পান্না হলো সবুজ — পর্ব ৩ — কাজরী বসু

পান্না হলো সবুজ
পর্ব ৩
কাজরী বসু

…আপনি বাড়ির সব জায়গাতেই খোঁজাখুঁজি করতে পারেন। শুধু মানির ঘর বাদ দিয়ে। মানি খুব খুঁতখুঁতে মানুষ, নাড়াচাড়া হলে টের পাবেই আর ঠিক কিছু একটা আঁচ করবে। আমি আপনাকে এইটুকু গ্যারান্টি দিচ্ছি, মানির ঘরে বাপি কিছু রাখেনি।

কথামতো ঠিক বারোটায় পৌঁছে গেছি তিস্তাদের কেয়াতলার ফ্ল্যাটে। আজ তিস্তা কমলা টি শার্ট আর নাবিক নীল বারমুডা পরেছে, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা।

…কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন? আপনার মানির ঘর মানে আপনার বাবারই তো ঘর,সেখানেই যদি কোথাও কায়দা করে পাথরগুলো রাখেন আপনার বাবা! বরং ওটাই তো সুবিধেজনক ছিল ওঁর পক্ষে।

চোখ সরু করে তাকাল তিস্তা। একটু চুপ করে থেকে বলল..
… মানির চোখে পড়ে যাবার চান্স আছে জেনেও! শুনুন,আপনি আগে অন্য ঘরগুলো খুঁজতে শুরু করুন না। আমার ঘর দিয়েই নাহয় স্টার্ট হোক।
…বেশ। আচ্ছা,আপনি যখন থাকেন না, আপনার ঘর তখন ব্যবহার করেন কেউ?
…না,কিন্তু ঘর খোলাই থাকে। সকালে বিনু মাসি ঝাড়ু দেয়,মোছে,ডাস্টিং করে। আসুন,আমি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।

লিভিং এর বাঁ পাশের ঘরটাই তিস্তার। ঘরটা খুব যে একটা গোছানো তা নয়, বাঁ দিকের দেয়ালে হ্যাঙারে ঝোলানো মেয়েদের পোশাক,খাটের উপর বইপত্র খোলা পড়ে আছে, ল্যাপটপ রয়েছে, একটা গোলাপি রঙের টেডি গড়াগড়ি যাচ্ছে।

….এই টেডিটাই আপনার ডিপি না?
…..হ্যাঁ,আমার ছোট্টবেলার পাশবালিশ।
……কিন্তু ডিপিতে এর ছবি কেন?
……কারণ আমার ইচ্ছে।
…..সারা বাড়ি জুড়ে আপনার এই সব পুতুল দেখছি। আপনি এখনো পুতুল খেলেন?
…..এগুলোকে পুতুল বলে? সফট টয়কে আপনি বলছেন পুতুল?
…. ও তাও তো কথা। আচ্ছা এই পুতুলগুলোর মধ্যে মণিমাণিক্য ভরে রাখেননি তো আপনার বাবা?
….একবার আমিও তা ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা হতে পারে না। আমার সফট টয় শ খানেকের কম নয়। আর এগুলো আমার খুব প্রিয়। বাপি এগুলোর মধ্যে পাথর লুকিয়ে রাখবে? না, তা কখনোই করবে না,কারণ সেক্ষেত্রে আমায় সব কটাকে খুলে ছিঁড়ে নষ্ট করে দেখতে হবে। পুরোপুরি মাথা খারাপ না হলে এরকম কথা কেউ ভাবে না। বাপি আর যাই হোক,সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ছিল।

….আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী দেখছি। তা সত্ত্বেও পাথরগুলো খুঁজে পেলেন না?

….বাপির বুদ্ধি যে আমাকেও টেক্কা দিয়ে গেছে। এবার আপনার বুদ্ধির দৌড়টা দেখা যাক।

ঘরের ডানদিকে টেবিলে একটা পুরোনো ঢাউস ডেস্কটপ। দেয়াল জুড়ে ওয়ার্ডরোব। একপাশে দেয়ালে একটা আলমারি জুড়ে বই, অন্য একটা কাচের শোকেস ভর্তি পুতুল আর খেলনা।

…আচ্ছা আপনি ওয়ার্ডরোব খুঁজেছেন ভালো করে?
…অন্তত একশোবার সব নামানো হয়ে গেছে। পাইনি কিছু। আর ছোট ছোট স্টোন ওয়ার্ডরোবে বাপি কোথায় রাখবে বলুন তো!
…ভিতরের পুতুলগুলো?
…..দেখেছি সব। একটা জিনিস বুঝেছি,বাপি সাধারণ কোনো জায়গায় লুকিয়ে রাখেনি ওগুলো। কিছু একটা স্পেশাল ব্যাপার আছেই। আর সেটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।

খাটের মোটা গদি নিখুঁত ভাবে সেলাই করা। এ গদির সেলাই খুলে তুলোর মধ্যে ভরে দেন যদি? সেটা কি সম্ভব? মনে হয়না। তুলোর মধ্যে ভরলে তো হারিয়েই যাবে,এত কঠিন আর দুর্ভেদ্য হবে সব কিছু…নাহ,অন্যভাবে ভাবতে হবে।

…আমি যেখানে যত ড্রয়ার আছে সব পরীক্ষা করেছি। আমার যত জুয়েলারি বক্স আছে,খুঁজেছি। নেই কোত্থাও।
…হুম। ঠিক আছে আমি দেখছি কোথায় খোঁজা যায়।

তিস্তা আর আমি দুজনে মিলে তল্লাশি চালাতে শুরু করলাম।
তিস্তা তো পায়নি,আগেই বলেছে। আমি যে এভাবে পাব,সেই ভরসাও আর পাচ্ছি না তেমন। পণ্ডশ্রম হবে মনে হয় সবটাই।

….আচ্ছা তিস্তা,আপনার বাবার কোনো ডায়েরি বা খাতা টাতা কিছু ছিল?
…না,আমি তো জানি না।

উপর উপর যতটুকু খোঁজাখুঁজি করা যায় খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ঘর থেকে বেরোতে যেতেই ওয়াল হ্যাঙ্গিং এর দিকে চোখ গেল।
….আচ্ছা,এইটের মধ্যে দেখেছেন কি?
…হ্যাঁ,ওখানে শুধুই চিঠি আর কাগজের মেলা।
…একবার নামাই?
….হ্যাঁ,প্লিজ..

ওয়াল হ্যাঙ্গিংটা নামিয়ে বসার ঘরে ডিভানের উপর ওটা নিয়ে বসেছি। তিস্তা চা বানিয়ে আনল।
“নিন, একটু গলা ভেজান।”
…আমি নাহয় লাঞ্চ করেই বেরিয়েছি,আপনি খাবেন না?
…আমি তো লাঞ্চ করি না! সকালে প্রোটিন শেক খাই,আবার সেই রাত আটটায় ডিনার।
এতক্ষণে পরিষ্কার হলো তিস্তার নির্মেদ চেহারার রহস্য।

ওয়াল হ্যাঙ্গিং এ মনে হয় সারা সংসার ভরা আছে। কবেকার ইলেক্ট্রিসিটি বিল,কবেকার বাজারের ফর্দ সব কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখা।
তিস্তা বলল,”আপনি সার্চ করুন,আমি ঘরে আছি,দরকার মনে করলেই হাঁক দেবেন।

ওয়াল হ্যাঙ্গিং ঘাঁটতে ঘাঁটতে থমকে গেলাম। হাতে লেখা কয়েকটা বাজারের ফর্দর মধ্যে মধ্যে লিখে রাখা কয়েকটা করে লাইন, ফর্দর হস্তাক্ষর আর এই হস্তাক্ষর আলাদা মনে হলো! হাতের লেখাটাও যেন..
হ্যাঁ,কালকের ওই চিরকুটের মতো না!
পকেটের মধ্যেই রয়েছে,বের করে দেখতেই ক্লিয়ার কাট বোঝা যাচ্ছে। একই লেখা।
আর এখানেও ছড়া।

তুমিও যেমন মিষ্টি
তেমনটা এই পিস টি।
কিন্তু তুমি এও কি জানো
ওর যে সজাগ দৃষ্টি!

মনের মধ্যে তখন একটাই কথা…
এগুলো ছড়া নয়,সূত্র।
কিন্তু হাতের লেখাটা কার?

ঘাঁটতে থাকলাম অন্যান্য চিঠিপত্র। না, সেরকম কিছু পাচ্ছি না।

ধরে নিলাম লেখাটা তিস্তার বাবার। তিনিই এখানে ওখানে সূত্র লিখে রেখেছেন। পরে হয়ত মেয়েকে দিয়ে যেতেন,সময়টা আর পেলেন না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো,এই সূত্রগুলো কিসের ইন্ডিকেশন? কী বলার জন্য এই ইঙ্গিতগুলো এসেছে?
কবিতা লেখা পাতাটা টুক করে ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে ভরে ফেললাম।

এবার বেরোতে হবে। তিস্তার দেওয়া সময়সীমা প্রায় শেষ। আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

তিস্তাও ঘর থেকে বেরোল।
“ওই যে বলছিলেন না,একটা পাতলা নোটপ্যাড মতো ছিল,আমার ডেস্কটপের নিচের ড্রয়ারে। বাপির হাতের লেখা বলেই মনে হচ্ছে।”
নোটপ্যাডটা নিয়ে বললাম,
…এটা আমার কাছে রাখছি।আবার কাল আসছি তাহলে। কাল কিন্তু একবার আপনার মানির ঘরটা দেখতে চাই। খুব সাবধানেই খুঁজব। উনি টের পাবেন না।

…সে তো বুঝলাম,কিন্তু মানির ঘরে আপনি কী পাবেন আমার তা মাথায় ঢুকছে না। মানির ঘরে তো বাপি কখনো যেতই না, যে ঘরে ঢুকতই না,সে ঘরে জেম লুকিয়ে রাখবে কীভাবে? জীবনেও ও ঘরে ঢোকেনি বাপি।
….মানে?
একটু চুপ করে থেকে তিস্তা বলল,
….বাপি আর মানির মধ্যে কোনো কনজুগাল রিলেশনশিপ তো ছিলই না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *