নতুন আলো , নতুন প্রশ্ন — বিবেকানন্দ মণ্ডল
নতুন আলো , নতুন প্রশ্ন
— বিবেকানন্দ মণ্ডল
স্কুলে যাব বলে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি । একটি লম্বাচওড়া ছেলে এসে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলো — ‘ভালো আছেন স্যার ?’ কপালে হাত ঠেকিয়ে ওর প্রণাম ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে করতে ,মুহূর্তের ধন্দ কাটিয়ে চিনতে পারলাম ছেলেটিকে । কয়েকবছর আগের সেই ক্লাস ইলেভেনের লাস্ট বেঞ্চে বসা আশ্চর্য মুখটি স্পষ্ট চিনতে পারলাম – অপূর্ব। আশ্চর্য এই কারণে বলছি যে তার বাইরের পরিচিতির সঙ্গে ভেতরের অদ্ভুত বৈচিত্র !পেছন বেঞ্চের বিচ্ছু ছেলেদের সঙ্গে বসতো , বিচ্ছু বলেই মনে হত অথচ ক্লাসে কখনোই পাশে বসা সতীর্থ বন্ধুদের মতো দুষ্টুমি করতে দেখিনি ! আশ্চর্য হতাম কিন্তু কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও কখনো ঘাঁটানোর সাহস করতাম না । ওদের গ্রুপটাকে আমি ভালো করেই জানতাম ।ক্লাসের শান্তি বজায় রাখতে , সুষ্টু পাঠদান করতে সেটাই শ্রেয় মনে করতাম ।বেশভূষার মধ্যে অবশ্য যদিও এখনো পর্যন্ত ‘রক রক’ ছাপ তবুও অপূর্বের মধ্যে ক্যাকটাসের ফুলের মতো অপূর্ব আশ্চর্যজনক ছাপটি এখনও আছে । আমাকে আরো আশ্চর্য করে দিয়ে সে জানালো , ‘ স্যার আপনাকে অনেকদিন পর দেখে খুব ভালো লাগল । আপনাকে আগেও আমার খুব ভালো লাগত । আমি পুলিসের চাকরিতে জয়েন করেছি স্যার । আশীর্বাদ করবেন যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারি ।’ যেটুকু শ্রদ্ধার কথা সে মুখে উচ্চারণ করলো তা বেলা ন’টার নির্মল আলোয় অমলিনই মনে হল ।
মানবচরিত্র বিশ্লেষণ সত্যই বড় জটিল এবং আপেক্ষিকও বটে । আজ সহসা এই অনুভূতি নতুন আলো ফেলল যেন মনের ভূমিতে । আপেক্ষিক বলার কারণও আছে । মাধবীর মতো মুখরা মেয়েকেও দেখেছি ধাপে ধাপে ক্লাসের বয়সগুলি পেরিয়ে যখন উচ্চমাধ্যমিক দিল তখন তার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক আচরণগুলি প্রাকৃতিক নিয়মের মতো স্বাভাবিক ছন্দে বিকেলের মতো মধুর হয়ে গেল । মাধবী তখন সত্যই মাধবীলতা !
আবার বঙ্কিমবাবুর গোবিন্দলালের মতো ছেলেকেও দেখেছি । ক্লাসে ঢুকেই যার মুখটা দেখতে ইচ্ছে করতো ; যে না এলে পাঠদানের আনন্দ-উদ্দীপনা কিছুটা ম্লান হয়ে যেত তেমন অনেক অনন্ত-প্রশান্তের মতো ছেলে দেখেছি যারা বয়সের কোনো এক দুর্যোগে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে হারিয়ে গেছে নোনা জীবনের বালুতটে ! ওদের জন্যও মনের মাঝে আজ করুণাবিন্দু কেমন টলমল করে ওঠে ।
মনে এখন মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন কেঁপে কেঁপে ওঠে — যাকে আজ ঘৃণার যোগ্য মনে করে মুখ ফিরিয়ে আছি , সে কি সত্যই ঘৃণার পাত্র ? কিম্বা যে মেয়েটি নোংরামীর চরমে পৌঁছেছে তার মধ্যেও কি কোনোকিছুই মহনীয় নেই বা কোনো কালে তেমনটি হতে পারে না? ঠিক মাধবীর মতো ? তাহলে তাদের কি ঘৃণা করবো , নাকি ভালোবাসবো ? আজ অপূর্বের সাথে সাক্ষাত হওয়া মাত্র যে নতুন আলোক সঞ্চারিত হল মনের প্রান্তরে তাতে তো দোষ-গুণ নির্বিশেষে মাধবী-প্রশান্ত-অপূর্বকে ভালোবেসে বুকে ধারণ করতেই ইচ্ছে জাগছে । মনের এক কোন থেকে উত্তর আসছে — মানুষটাকে ভালোবাসো , দোষ-গুণ আপেক্ষিক , মনুষ্যচরিত্রও আপেক্ষিক ।
তবু দোষ বা গুণের , ভালো বা মন্দের মুখোমুখি হই যখন তখন নিরপেক্ষ ভাব বজায় রাখতে পারিনা কেন ? সে কি আমারই চরিত্রের নীচতা ? নাকি সেটাই স্বাভাবিক ? — সেই আশ্চর্য ছেলে অপূর্ব আজ আমাকে আরো এক জটিল এবং আশ্চর্য প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে তেমনি আশ্চর্য ছন্দে রক স্টাইলে হেলে দুলে চলে গেল …