ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি —- গৌতম নাথ

ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি
গৌতম নাথ

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাসের একমাত্র নির্ভরযোগ্য দলিল হলো ‘রাজমালা’। ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের উৎপত্তি,ত্রিপুরার উত্থান, রাজত্ব,যুদ্ধ,বিজয়,পরাজয়,স্থাপত্য সবই লিপিবদ্ধ আছে রাজমালায়।যদিও রাজমালার কিছুকিছু ব্যাখ্যা ইতিহাসসম্মত নয়, তবু ত্রিপুরার আদি ইতিহাস সম্বন্ধে রাজমালা ছাড়া অন্য কোন লিখিত পাণ্ডুলিপি না থাকায় রাজমালাই একমাত্র ভরসা।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ত্রিপুরা জাতির নিজস্ব বর্ষপঞ্জিকা হলো ‘ত্রিপুরাব্দ’। এই পঞ্জিকা অনুসারে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি থেকে আগরতলার চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে খার্চী পূজা শুরু হয়। সাত দিনব্যাপী চলে এই পূজা অনুষ্ঠান এবং তাকে কেন্দ্র করে মন্দির প্রাঙ্গণে বসে মেলা৷ খার্চি পূজা বা খার্চি মেলা ও উৎসব হল চৌদ্দ দেবতার পূজা।

কথিত আছে যে মহারাজ ত্রিলোচন ছিলেন মহাভারতের যুদ্ধের সমসাময়িক।যুদ্ধে তিনি যুধিষ্ঠিরের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং বিজয়ের পর যুধিষ্ঠির একটি রূপার সিংহাসন ত্রিলোচনকে দান করেন যা অদ্যাবধি ত্রিপুরার রাজসিংহাসন রূপে উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদে রক্ষিত আছে। মহারাজ ত্রিলোচনই প্রথম কুলদেবতা চৌদ্দদেবতার পূজাপদ্ধতি প্রবর্তন করেন,যা অদ্যাবধি বর্তমান। এই চৌদ্দ দেবতা হলেন ১. সিবরাই (মহাদেব), ২. সংগ্রাংমা (কালী), ৩. হাচুকমা (বসুন্ধরা), ৪. সুকুন্দ্রাই (কার্তিক (দেবতা)), ৫. মুকুন্দ্রাই (গণেশ), ৬. তোয়বুকমা (জলদেবী বা বারুণী), ৭. মাইলুকমা (লক্ষ্মী দেবী), ৮. ইরিত্রা (অগ্নি দেব), ৯. বিরিত্রা (পবনদেব), ১০. কালাকতর (মহাকাল), ১১. কালারী (যম ), ১২ রন্দকা (কুবের), ১৩. দন্দকা (কামদেব) ও ১৪. বণিরক (অশ্বিনীকুমারদ্বয়)৷ এই ১৪ জন দেবদেবীকে এক বেদীতে প্রতিস্থাপন করে যে পূজা অনুষ্ঠান হয় সেটি ‘খার্চী পূজা’ নামে পুরো ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে৷ চতুর্দশ দেবদেবী প্রতিস্থাপিত মন্দিরকে অভিহিত করা হয় ‘চতুর্দশ দেবতার মন্দির’৷

এক সময় ত্রিপুরার রাজধানী ছিল বর্তমান আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে পুরাতন আগরতলা , যার অপর নাম পুরাতন হাভেলী।সেখানে স্থাপন করা হয়েছিল ত্রিপুরার রাজপরিবারের ১৪ জন কুল দেবতাকে। তাই এর নাম চতুর্দশ দেবতা বাড়ি।

পরবর্তী রাজারা রাজধানী স্থানান্তর করে বর্তমান আগরতলায় নিয়ে এলেও তাদের কুলদেবতারা সেখানেই রয়ে যায়। এই ১৪ জন দেবতার মধ্যে সারাবছর মাত্র তিনজন দেবতার পূজা হয়। বাকিদের মন্দিরে সিন্দুকের ভেতরে রাখা হয়। শুধুমাত্র খার্চি উৎসবের সাতদিন মোট ১৪ জন দেবতার পূজা হয় ও পূণ্যার্থীদের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

খার্চি শব্দটি ‘খার’ ও ‘চি’ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘খার’ কথার অর্থ হল পাপ এবং ‘চি’ কথার অর্থ হল পরিষ্কার বা মোচন করা। সুতরাং এই উৎসব হচ্ছে পাপ মোচনের উৎসব। ৩০০০ বছর আগে এই পূজার প্রচলন হয়েছিল এবং বর্তমানেও চলছে। এই পূজা মুলত ত্রিপুরার রাজ পরিবার এবং ত্রিপুরী রাজ চন্তাইদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসছে। চন্তাই কথার অর্থ হচ্ছে পূজারী বা পুরোহিত।রাজ চন্তাইরা বংশ পরম্পরায় নির্বাচিত হয়ে আসে।( তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)

রাজন্য আমলে শুরু হওয়া এই মেলা উত্তরপূর্ব ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন মেলা। প্রতি বছরই মেলায় লোক সমাগম বাড়ছে। খার্চিপূজা প্রাথমিক ভাবে ত্রিপুরীদের উৎসব হলেও বর্তমানে সব ধর্মের মানুষ এতে সমান ভাবে অংশগ্রহণ করে। ত্রিপুরার পাশাপাশি আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় জড়ো হয় মানুষ।
ত্রিপুরীরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আড়ম্বর সহকারে খার্চী পুজা উদযাপন করে থাকেন৷ রাজ্যে এ সময় সরকারি ছুটিও ঘোষিত হয়৷ খার্চী পুজোতে মোষ, পাঁঠা, শূকর, পায়রা ইত্যাদি বলি দেয়ার প্রথা প্রচলিত আছে৷ শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব এই সমন্বিত সাধন প্রণালী অনুযায়ী তান্দ্রিকাচারে খার্চী পুজো অনুষ্ঠিত হয়৷ বাংলাদেশে ত্রিপুরীদের জনজীবনে চতুর্দশ দেব উপবাস, কেউবা সংযমীব্রত পালন করে ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করে থাকেন৷

চতুর্দশ দেবদেবীর প্রত্যেকের শিরোপরে অর্ধচন্দ্র বাণ খচিত৷ মহাদেব ছাড়া বাকি ১৩ জন দেবদেবীর মুকুট স্বর্ণে নির্মিত৷ চতুর্দশ দেব-দেবীদের প্রধান মহাদেবের মুকুট রূপ্য নির্মিত এবং মহাদেবের বিগ্রহটি সবার বড়৷ ত্রিপুরী জাতি চন্দ্র বংশীয় ক্ষত্রিয় কূলজাত বলেই কুলীয় চিহ্ন হিসেবে দেব-দেবী মুকুটেও চন্দ্রধ্বজ খচিত হয়৷ খার্চী পুজা অনুষ্ঠানে বিশেষ গোপনীয়তা অবলম্বন করার রীতি প্রচলিত আছে৷ পূজা চলাকালীন যেদিন গভীর রাতে ‘হজাগিরি’ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় সেদিন রাজ পুরোহিত ছাড়া সাধারণের ঘরের বাইরে চলাফেরা করা বা বিচরণ করা নিষিদ্ধ৷
হজাগিরি’ শব্দের বাংলা অর্থ হয় ‘ভয়ঙ্কর রাত্রি’৷ তান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় এবং এ নৃত্যের মুদ্রা ১৪টি৷ ত্রিপুরা রাজ্যে আজও এ রীতি প্রচলিত রয়েছে৷ (ক্রমশঃ)
তথ্যসূত্র: Traditional Heritage, Wikipedia, বাংলাপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *