এবার বোধনে —– তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী —–
এবার বোধনে
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
***************************************
আর মাত্র দেড় সপ্তাহ বাকি মহালয়ার। মাতৃ মূর্তি মন থেকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও ঠিক মনের মতো পারছে না কেন?? নিজের মায়ের কথা মনে করে আর পুরোনো ক্যালেন্ডার দেখে নাক , ঠোঁট, চিবুক, কোমর, পায়ের পাতা, সবই তো… সবই তো… তাও কেন মা কে তার সম্পূর্ণ মাতৃ রূপে গড়তে পারছে না মহাদেব!!
চরম আর্থিক সংকটে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করতে চেয়েছে তো সে মা’কে ধরেই… মা’ কে গড়ে।
কিন্তু মা যে ধরা দিচ্ছেন না মহাদেবের তৈরি মাটির মূর্তি তে….
চরম দৈন্যতা আর প্রতিমা কেনার বরাত না পেয়ে মহাদেবের মন বড় অস্থির। ঘুম আসে না রাতে… মাঝরাতে গিয়ে দাঁড়ায় অর্ধ নির্মিত মাটির মূর্তির কাছে। মনে মনে বলে ‘এসো মা, সব দুঃখ কষ্ট দূর করতে, অশুভ শক্তির বিনাশ করতে এসো মা, মাটির পুতুল থেকে মা হও….. প্রতিমা… প্রত্যেকের মা, হারি না যেন কিছুতেই’
ভোরের আকাশ একটু একটু করে গেরুয়া হচ্ছে। ভাঙা ঘরের মাটির দাওয়ার এককোনে বসে একদৃষ্টে মাটির মূর্তির দিকে তাকিয়ে মহাদেব। এমন সময় গলা খাঁকাড়ির আওয়াজ। পাড়ার ক্লাবের দুজন কর্তা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। মুখে জোর করে হাসির রেখা নিয়ে সামনে আসে মহাদেব।
‘ তুই প্রতিমা গড়ছিস খবর পেয়ে এলাম। এবার তো সবই অন্যরকম। ঠাকুর বায়না করতেই পারা যায় নি অতিমারী, আম্পান আর লকডাউনের জন্য। তাই তোকেই বায়নার টাকা দিয়ে যাচ্ছি। মহালয়ার একমাস সাতদিন পর বোধন। সেদিন এসে প্রতিমা নিয়ে যাবো।’
এ কি শুনছে সে…. বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের কান, চোখ কে…. মা সত্যি সত্যি এলেন মাটির দাওয়ায়… পাঠালেন দেবদূত মানুষের বেশে…. বায়নার টাকা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মহাদেব। তারপর হাতজোড় করে ওনাদের বলে,’ দুইখান প্রতিমা গড়ছি দাদা। একটা আপনারা নিয়ে কি যে উপকার করলেন তা আর কি বলি, তবে আরেকটা প্রতিমা যদি চেনা পরিচিত কোনও ক্লাবকে বলেন নিতে তো আর কিছু টাকা আসবে হাতে।’ ওনারা আশ্বস্ত করে ফিরে যান।
মাটির মূর্তির সামনে এসে দাঁড়ায় মহাদেব। ভোরের সূর্যর গেরুয়া আভায় মাটির মূর্তি এখন প্রতিমা নয় ‘মা’… স্মিত হাসি ঠোঁট থেকে চিবুক, গাল সব জায়গায়। হাতে তুলে নেয় রং-তুলি। মায়ের চোখের তারায় ফুটিয়ে তুলবে খুশি, যে খুশি আজ মা স্বয়ং তাকে দিয়েছেন আঁচল থেকে ঢেলে…. স্কুল থেকে ফিরে গরম ভাত খেয়ে কার্তিক লাটাই ঘুড়ি নিয়ে মাঠে দৌড়ে যাবে। ভাঁড়ারে চাল, ডালের কৌটো ভর্তি করে গুছিয়ে রাখবে মায়া, তার বড় আদরের দুখিনী বৌ।
খুব সামান্য চাওয়া স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে যাবে….
আগের কথা:-
পুকুর ধারে এক ফালতি জায়গায় মাটির গাঁথনির উপর টালির চালের ঘর মহাদেবের। বৃষ্টি তে দেওয়াল ভেঙে পড়েছে কিন্তু সারানোর সামর্থ্য নেই তার। সারাবছর এর ওর জমিতে কাজ করে আর মাছ টাছ ধরে দিন গুজরান। এই বছর তো সব দিক থেকে সব্বোনাশ। এক মারণ রোগের ঠেলায় কাজ পাট নেই। একদিন একবেলা খাবার জোটে তো তিনদিন উপোস। তার সাথে দোসর এলো আম্পান। তুমুল ঝড় বৃষ্টিতে ভেঙে গেছে কত বাড়ি ঘর। নোনাজলে নষ্ট হয়েছে চাষের জমি। বড় অসহায় অবস্থা গ্রামের গরীব গুর্বো মানুষের।
তবে কিছু এন জি ও সক্রিয় হওয়ায় গত দু তিন মাস অভুক্ত থাকতে হচ্ছে না গ্রামের কাউকে। কত দূর দূরান্ত থেকে সহৃদয় মানুষ কষ্ট করে এসে খাবার এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু টাকা তো নেই হাতে একটাও। দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। আর দশদিন পর মহালয়া। খুব ইচ্ছে প্রতিবারের মতোই এবারও বৌ মায়া আর পাঁচ বছরের ছেলে কার্তিকের জন্য নিজের রোজগারের টাকায় নতুন শাড়ি আর জামা প্যান্ট কিনবে। এন জি ও গুলো দেবেই হয়তো…. তাও স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে নিজের রোজগারের টাকায় বচ্ছরকার উৎসবে কিছু তো কিনবে।
স্কুলে পড়ার সময় হাতের কাজ শেখার ক্লাসে মাটির পুতুল বানিয়ে খুব বাহবা পেয়েছিল মহাদেব। এবার সেই মাটির পুতুল বানাচ্ছে সে মৃণ্ময়ী মায়ের। যদি দুটো মূর্তিও বিক্রি হয় তাহলেই হাতে কিছু নগদ টাকা আসবে।
এখন:-
ভাঙা ঘরের দাওয়ার একপাশে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে মাটির তালকে বাঁশের কাঠামোর উপর মায়ের রূপ দিচ্ছিল এতদিন ধরে মহাদেব। ধীরে ধীরে জেগে উঠলো মাতৃ মূর্তি। ছড়িয়ে পড়েছে খুশি রং ভাঙা ঘরের দেওয়ালে।
বাইরে গিয়ে সবার সাথে খিচুড়ি ডিম খাওয়া নয় এবার ঘরেই টগবগিয়ে ফোটা গরম ভাতের খিদের গন্ধ আসবে। জোরে শ্বাস টানলো মহাদেব ভুলে যাওয়া সেই ফ্যানভাতের গন্ধ পেতে।
ঘুম ভেঙে শিশু কার্তিক একবার বাবার মুখ আর একবার প্রতিমার মুখ দেখছে…..