ও শৈব তীর্থ বক্রেশ্বর ।
দুবরাজপুর রঞ্জনবাজার ,পন্ডিতপুর গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে সড়কপথে । মাটির বাড়ি , ছোট ছোট গ্রামের বাথানে গরু বাঁধা , তাল ,খেজুরের সারি , হলুদ বরণ সর্ষে খেত — বাংলার এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে যাই । অভুভব করি মাটির টান ।
মাত্র পনেরো কিমি পথ পেরিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ালো মন্দিরের গেটে । পুরনো সেই বক্রেশ্বরের সাথে আজকের অনেক পার্থক্য । গেট পেরিয়ে দুদিকে আলাদা স্নানের ঘাট ।ডানদিকে মেয়েদের ঘাট । কুণ্ডের জল স্নানের উপযোগী তাপমাথায় এনে এই স্নানাগারে ফেলা হয় । হাতির মুখ থেকে সেই গরম জল পড়ছে ।এখানে সবাই স্নান সেরে নিই ।এখানে গরমজলে স্নান শুধু আরাম নয় , বাত ব্যাধি দূর করে ।
এবার মন্দিরের দিকে রওনা দিলাম । দেখা হল চেনা পাণ্ডার সাথে । যাবার আগে পুজোর ডালা কিনে নিলাম দুটি মন্দিরের জন্য । এগিয়ে চলি । ডানদিকে পাপহরা ।একদিন পাপ হরা নামে নদী ছিল ।
পাঁচশো বছর আগে বক্রেশ্বর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ । নাম ছিল ডিহি বক্রেশ্বর । একসময় গুপ্ত কাশী নামেও পরিচিত ছিল । ঋষি অষ্টাবক্র মুনির সাধন স্থল ,সিদ্ধ পীঠ ।
বীরভূমের এই বক্রেশ্বর গ্রামটি প্রাচীন আর্য সভ্যতার এক নিদর্শন যার সাক্ষ্য প্রমাণ আজো দেখা যায় ।
একান্ন পীঠের মধ্যে সাতচল্লিশতম পীঠ এই বক্রেশ্বর । এটি শৈব তীর্থভূমিও । বক্রেশ্বরের মূল মন্দিরটি উড়িষ্যার রেখ -দেউল ভাস্কর্য শৈলীতে নির্মিত । মন্দিরের নির্মাণশৈলীতে মধ্যযুগীয় ওড়িয়া স্থাপত্যের শিল্পরীতি লক্ষ্য করা যায় ।
মন্দিরের প্রবেশের মুখে যে দুটি স্তম্ভ সেগুলো গুপ্তযুগের । একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৭৫৫ খৃস্টাব্দে দর্পনারায়ণ মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন । এখানে যে শত্রুর দ্বারা আক্রমণ হয়েছিল হরগৌরীর খণ্ডিত প্রস্তর বিগ্রহ তার সাক্ষী ।
ভেতরে পুজোর জন্য ডালা কিনে চেনা পাণ্ডার মাধ্যমে মহিষমর্দিনী মন্দিরে পুজো দিলাম । এখানে দেবীর ধাতুর বিগ্রহ । সতীর ভ্রুসন্ধি বা মন এখানে পতিত হয় । পাশেই আছে বটুক ভৈরব মন্দির ।
মহিষমর্দিনী যাবার পথে পড়বে ছটি উষ্ণ প্রস্রবণ আর একটি শীতল জলের কুণ্ড । বৈজ্ঞানিক মতে – ভু -গর্ভের লিথস্ফিয়ার স্তর ভেদ করে বিভিন্ন গ্যাসের চাপ আর তাপপ্রবাহে উপরিভাগে উঠে আসে উষ্ণ জলধারা – সেই উষ্ণ প্রস্রবণ ।
জলের মধ্যে আছে দুটি যৌগ — হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলিয়ে জুভেলাইন ওয়াটার তৈরি হয় ।
কুণ্ডের গরম জল পেটের অসুখ সারায় বলে শিশিতে করে বিক্রি হয় ।
ভৈরব কুণ্ড , ব্রম্ভ কুণ্ড , ক্ষার কুণ্ড , অগ্নি কুণ্ড ,সৌভাগ্য কুণ্ড ,সূর্য কুণ্ড – এই ছটি উষ্ণ প্রস্রবণ ঘিরে আছে নানা পৌরাণিক গল্প । এছাড়া আছে জীবৎস কুণ্ড যেটির জল শীতল ।
বক্রেশ্বরের মন্দিরের উত্তরদিকে পবিত্র উষ্ণ কুণ্ডটির নাম শ্বেতগঙ্গা ।এখানে গঙ্গা কুণ্ডের মধ্যে অবস্থিত । এইজলেই শিবের ভোগ রান্না আর অভিষেক হয়ে থাকে ।
এবার বাবা বক্রেশ্বরের মন্দিরের গর্ভ গৃহে প্রবেশ করি । ওপরে ধাতু আচ্ছাদিত বড় প্রস্তর বিগ্রহ । ওপরে অষ্টাবক্র মুনি আছেন আর নিচে আছেন কৃষ্ণ প্রস্তর নির্মিত বক্রেশ্বর শিব । এখানে ভক্ত ভগবানের চেয়ে বড় । প্রথমে ভক্তের পুজো হয় তারপর বক্রেশ্বরের পুজো । পাণ্ডারা চাইলেন দরিদ্র নারায়ণের সেবার জন্য কিছু দিতে ।প্রতিদিন এখানে ভোগের পর দরিদ্র মানুষদের খাওয়ানোর রীতি আছে । সাধ্যমত যে যা পারেন দান করেন ।
পুজো দিয়ে প্রণাম করে বাইরে এলাম ।বাবা বক্রেশ্বরকে চারিদিক দিয়ে বেষ্টন করে আছেন পঞ্চশিব । কুবেরেশ্বর , সিদ্ধেশ্বর , জ্যোতিরলিঙ্গেশ্বর , কালরুদ্রেশ্বর এবং জন্তেশ্বর ।
সামনে কিছু সিঁড়ি দিয়ে উঠে কালীমন্দির ।
মন্দিরের পাশে প্রাচীন অক্ষয় বট তার অজস্র ঝুড়ি নামিয়েছে ।এখানেই বটবৃক্ষের নিচে দর্শন পাওয়া যায় হরগৌরীর খণ্ডিত রুপ । এই স্থানটি সপ্তর্ষি আশ্রম নামে খ্যাত । পুরাণের সাত ঋষি এখানে এসে বক্রেশ্বরকে স্থায়ী রুপ দিয়েছিলেন । এই অক্ষয় বটের নিচে এখানের ভূমিপুত্র শ্রী শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর চরণ চিহ্ন আছে । প্রণাম জানিয়ে বসি সিমেন্টের বাঁধানো চাতালে । কিছুক্ষণ এই অক্ষয় বটের নিচে বসলে মনের শান্তি পাওয়া যায় ।
আরও কিছু দেখার আছে । গোপাল মন্দিরটি অপরুপ । চারিদিকে অনেক সাধকের আশ্রম আছে , সমাধি আছে ।
গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বক্রেশ্বর নদী ।কাছেই বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প ।
ইচ্ছে হলে ঘুরে আসবেন তাঁতী পাড়া থেকে । ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে তাঁত , গরদ , সিল্ক্ বালুচরী ,স্বর্ণচরী । কিনে নিতে পারেন ।
ফিরে আসি সেই পথ ধরে ।বারংবার প্রণাম এই ঐতিহ্যময় পীঠস্থানকে ।
তখন সূর্য তার নরম আলো ছড়িয়ে দিয়েছে মন্দিরের চুড়ায় , চারিদিকে ,এই শাশ্বত আকাশে ।
কিভাবে যাবেন –
হুল এক্সপ্রেস বা ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে চলে আসুন দুবরাজপুর । সেখান থেকে বাস , গাড়ি করে বক্রেশ্বর আসা যায় ।
বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে দূরত্ব ৫৬ কিমি । আড়াই ঘণ্টায় আসায় যায় বাস বা গাড়িতে । সিউড়ি থেকে ১৯ কিলোমিটার ।
এখানে থাকার জন্য আছে টুরিস্ট লজ , যুব আবাস , নানা হোটেল ।