বটেশ্বর কাণ্ড —- তনুজা চক্রবর্তী

বটেশ্বর কাণ্ড

তনুজা চক্রবর্তী

2

সেই বটেশ্বর যার জাল আর নৌকা নিয়ে জনা পঞ্চাশ জেলে রোজ উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি দিত মাছ ধরার জন্য, কখনো দুদিন তো কখনো চারদিন কখনো বা গোটা সপ্তাহ লেগে যায় পরিমাণ মতো মাছ ধরে তীরে ফিরতে । তবে সবাই একসাথে না বেরিয়ে আগুপিছু সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার
জন্য কোনো না কোনো নৌকা রোজই কিছু মাছ নিয়ে তীরে হাজির থাকে সকালের দিকে । তাই বটেশ্বর কেও হাজির থাকতে
হয় কি মাছ ধরা পড়ল তা জেনে তার দরদাম করে জেলেদের ঠকিয়ে সস্তায় তাদের ধরা মাছ কেনার জন্য । এই কেনাবেচার মধ্যেও নানারকম হিসাব নিকাশ চলতে থাকত রোজ, বটেশ্বরের জাল নৌকার ভাড়া বাদ দিয়ে তারপর জেলেদের ধরা মাছের দাম তাদের দেওয়া, সেখানে যত কম দিতে পারবে ততই তার লাভের পরিমাণ বাড়বে। এর মাঝেও তার তির্যক দৃষ্টি থাকত জেলেদের নৌকার দিকে পাছে তারা কিছু মাছ সরিয়ে অন্য ফড়েদের কাছে বেচে দিতে না পারে। কারণ প্রতিদিন অনেক বটেশ্বরই সমুদ্রের ধারে মাছের আড়তে জমা হয় মাছ কেনা বেচার জন্য । কে বেশি লুটতে পারে তার প্রতিযোগীতা চলে।
বটেশ্বর বেশ স্বাস্থ্যবান লোক, কুস্তিগীর বললেও কম বলা হবে না, তবে উচ্চতায় বেশ ছোট। সঙ্গে চোখটা বেশ বড়ো বড়ো আর রাশভারী গলার আওয়াজের জন্য তার আশেপাশের লোকজন তাকে বেশ সমীহ করে চলত, আর্থিক দিক দিয়েও অন্য আড়তদারদের থেকে বেশি স্বচ্ছল হওয়ায় সমুদ্রের তীরটাও তাকে সবচেয়ে বেশি মেনে চলতে বাধ্য হত। অর্থাৎ জোর যার মুলুক তার।
সারাদিনের কাজকর্ম মিটিয়ে প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত আটটা বেজে যেত বটেশ্বরের। কাজ শেষে দুপাত্র দেশী মদ সেবনের ফুরফুরে আমেজ আর অন্য আড়তদারদের সঙ্গে তাস পিটিয়ে সময় কাটানো কিছু সরস মুহূর্ত তার সঙ্গী হত ।
জেলে পাড়া টপকে বেশ খানিকটা পথ জঙ্গলে ঢাকা আর তারপরে পাকা রাস্তায় উঠে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে তবে বটেশ্বরের পাঁচিলে ঘেরা দোতালা বাড়ি, সেই পথটুকু সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতেই রোজ তার বাড়ি ফিরত।লোকটাকে বাইরে থেকে দেখলে অর্থাৎ তার পোশাকের ধরণ দেখে যে কেউ বলবে অত্যন্ত কৃপণ। কিন্তু আদৌ সে তা ছিল না। লোকটার সব শৌখিনতা শুধুমাত্র তার বাড়িকে ঘিরে থাকা আটকাঠা সম্পত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেখানে বাইরের কারো প্রবেশের অধিকার নেই, একান্তই নিজস্ব জগত ওটা বটেশ্বরের ।তাও গ্রাম্য পরিবেশে এইভাবে কোনো কিছুই চেপে রাখা যায় না বলেই হয়তো অনেকেরই জানা ছিল তার শখ সৌখিনতা সম্পর্কে। শোনা যায় তার ওই পাঁচিল ঘেরা জায়গাটার মধ্যে নানান দামি দামি রকমারি ফল ও ফুলের গাছ ছিল। বটেশ্বরের একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ছিল। তারা এবং বটেশ্বরের বউ যখন বাড়ির বাইরে বেরত,তখন একটা বড়োসড়ো লাল রঙের গাড়ি ছিল তাদের যাতায়াতের মাধ্যম। কোনো সময় পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করতে কেউ তাদের দেখেনি। বাড়ির ভেতরে যারা কাজ করত,অর্থাৎ দুজন মালি,একজন রান্নার লোক,একজন ড্রাইভার ও একজন দারোয়ান তারাও তার বাড়িতেই থাকত। এ থেকে বোঝাই যাচ্ছে বটেশ্বরের যেটুকু কিপটেমি করা তা শুধুমাত্র তার নিজের সঙ্গে।
ওর যাতায়াতের পথের মানুষরা মোটামুটি সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছিল এমন একজনকে দেখতে যার আড়তে যাওয়ার সময় ছোটো করে পরা ধুতি আর হালকা ঘিয়ে রঙের ফতুয়া থাকত পরণে, সঙ্গে বাঁহাতে ধরা একটা চটের থলে যা বেশ বড়োসড়ো । আর ফেরার সময় সেই থলে কখনো মূলোর শাক, কখনো সজনে ডাটা অর্থাৎ সময়ের সবজি থলে থেকে মাথা বার করে ফেরার পথে সবাইকে টাটা করত। শুধুই কি টাটা করত নাকি কারো কারো জিভের জল গড়াতেও সাহায্য করত তা জানার কোনো উপায় নেই। সবজি ছাড়াও থলের ওপর দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঝুলত এক একদিন এক এক রকমের জ্যান্ত মাছ।কোনো কোনোদিন কিছু কিছু জেলে নৌকা বিকেলেও মাছ নিয়ে ফিরত । আর সেই মাছ থেকেই দু-একটা মাঝেমধ্যেই বটেশ্বরের বাড়ির লোকের মন ও জিভের স্বাদ মেটানোর জন্য তার সঙ্গী হত। অনেকেরই লোভ পড়ত সেইসব মাছে, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস দেখাত না বটেশ্বর কে। অনেকের অনেক প্রশ্ন গলা বেয়ে জিভের ডগায় উঠে এসেও ঢোকের সঙ্গে ফিরে যেত রোজ। বটেশ্বর জমিদারের মতই প্রতিদিন তার জীবন চালাত, তার মর্জির বাইরের কোন কাজই তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারত না।সেও কোনো উপদ্রব ছাড়া নিজের যাতায়াতটাকে বেশ উপভোগ করত।
বেশ চলছিল বটেশ্বরের নিত্যদিনের রাজকীয় জীবনযাপন । কিন্তু কিছুদিন যাবত বটেশ্বরের কেমন যেন মনে হতে লাগল কেউ একজন তার ফেরার পথে বাড়ি অবধি তার পিছু নিচ্ছে ! মাঝে মাঝেই কাউকে যেন হঠাৎই সরে যেতে দেখত, ফিসফিসে কিছু কন্ঠস্বর ও মাঝে মাঝেই তার কানে আসত । মনের ভুল ভেবে সে অত পাত্তা দিতনা , এটা হত ওই জঙ্গলের পথটুকু পার হওয়ার সময়ে । শুকনো পাতার ওপর পা পড়ার আওয়াজ দুই একদিন তার কানে এসেছে , তখন দুই একবার তার শরীরে ভয়ে কাঁটা যে দেয়নি তা নয় , কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তার মনই তাকে প্রবোধ দিয়ে বলেছে, এসব ক্ষুদ্র জিনিসে বটেশ্বরের মতো লোকের ভয় পাওয়া কোনো ভাবেই উচিত নয়। তখন একটু বেশি সাহসী হয়ে আশপাশে যতদূর দেখা সম্ভব সেই মত চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়েও নিয়েছে সে। কাউকে না দেখতে পেয়ে সে আবার বাড়ি মুখো হয়েছে । এটা বেশ দিন পনের ধরেই চলছিল, কাউকে বলবে বলবে করেও বলা হয়ে ওঠেনি তার।হয়তো বলতে লজ্জা পেয়েছে। আর বলবেই বা কাকে? বাড়িতে বললেই বউ ভিরমি খাবে, সঙ্গে একজন লোক নিয়ে তখন যাতায়াত করতে বাধ্য হবে সে। আর ছেলেমেয়েরা শুনলে লুকিয়ে হাসবে বাবা ভূতের ভয় পাচ্ছে ভেবে। হয়তো এটা সে করেছিল কিছুটা নিজের গাঁট্টাগোট্টা শরীরের অহংকার, একটু বেশি সাহস আর জেদ থেকে!কোন পুরুষ নিজের চেহারা আর মেজাজ কে ছোটো করতে চায় ! সঙ্গে পাড়ার লোকেদের তার শরীর নিয়ে আলোচনার কথাও তার কানে অল্পস্বল্প যা আসতো , তা শুনেও বটেশ্বর নিজেকে বেশ শক্তিমান ভাবতে শুরু করেছিল । খানিকটা সেই কারণেও বোধহয় শরীর আর মন থেকে ভয়কে খুব সহজেই তাড়াতে পেরেছিল । কোনো কোনো দিন আবার তার এও মনে হত,আজ দুপাত্তরের জায়গায় চার পাত্তর হওয়ার জন্যই হয়তো মাথার মধ্যে এইসব ভুলভাল জিনিসের আবির্ভাব ঘটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *