আমার ভাবনায় “অমল ও দইওয়ালা” **** কলমে ও ভাবনায় রাই প্রিয়া —-

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের —
” অমল ও দইওয়ালা”
আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অমল কেমন আছে? আমার ভাবনায় “অমল ও দইওয়ালা”
—————————————————————–
কলমে ও ভাবনায় রাই প্রিয়া —-
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাটক ” অমল ও দইওয়ালা” ( মূল নাটক – “ডাকঘর”) ১৯১২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, নাটকের নাম “ডাকঘর” , সেখানে ” অমল ও দইওয়ালা” অংশটি বিশেষভাবে পরিচিত হৃদয়গ্রাহী অংশ, যেখানে দইওয়ালার সঙ্গে অমলের সংলাপ নাটকের কেন্দ্র বিন্দুতে আবেগের সুর বেঁধে দেয়।
রবীন্দ্রনাথের অমল শুধু একটি নাম নয়, এক বিমূর্ত স্বপ্নসত্ত্বা , যার অসুস্থ শরীর ক্লান্ত হলেও , চেতনা অতল অশান্ত। তাঁর দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয় – দূরাগত আলো, চাঁদপুরের নদী, অচেনা পাহাড়ী ডাকঘর , এবং এক রহস্যময় আগন্তুকের প্রতীক্ষা। তাঁর জগৎ জানালার ওপারের সীমাহীনতা ।যেখানে মন উড়ে চলে অসুস্থ শরীরের সীমা ভেঙে। তাঁর আকাঙ্ক্ষা রাজপুত্র হোতে গরীব রাখাল, আকাশ ছোঁয়া ঐশ্বর্য থেকে মাটির গন্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর ইচ্ছেগুলো শিশুর মতো – একটু দই, একটু গল্পের আশ্রয় ও নিখাদ ভালোবাসার পরশ ।
আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অমল কেমন আছে? আজ ও কি অমল বসে থাকে জানালায় চোখ রেখে ?
অমল আজও জীবিত আমাদের সন্তানদের কৌতূহলী চেতনার মধ্যে। আজকের অমল জানালার ধারে নয়—
সে আসীন ডিজিটাল পর্দার সম্মুখে।
তার জানালা এখন একটি স্মার্ট স্ক্রিন,
যেখানে সে গুগল ম্যাপে পরিভ্রমণ করে,
ইউটিউবে অন্বেষণ করে অজানার সুর,
আর কৃত্রিম বাস্তবতায় রচনা করে স্বপ্নের প্রান্তর।
সে বলে না, “দইওয়ালা আসবে তো?”
বরং জিজ্ঞাসে, “চাঁদপুর থেকে ফুড ডেলিভারি আসবে তো আজ”? আজকের অমল দই নয় , বিভিন্ন flavour এর ice cream খোঁজে।
তার ভাষা বদলেছে, কিন্তু অনুভবের অন্তঃসলিলা রয়ে গেছে সেই পূর্বতন।
আজকের অমল চিঠি লেখে না;
সে হোয়াটসঅ্যাপে টাইপ করে অনুভূতি—
আবার তা মুছে দেয়, সংশয়ে।
কিন্তু তার হৃদয়ের সেই উন্মেষ,
জানালার ওপার দেখার অদম্য তৃষ্ণা—
তা তো আজও অপরিবর্তিত।
রবীন্দ্রনাথ, তোমার সেই অমল আজও বেঁচে—
মফস্বলের কোনো স্কুলঘরে,
অথবা শহরের কোনো কাঁচা ছাদে,
অনলাইন ক্লাসে লগ-ইন করা এক ক্লান্ত চোখে,
সে আজও জিজ্ঞেস করে—
“পিসেমশায়, আমি কি যেতে পারি
সেই সব দূর পাহাড়ি দেশে,
যেখানে নীলচে কুয়াশা নামে?”
আজকের অমলের খেলা হয় ভার্চুয়াল,
তার স্বাদ হয় ফ্রোজেন ডেজার্ট,
তবুও, তার চাওয়ার গভীরে লুকিয়ে থাকে
একটি নির্মল, অস্পষ্ট নীলিমা—
যা কেবল কবিগুরুর হৃদয়েই ধ্বনিত হয়।
তুমি জানো, রবীন্দ্রনাথ—
অমলের স্বপ্ন কোনও যুগচক্র মানে না,
সে কেবল মাধ্যম বদলায়—
তাতে তার স্বপ্নের দীপ্তি ম্লান হয় না।
আচ্ছা আমি যদি অমল হতাম —
——————————————-
আমি যদি অমল হতাম তবে হয়তো আজও জানালার ধারে বসে থাকতাম—
এই ইট-কাঠের শহরের মাঝেও,
একটুখানি আকাশ খুঁজে ফিরতাম ভবনের ফাঁকে ফাঁকে।
হয়তো স্কুলের ভার্চুয়াল ক্লাসে মন বসতো না,
মন চলে যেত দূরের কোনো চাঁদপুরে—
যেখান থেকে এখন আর দইওয়ালা নয়,
আইসক্রিমওয়ালা আসে নীল ব্যাগ পিঠে করে।
আমি যদি অমল হতাম,
তবে বুঝতে পারতাম—
স্বপ্ন দেখা আসলে কোনো যুগের সঙ্গে জড়িত নয়,
তা শুধু হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলে।
ডাকঘরের মতই আজও চারপাশে এক অদৃশ্য দেওয়াল,
যেখানে মানুষ থাকে, কিন্তু মনের কাছে পৌঁছায় না।
তবুও যদি আমি অমল হতাম,
তবে হয়তো বিশ্বাস করতাম—
একদিন সেই দেওয়াল পেরিয়ে,
কারও না কারও কণ্ঠে শোনা যাবে—
“আমি এসেছি, অমল, তোমার জন্য।”
কারণ অমল হওয়া মানেই তো—
আশা ধরে রাখা,
অপেক্ষা করে যাওয়া,
অন্ধকারের মধ্যেও আলো খোঁজা।
তাই যদি আমি অমল হতাম,
তবে আমি হেরে যেতাম না—
আমি স্বপ্ন দেখতাম।
আমি ভালোবাসতাম।
আমি জানালার ধারে আজও বসে থাকতাম।
অমলের মৃত্যু হয় নাটকের শেষে,
কিন্তু আমরা জানি—সে সত্যিই মরেনি।
সে চলে গেছে আরেক জানালায়,
যেখান থেকে ফেরে না কেউ,
তবু তার চিঠি রয়ে যায় আমাদের হৃদয়ের ডাকঘরে।
আজও যখন কোনো শিশু একলা জানালার ধারে বসে
আকাশের দিকে চেয়ে কিছু ভাবে,
আমরা চুপিচুপি বলি—
“অমল, তুমি আবার এসেছ?”
অমল বেঁচে থাকে—
প্রতিটি নির্ভেজাল স্বপ্নে,
প্রতিটি অভিমানী অপেক্ষায়,
আর প্রতিটি শিশুমনের নির্ভীক ডাকে।