“অযৌক্তিক ” সফিক আহমেদ

“অযৌক্তিক “

সফিক আহমেদ
******
ক্যালগারি থেকে আমরা ৭টা ফ্যামিলি জামায়েত হয়েছিলাম Kananaskis Wilderness হোস্টেল এ
একরাত্রি কাটাবো পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে। সারাদিনের হৈহুল্লোড়ের পর রাত্রে হোস্টেল এর সামনে ক্যাম্পফায়ারের এর লেলিহান শিখা , চিকেন তন্দুরি আর ওয়াইন নিয়ে চলছিলো উল্লাস। ব্লু টুথ স্পিকার এ গমগম করে বাজছিলো চটুল হিন্দি গান। বেশ কিছুক্ষন বাদে ক্যাম্পফায়ারে এর নিভু নিভু আঁচে গান বন্ধ করে
শুরু হলো গল্পের আসর। ঠিক হলো লটারী তে যার নাম উঠবে তাকে বলতে হবে একটা সত্যি ঘটনা
যার ব্যাখ্যা যুক্তিতে মেলেনা।
কালো পোড়া কাঠের টুকরো দিয়ে মাটিতে দাগ কেটে লটারি করার পর নাম এলো শুভঙ্কর আর সুমনার।
শুভংকর বললো, ‘সুমনা খুব গুছিয়ে গল্প করতে পারে, ওকেই বলো বলতে’।
একটু পীড়াপীড়ি করতে সুমনা বলতে শুরু করলো,
‘আজ আমি এই অভিজ্ঞতার কথা প্রথম কারো সামনে বলছি কারণ আমরা নিজেরাই এর কোনো ব্যাখ্যা পাইনি’।
কথা শুরু করতেই আগুনের আঁচের আলোতে সুমনার মুখটা বেশ থমথমে লাগছিলো।
‘সেই নভেম্বর থেকে এপ্রিল, কানাডার ক্যালগারির কনকনে ঠান্ডা আর তুষারপাতে ঘরবন্দি থেকে হাপিয়ে উঠেছিলাম। কোথাও বেরিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রানী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে মে মাসের শেষ সপ্তাহের লং উইকেন্ড এর সুযোগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার kootenay ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে।
হঠাৎ করা প্রোগ্রামে খুব বেশি প্ল্যানিং করার সুযোগ হয়নি। আগের রাতে ইন্টারনেট খুলে দেখি সব থাকার জায়গা ফুললি বুকড। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পপুলার টুরিস্ট ডেস্টিনেশন,ভালো আবহাওয়া আর লং উইকেন্ড সব মিলিয়ে কোনো হোটেল, লজ , রিসোর্ট এ কোনো জায়গা নেই। নিরাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপন , নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশে Kootenay লেক এর ধারে Privately owned Riondel বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট , কয়েকটা ছবি আর একটা ফোন নম্বর। শেষ খড় কুটো
আঁকড়ে ধরার মতো একটা ফোন করতে অনেকগুলো রিং হওয়ার পর এক মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো। কাল এক রাত্রি থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে যান্ত্রিক স্বরে উত্তর এলো ‘চলে আসুন’। বুকিং অ্যাডভান্স বা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার ও নিতে চাইলোনা। নিরাসক্ত উত্তর, ‘আসুন আগে তারপর পেমেন্ট করলেই হবে’। এই বলেই ফোন কেটে দিলো , নাম ও জিজ্ঞাসা করলোনা। একটু খটকা লাগলেও এই ভরসাতেই পরদিন খুব সকাল সকাল কিছু টুকটাক খাবার , জল আর দুদিনের মতো কাপড় জামার ব্যাগ গুছিয়ে শুভঙ্কর আর আমি বসে পড়লাম গাড়িতে।
ক্যালগারি থেকে Riondel প্রায় সাত আট ঘন্টার ড্রাইভ। তাই বেশ সকালেই বেরিয়েছিলাম। প্রথম কফি ব্রেক Banff রিসোর্ট টাউন এর Tim হর্টন্স কফি শপ এ। সময় নষ্ট না করার জন্য ড্রাইভ ইন থেকেই কফি তুলে আবার পথ চলা শুরু। Banff ন্যাশনাল পার্কের লেক, রকি মাউন্টেন রেঞ্জ , Mt. Rundle আর Mt. Cascade এর চূড়া, অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে আর পুরোনো বাংলা গান শুনতে শুনতে
চার পাঁচ মাসের গৃহ বন্দিত্বর গ্লানি মুহূর্তে কেটে গেলো। এর পর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ছোট্ট শহর গোল্ডেন হয়ে প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম Revelstoke এ। Monashee আর Selkirk Mountain রেঞ্জ এর কোলে লুকিয়ে থাকা বিখ্যাত স্কি রিসোর্ট এর শহর revelstoke। এখানে মনোরম উইলিয়ামসন লেক এর ধারে বসে বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ , ডিম্ সিদ্ধ আর বাড়িতে তৈরী রসগোল্লা দিয়ে লাঞ্চ শেষ করে আবার যাত্রা। এখান থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় দুপুর একটা। riondel ৪/৫ ঘন্টার রাস্তা। মাঝে Upper Arrow লেক গাড়ি শুদ্ধ পেরোতে হবে shelter bay আর Galena bay Ferry তে। shelter bay পৌঁছে দেখি তখনি একটা ফেরি চলে গেছে। পরের ফেরি একঘন্টা পর। পরের ফেরিতে Gallena bay টার্মিনাল পৌঁছে আরো আড়াই ঘন্টা পরে পৌছালাম Kootenay লেক এর ধারে ছোট্ট শহরতলি Riondel। জিপিএস এর ধমক খেতে খেতে সেখান থেকে আরো ১০ km উত্তরে এ ঘন জঙ্গলের সরু মেঠো রাস্তা দিয়ে যখন রিসোর্ট এ পৌছালাম তখন প্রায় শেষ বিকাল।
দুদিকে দুটো কাঠের পোলের মাঝখান দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে যখন পার্ক করলো শুভঙ্কর , দেখলাম সামনে একেবারে লেক এর জলের ধারে একটা দোতালা পুরোনো বাড়ি আর বিশাল চৌহদ্দি। উত্তরে একটা চওড়া ক্রিক বা ঝোড়া দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে লেক এর দিকে। জলের ধারে তিন চারটে ডেক চেয়ার পাতা। শেষ বিকেলের নরম আলোতে এই দৃশ্য দেখে মনে হলো এতটা ড্রাইভ করে আসা সার্থক। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলেন এক অশীতিপর মহিলা তবে চালচলনে কোনো জড়তা নেই। সঙ্গে এলো দুটো পিটবুল টেরিয়ার বিশালাকার কুকুর। আমাদের চারধারে ঘুরে শুঁকতে লাগলো এই কুকর দুটো। এদের গায়ে বন্য পশুর বিকট গন্ধ। আমাদের অস্বস্তি দেখে মহিলা বললেন ‘এরা কিছু করবেনা। এদের কাজ ভাল্লুক তাড়ানো।’ একটু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আর কোনো গেস্ট আছে কিনা। দূরে আঙ্গুল উঁচিয়ে কম্পাউন্ড এর শেষ প্রান্তে একটা ভাঙাচোরা recreational vehicle RV দেখিয়ে বললেন ‘ওখানে এক কাপল থাকে , এছাড়া আমি আর আপনারা। আসুন আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই।’ আমাদের ছোট ব্যাগটা হাতে নিয়ে প্রায় ২০০ ফুট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকেই একটা বিশাল ড্রয়িং রুম আর ড্রয়িং রুম এর শেষ প্রান্তে একটা বেডরুম আর তার উল্টো দিকে দোতালার সিঁড়ি। ড্রইংরুম এ এদিক ওদিক ইতস্তত ছড়ানো হাড়ের টুকরো আর কিছু জন্তুর খুলি সাজানো শোকেসে এ। দেয়ালে বাইসন হেড stuff করে টাঙানো আর কিছু zombie মানে মৃত মানুষের ভয়ঙ্কর পেইন্টিং। সব মিলিয়ে একটা গা ছমছমে পরিবেশ। মহিলা আমাদের ঘর দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে থাকবেন আপনারা আর আমি থাকি এই সিঁড়ির উপরের দোতালায়।’ আমরা চেক করে দেখি দরজা লক করা যাচ্ছেনা। উনি বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। কেউ আসবেনা। আর রাত্রে যদি কোনো শব্দ শোনেন ঘাবড়াবেননা। মাঝেসাজে প্লাম্বিংয়ের শব্দ হয়। আর আমি এখন একটু শহরে যাবো গ্রোসারি কিনতে , ফিরতে রাত ১০টা বাজবে। আপনারা ফিরে এলে ঘরে ঢুকতে পারবেন,’। সব শুনে আর দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগছিলো। তবু পসিটিভ মাইন্ড এ এই সব অস্বস্তি কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে রাতের খাবার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা। উনি বললেন, ‘না আপনাদের Riondel এ গিয়ে খেয়ে আসতে হবে।’ তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে , আমরা ফিরে গেলাম Riondel এর একমাত্র রেস্তুৰেন্ট এ। পাওয়া গেলো ফিশ ফ্রাই আর smashed পটেটো। সারাদিনের ধকলের পর এই খাবার ই অমৃত লাগছিলো। তখন আর খুব একটা লোক নেই রেস্তুৰেন্ট এ। এক স্থানীয় ভদ্রলোক আর মহিলা আমাদের সাথে আলাপ করতে এসে আমাদের ইন্ডিয়ান দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কি যশোধরা আশ্রম এ এসেছেন।’ আমরা বললাম, “না আমরা Riondel রিসোর্ট এ এক দু রাত্রি থাকতে এসেছি।’ শুনে ওনারা একটু আশ্চর্য হয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘এই রিসোর্ট কি এখনো আছে ? শুনেছিলাম কয়েকটা দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে গেছে। যাই হোক এখন থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে যশোধরা আশ্রমে একবার ঘুরে যেতে পারেন।’ আমরা ও ভাবলাম এতদূর এসে এতো কাছে যশোধরা আশ্রম এ একবার ঘুরে ই যাওয়া উচিত। ***(ক্রমশ)**

সফিক আহমেদ
হিউস্টন, টেক্সাস , ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *