তীর্থের পথে পথে —- কোয়েলী ঘোষ।
তীর্থের পথে পথে — ১
কোয়েলী ঘোষ।
————————–
পায়ের বেড়ি ভেঙে আবার চলেছি তীর্থের পথে ” এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে ” । যখন তিনি যেদিকে নিয়ে যান আমরাও বেরিয়ে পড়ি তীর্থ থেকে তীর্থান্তরে ।
একদল তীর্থযাত্রী রিষড়া প্রেম মন্দির আশ্রমের ভক্ত শিষ্যের দল আর মহারাজদের সাথে চলেছি । এবার যাত্রাপথ দক্ষিণ ভারতের দ্রষ্টব্য স্থান ।
” আমাদের যাত্রা হল শুরু
এবার ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার ‘ …
দুপুর দুটো পঞ্চাশে ট্রেন করমন্ডল এক্সপ্রেস । তার অনেক আগেই হাওড়া স্টেশনে এসে জমায়েত হয়েছি। কিছু কিছু কাজ আছে , যেমন টুপি , ব্যাচ ইত্যাদি নিয়ে সেখানেই পরে ফেলতে হবে । সেখানেই লেখা আছে নাম ঠিকানা ছবি । কেউ কেউ হারিয়ে যেতে পারেন বা হারিয়ে যান কোথাও কোথাও , তখন ফোন নম্বর দেওয়া রইল কার্ডে , যাতে ফোনেও যোগাযোগ করা যায় । তীর্থ যাত্রায় অনেক বয়স্ক মানুষ থাকেন যাঁদের নিয়ে যাবার কেউ নেই তাঁরাও চলেছেন একসাথে । স্টেশন অবধি প্রিয় জনেরা এসেছে পৌঁছতে । পাশে যে বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন তাঁর গায়ে জ্বর বললেন — বাড়িতে বললে কি আর আসতে দেবে বলো ? আর কি সুযোগ হবে ?
বললাম .. ভালো করেছেন , ওষুধ খেয়ে চলুন ।
করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি এসে দাঁড়াতেই স্টেশন সরগরম হয়ে গেল । নিজের নিজের সিট খুঁজে ভারি ভারি ব্যাগ তুলে গুছিয়ে বসতে বসতে ট্রেন ছাড়ল । যে যার গুরুর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম ।
তীর্থের পথে পথে — ২
‘ অমৃতের সন্তান
পিছনেতে নয় ,সূর্যের দিকে ফিরিয়া দাঁড়াও দেখি
প্রাণ ভরে করো জ্যোতির সুরভি
আনন্দে আঘ্রাণ ”
ট্রেন চলেছে –ট্রেন ছুটছে –কত না যাত্রী , বসে আছি জানলার ধারে ,চোখ মেলে আছি বিস্মিত । নিমেষে উধাও প্রান্তর ,বনভূমি , জীবনের পদচিহ্ন এঁকে বয়ে চলা নদী , আকাশের বুকে বিলীন পাহাড় , কত অজানা ফুল ফোটে পথের ধারে .
..হে বিশাল প্রেম , আমার দুটি চোখ প্রসন্ন হয়ে ওঠে । সন্ধ্যা নামে ,দূর আকাশে ভালবাসার টিপ এঁকে দিয়ে যায় ।
” মন্দিরের পথ
তুমি কি ডাকছো সব যাত্রীকে
দু ‘ পাশের অন্ধকার ঠেলে
তারা চলছে তো চলছেই
আমিও তো চলছি ….”
একসময় যাত্রাপথ শেষ । পরের দিন সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছলাম চেন্নাই । তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাই । বিশাল স্টেশন চত্বরে নেমে পড়েছি ।
কত মানুষ চলেছেন চেন্নাই চিকিৎসার জন্য । শিল্প সংস্কৃতির পীঠ স্থান এই তামিল নাড়ু রাজ্য । পর্যটকেরা আসেন অসাধারণ শিল্প মন্ডিত মন্দির , সমুদ্র অরণ্যে র টানে ।
সবাই মিলে একসাথে ট্রেন থেকে নামলে বোঝা যায় কতজন যাত্রী । এখানে স্থান অনুযায়ী সবাই আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে যায় । একজন দায়িত্বে থাকেন । এবার গাড়ি করে এসে আমরা সবাই হোটেলে এসে উঠলাম ।
চেন্নাই আমি আগেও এসেছি । এখানে অনেক কিছুই দেখার আছে । দীর্ঘ সৈকত মেরিনা বিচ , লাইট হাউস , মিউজিয়াম , কপালেশবর শিবমন্দির , মিউজিয়াম , স্নেক পার্ক …
কিন্তু আমরা কাল সকালেই যাব মাদুরাই । রান্নার জন্য আশ্রমের ভাইরা থাকেন । তাঁরাই নিচের একটা বড় জায়গায় রান্না চাপিয়ে দিয়েছেন । ভালো করে স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা নিজের নিজের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
মাদুরাই যাত্রা
বড় বড় চারটি বাস এসে গেল সকালেই । সব ব্যাগ তার পেটে ঢুকিয়ে নিজের নিজের সি টে বসে শুরু হলো যাত্রা । পৌঁছব সেই রাতে । অনেকখানি পথ , প্রায় ১১ ঘণ্টা । তামিলনাড়ু ট্যুরিজমের বাস খুব ভালো । পথের ধারে ছবি তুলতে তুলতে ছবির মত পাহাড় , গ্রাম দেখতে দেখতে বেশ রাতে পৌঁছলাম মাদুরাই । খাওয়ার জন্য পথে বাস থেমেছিল ।
তীর্থের পথে পথে —৩
” পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়
আমি অভয়মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায় ”
দীর্ঘ পথের শেষে বাস এসে দাঁড়িয়েছে মাদুরাই যাত্রী নিবাসের সামনে । বিরাট বড় এই যাত্রী নিবাসের মাঝে বেশ বড় চত্বর । সুন্দর একটি গনেশ মূর্ত্তি। গেট দিয়ে ঢুকে তিনদিকে তিনতলা অবধি ঘর । বাস থেকে ব্যাগ নামিয়ে লিফটে করে ওপরে ওঠা । খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘর ,এক একটি ঘরে তিনজনের থাকার ব্যবস্থা । তিনতলার ছাদে চা ,রান্না ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে ।
মাদুরাই ২৫০০ বছরের পুরনো এক প্রাচীন সমৃদ্ধশালী নগরী ।পুরনো নাম ছিল মধুরাপুরী । অতীতে মাদুরাই ছিল রাজধানী । এখানেই সেই বিখ্যাত মীনাক্ষী আম্মান মন্দির যা শুধু তামিলনাড়ু নয় , দাক্ষিণাত্যের তথা ভারতের গর্ব যে দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যশৈলীর কাছে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় ।
পরের দিনের যাত্রা কোদাই কানাল । মাদুরাই আর মীনাক্ষী মন্দির তারপরের দিনের জন্য রইল । রান্না শেষ হলে ছাদে খাবার ডাক পড়ল । এত মানুষের জন্য আয়োজন করা সামান্য কথা নয় । নিজের থালা বাটি নিয়ে খাবার নিয়ে তারপর ধুয়ে রাখা নিয়ম । সবাই খুব ক্লান্ত । পরের দিন সকালেই আবার যাত্রা দক্ষিণের জনপ্রিয় শৈলশহর কোদাইকানাল ।
পরের দিন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছি ।যাত্রী নিবাসের সামনে সাইকেল নিয়ে এসেছেন তামিল দুজন ছেলে । বাচ্চাদের ছোট ছোট জামা ,মেয়েদের ফ্রক ,ছেলেদের জামা ।কলকাতার চেয়ে অনেক সস্তা কটনের জামাকাপড় ।ব্যস , সব মনে পড়ে গেল ছোট ছোট নাতি নাতনির মুখ । কেনাকাটি শুরু হয়ে গেল আর আমিই বা বাদ যাই কেন ?
দেখলাম মানুষ এনারা খুব ভাল । গায়ের রঙ কালো , ওপরে শার্ট ,নিচে ধূতি ।বিশেষ কোন দরদাম করতে হল না । আশেপাশে তখন পুরী ভাজা হচ্ছে ।শালপাতায় ঠোঙ্গায় চলছে বেচাকেনা । এঁদের সাথে কথা বলতে গেলে তামিল ভাষায় কথা বলতে হবে । এখানে তফাৎ এই যে নিজের ভাষাকে তারা এতোটাই ভালবাসেন যে সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে সব তামিল । এবার কেনার জন্য ইশারা এবং আঙুল দিয়ে বোঝাতে হয় । দিব্যি সুন্দর বুঝে নেন ।
ততক্ষণে বাস এসে হাজির । বয়স্ক মানুষদের সামনে বসানো তারপর অন্যরা যে যেখানে পারে । বাস চলতে শুরু করেছে … যাত্রা কোদাইকানাল ।