তৃতীয় ব্যক্তি —- মীনা দে
প্রেমের নানা দিবস চলছে তাই প্রেম নিয়ে একটা লেখা । একটু অন্য রকম।
তৃতীয় ব্যক্তি
মীনা দে
প্রেমের কাব্য প্রথম লেখা, মনে হয় রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে। (ভুলও হতে পারি)। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনকে খুব নাড়া দেয়,আরও তো অনেক গোপিনী ছিলেন তাহলে কেন শ্রীকৃষ্ণ রাধারই প্রেমে পড়লেন। একটা কারণ হয়তো এটাই হতে পারে যে, সেই প্রেমের মাধ্যমেই শ্রীকৃষ্ণ এটাই বোঝাতে চাইলেন যে,প্রেম মানেনা বয়সের সীমারেখা প্রেম মানে না সামাজিক বিধি নিষেধ। তাই কিশোর প্রেমিক ধরা দিল তার থেকে বয়সে বড় আয়ান ঘোষের পত্নীর প্রেমে। ওদিকে শ্রী রাধিকারও একই অবস্থা হল। যদিও এটা সম্পূর্ণ ঈশ্বরীয় ব্যাপার তবু অনেক প্রশ্নের জবাব ধরা রইল।
এঁদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে রইলেন সেই সব অনেক গোপ গোপিনীরা।
আমার বক্তব্য বিষয় প্রেমের সাক্ষী স্বরূপ এই তৃতীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নিয়ে।
শুধু আমারই বা বলি কেন ,আমার মতো অনেকেই হয়তো এই প্রেমে সাহায্যকারী হয়েছেন বা প্রত্যক্ষ করেছেন। অনেক আগে আমাদের মেয়েবেলারও আগে থেকেই প্রেম করা শুরু হতো দুটি বাড়ির ছাদ অথবা বারন্দা থেকে চার চক্ষুর মিলেনে। দিনের কয়েকটা বিশেষ মুহূর্তে দেখা যেত চার চোখে চলছে প্রেম নিবেদন। তারপর সুযোগ আসতো দুর্গাপুজো এবং সরস্বতী পুজোর পুজো প্যান্ডেলে। তখন ‘কো এড’ স্কুল বা কলেজ সংখ্যায় দুটি একটি ছিল। এই পুজো প্যান্ডেল গুলোতে প্রেমিক প্রেমিকাদের একটু মিলনের সুযোগ করে দিত এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসকল, সকলের নজর এড়িয়ে। কিন্তু সে আর কতটুক সময়, প্রাণ চাইতো কত কথা বলতে। একটাই উপায় ছিল,প্রেমপত্রের আদান প্রদান। মেয়েদের তখন একা বাড়ির বাইরে যাবার অনুমতি মিলত না। এই প্রেমপত্র একের হাত থেকে অন্যের হাতে পৌঁছে দেবার ভার পড়ত অন্য কোনও তৃতীয় ব্যক্তির ওপর। অনেক কিশোর কিশোরী এই কাজে বেশ সিদ্ধহস্ত ছিল। অনেকে যে ধরা পড়ত না তাও নয়। তাদের হয়ত তখনি প্রেমের সমাধি হয়ে যেত। এই প্রেমপত্রের ভাষাও কোথাও কোথাও ছিল অতীব সু্ন্দর ও মধুর, কোথাও বা অতি হাস্যকর। আমার ভাগ্যগুণে প্রনম্য গুরুজন স্থানীয়ের এমন প্রেমপত্রও দেখার সুযোগ হয়েছে যা সত্যিই সাহিত্যগুণে উৎকৃষ্ট বলা যেতে পারে। প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরের মনের মণিকোঠায় পাকাপাকি স্থান করে নেবার জন্য আবেগের বন্যা বইয়ে দিত।এক একটা প্রেমপত্র যেন এক একটা আনবিক বোমা যা ফেটে গিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়েকে তোলপাড় করে দিত। আর একটা জিনিষ লক্ষ করা যেত, বেশির ভাগই এগুলোকে শত বাধা অতিক্রম করেও যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতো।যাদের চার হাত এক হবার সুযোগ আসতো তারা তো শ্বশুর বাড়ি পর্যন্ত তা বয়ে নিয়ে যেত স্মৃতি রোমন্থনের উদ্দেশ্যে কিন্তু যাদের তা হতো না তাদের সেগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়তে দেখা ছাড়া আর অন্য কোন উপয় ছিল না । এই তৃতীয় ব্যক্তির ভুলে এমন অঘটনও ঘটেছে যে একের হৃদয় যন্ত্রণার কথা অন্যের বুকে গিয়ে বিঁধেছে এবং সেখানেও প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম ঘটেছে। আমরা কয়েকজন কিশোরী তখন তক্কে তক্কে থাকতাম কিভাবে ঐ তৃতীয় ব্যক্তিকে হাত করে একবার সেই প্রেম পত্র খানা পড়ে নেওয়া যায়।তার কিছু বুঝতাম কিছু না বোঝই রয়ে যেত। সেই সময় প্রেম ছিল একটা ভীষন ভাবে গোপনীয় অথচ আনন্দের পসরা বয়ে আনার জিনিষ যা এখন এই ইন্টারনেটের যুগে একেবারেই তার মাধুর্য হারিয়ে ফেলেছে।
।