রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান নারী সমাজ **** মেরী খাতুন।

রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান নারী সমাজ
✍️ মেরী খাতুন।
উপলব্ধ সত্য এই-মনুষ্য পৃথিবীতে সৃষ্টিতে স্রষ্টার পরেই যাঁর স্থান, চরিত্র সৃষ্টির সেই রূপকার-‘বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ অন্তর্বিষয়ী ভাবের কবিত্ব থেকে বহির্বিষয়ী কল্পনালোকে তাঁর সদা সৃষ্টি ও কৌতুহলমুখী মন ছড়িয়ে পরে।
তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নারী। একদিকে যেমন নারীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে তাঁর লেখনী শক্তি ধার দিয়েছেন অন্যদিকে তৎকালীন সামাজিক অসঙ্গতিগুলো মূর্ত করে তুলেছেন বাস্তবতার আভাসে।
রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্র বড়ই বিচিত্র। প্রতিটি চরিত্র স্বতন্ত্রমন্ডিত,অনন্য। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য ভান্ডার। রবীন্দ্রসাহিত্যের উপন্যাস ও গল্পে আমরা পেয়েছি,’ঘরে বাইরে’, ‘চোখের বালি’,হৈমন্তী’,’দেনাপাওনা’,’গোরা’,নষ্টনীড়’,’চার অধ্যায়’,’শাস্তি’,’যোগাযোগ’, ‘স্ত্রীর পত্র’,’ল্যাবরেটরি’,’ ‘পয়লা নম্বর’ ‘নৌকাডুবি’ ইত্যাদি আরও অনেক অনেক গল্প এবং উপন্যাস।
এই প্রতিটি উপন্যাস ও গল্পের প্রতিটি চরিত্র সমাজের তথাকথিত বিবাহরীতি, সংসার ধর্ম, পণপ্রথা, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, নিপীড়নের মুখে এক একটি প্রতিবাদী রূপ।
‘স্ত্রীর পত্র’-গল্পে মৃণাল ও ‘পয়লা নম্বর’ গল্পে অনিলার সাংসারিক অসহনীয়তা তাদেরকে সংসার ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল। মৃণাল বিন্দুর প্রতি অত্যাচারের প্রতক্ষদর্শী ছিলো, বিন্দুর মৃত্যুর কারণ উপলব্ধি করতে তার অসুবিধা হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। নারী-পুরুষের সম্পর্ক যখন একটা অভ্যাসের হয়ে ওঠে-সেই সামাজিক প্রেক্ষিতে মৃণাল পুরনো মূল্য বোধের দায় মানতে অস্বীকার করে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে ওঠে। সংসারের প্রত্যেক সিদ্ধান্তে স্ত্রীর অংশগ্রহণকে না মেনে নেওয়া, অবহেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মৃণাল সংসার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে আত্মমর্যাদাবোধের কারণেই। গ্রামের মেয়ে মৃণাল আধুনিক, রুচিশীল, ব্যক্তিত্ব সম্পন্না ও গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী।মৃণাল যখন লিখছে,’আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমারা জানোনি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম।…সেখানেই আমার মুক্তি, সেখানেই আমি আমি।’ সে প্রমাণ করেছে সে শুধূ ‘মেয়ে মানুষ নয়,মানুষও বটে।’
অন্যদিকে ‘পয়লা নম্বর’ গল্পে অনিলাও গৃহত্যাগ করেছে স্বামী অদ্বৈতের উদাসীনতার কারণেই। শুষ্ক জ্ঞানচর্চাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত অদ্বৈতের জীবনবৃত্তে সাংসারিক প্রয়োজন ব্যতীত স্থান পায়নি অনিলা। অনিলা গোপন প্রেমে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারতো,জমিদার সীতাংশুমৌলীর সাথে চলেও যেতে পারতো।কিন্তু সে নিজেকে গোপন করে ফেলল স্বামী- সংসার থেকে।
রবীন্দ্রনাথের পণপ্রথাকেন্দ্রিক গল্প ‘দেনা পাওনা’। শ্বশুরবাড়িতে নিরূপমা অপমান লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ এবং পিতৃতন্ত্রের যাঁতাকলেপিষ্ঠ হতে হতে একদিন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।ফলস্বরূপ অকালে কুন্দ ফুলের মতো নিরূপমাদের পরপারে চলে যেতে হয়।
‘হৈমন্তি’ গল্পে সৎ আদর্শবাদী গৌরীশঙ্করের একমাত্র মেয়ে হৈমন্তী।গৌরীশঙ্কর লোভী অপুর বাবার সম্মতিতে হৈমন্তীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন।বিয়ের পর অবরুদ্ধ পরিবেশে হৈমন্তীর নতুন জীবন শুরু হয়। কিছুদিন পরে অপুর বাবা জানতে পারে গৌরীশঙ্করের অর্থের বিষয়ে যা শুনেছিলেন সবই মিথ্যা। বাবার আদর্শানুসারী হৈমন্তী ছলচাতুরী দূরে ঠেলে শ্বাশুড়ির শেখানো বুলিতে মোজে না থেকে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিধবা রমণী বিনোদিনী পারতো মহেন্দ্রকে নিয়ে ঘর করতে। বাল্য বিধবা বিনোদনীর প্রেমের স্বরূপ উন্মোচনে রবীন্দ্রনাথ যেমন নৈপূণ্য দেখিয়েছেন, তেমনি এই বিষয়টিকে নিয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাসক্ত, ফলে বিনোদনীর কাশী যাত্রা। সমাজনীতি বহির্ভূত প্রেমকে তিনি যেমন অস্বীকার করেননি তেমনি তাকে সমাজবৃত্তের মধ্যে প্রতিষ্ঠার দায়বদ্ধতাও অনুভব করেননি কখনও।
আবার, কুমুদিনী ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের প্রায় পুরোটা জুড়ে বিদ্রোহের চরম প্রতিমূর্তি হয়ে উপস্থিত ছিল। তবু সেই কুমুদিনী তার স্বামী উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদন ঘোষালের দাম্পত্য-ধর্ষণের মার সয়েছে। দাম্পত্য-ধর্ষণের যে সন্তান তার গর্ভে এসেছে তাকে নিয়ে কুমু দাদার ঘরে চলে গিয়েও সে আপোস করেছে স্বামী মধুসূদনের সংসারে ফিরে যেতে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি একটি সামাজিক উপন্যাস যেখানে দুটি ভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন দিক এবং মানুষের সম্পর্কের পার্থক্য ও জটিলতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্প বধূ নির্যাতনের দলিল হয়ে আছে।পুরুষ প্রাধান্য সমাজে নারীর শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাধার মৃত্যুকে আজও মেনে নিতে পারে না। রাধার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমাদের অশিক্ষা, নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থা। এ গল্পে রাগের বশে বড় ভাই তার স্ত্রী রাধাকে মেরে ফেলে এবং সেই দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় ছোট ভাইয়ের বৌ চন্দরার উপরে। স্বামীর এ কথা শোনার পরে চন্দরা স্তব্ধ হয়ে যায়।স্বামীর প্রতি এতদিনের ভালোবাসা সবই ধূলায় মিশে যায়। সে কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারতো। করে নি, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকেই মেনে নিতে হয় চন্দরাকে। চন্দরার ফাঁসি হয়।
“নৌকাডুবি’ উপন্যাসে আবার নৌকাডুবির শিকার হয়ে না জেনেই কমলা রমেশকে স্বামী রূপে বরণ করে তাকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু প্রকৃত সত্য উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গেই সে নলীনাক্ষ অর্থাৎ তার সমাজ নির্দিষ্ট স্বামীকেই বরণ করে নিতে পেরেছে অনায়াসে। এখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রেমের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে সামাজিক সম্পর্ক।
‘ঘরে-বাইরে’ নিখিলেশ, বিমলা ও সন্দীপ-এই ত্রিকোণ সম্পর্কের ভিত্তিতেই উপন্যাসের প্রেক্ষাপটটি রচিত।নিখিলেশের মনে, তার স্ত্রী বিমলাকে আধুনিক যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর গড়ে তোলবার প্রচেষ্টা এবং তাকে বৃহৎ বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা বর্তমান ছিল।নিখিলেশ ও বিমলার দাম্পত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে বিমলার মনে সন্দীপের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। এবং পরে নিখিলেশ ও বিমলার সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে । যদিও পরবর্তীকালে বিমলা স্বেচ্ছাতেই সে পথ থেকে সরে এসেছিল। ফলে বিমলার নিজের পছন্দ এবং স্বাধীনতা,যা তাকে ঘর ও বাইরের মধ্যে দ্বিধা-সংকটে ফেলে।
‘ল্যাবরেটরি’-র সোহিনী চরিত্র গুলির মধ্যেই নিহিত আছে রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনার প্রকৃত স্বরূপ। ল্যাবরেটরি গল্পে এক ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা সোহিনীর নন্দকিশোরের সঙ্গে চলে আসা এবং সামাজিক ধর্মীয় রীতিনীতিকে অস্বীকার করে নন্দকিশোরের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার কারণ হয়েছিল একদিন।
রবীন্দ্র সৃষ্ট ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চারুলতা ধনী গৃহবধূ। কোনও অভাব ছিল না, শুধু অভাব সাহচর্যের। স্বামীর মানসিক সমর্থন। কাগজের আবরণ ভেদ করে স্বামীকে পাওয়া তার পক্ষে ছিল দুরূহ। চারুর স্বামী রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনে তৎপর, স্ত্রীর প্রতি অবদমনের নীতি গ্রহণ করেছেন তা উপলব্ধিতেই আসেনি।ফলস্বরূপ শারীরিক মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ ও বঞ্চিত চারু আঁকড়ে ধরে অমলকে। সেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে, চারুলতার অবদমন আর মানসিক নির্যাতনকে বাস্তবায়িত করে। অগ্রাহ্য বা অবহেলার ফুটে ওঠা ছবি সত্যিই নির্মম। অবাক পুরুষতন্ত্র!!
‘মানভঞ্জন’-এর গিরিবালার সৌন্দর্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে’…আকস্মাৎ আলোকরশ্মির ন্যায়, বিস্ময়ের ন্যায়…একেবারে চকিতে আসিয়া আঘাত করে এবং এক আঘাতে অভিভূত করিয়া দিতে পারে’। এই গিরিবালার প্রতিও স্বামী গোপীনাথ আকর্ষণহীন। নেই তার ভিতর সামান্যতম ভালোবাসা। কিন্তু ছিন্ন বন্ধন গিরি মুখবুজে মার খায় নি, অভিনব পন্থায় স্বামীর অবহেলার প্রতিদান দিয়ে গিরিবালা এক অনন্য প্রতিবাদী নারী হয়ে উঠেছে রবীন্দ্র-কথা সাহিত্যে।
কোথাও গিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতাকামী রবীন্দ্রনাথের নায়িকারা এক হয়ে গেছে। এক হয়ে গেছে সকলের চাওয়া-এক প্রতিবাদী নারী হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় সেকাল নয়-একালের নারীর নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তাধারার প্রেক্ষাপটে তাদের নির্মাণ করেছেন। নারী-আত্মপ্রত্যয়, আত্মগরিমায় উজ্জ্বল।
রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের ‘হৃদয়ের সৌন্দর্যে’ বিশ্বাস করতেন। মেয়েরা তাদের কল্যাণকামী সত্ত্বাকে বিসর্জন না দিয়েই ঘরে বাইরে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম-কবির এই প্রতীতিতে মেয়েরা অনেকাংশেই সত্যে পরিণত করেছে, আর এটাই ভারত তথা বাংলার নারীদের তাদের প্রাণের কবিকে দেওয়া সব থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য।