প্রবন্ধ *** ধারা *** ভৌমিক ভাদুড়ী **** প্রতিবাদ

প্রবন্ধ
ধারা ভৌমিক ভাদুড়ী
প্রতিবাদ
” ওরে তুই ওঠ আজি !
আগুন লেগেছে কোথা ?
কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি জাগাতে জগৎজনে ?
কোথা হতে ধ্বনিতেছে ক্রন্দনে শূন্যতল ?
কোন অন্ধকারা মাঝে জর্জর বন্ধনে অনাথিনী মাগিছে সহায় ? ” ( চিত্রা – এবার ফিরাও মোরে – প্রকাশিত ১৮৯৬ সাল )
প্রতিবাদ হলো রাজনৈতিক সুবিধার বিরুদ্ধে আপত্তি , অসম্মতি বা ভিন্নমতের প্রকাশ্য একটি কাজ l প্রতিবাদ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে ব্যক্তিগত বিবৃতি থেকে শুরু করে ব্যাপক রাজনৈতিক বিক্ষোভ l প্রতিবাদ হতে পারে সরকারি নীতি , অর্থনৈতিক পরিস্থিতি , ধর্মীয় গোড়ামী ও সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে l বিশিষ্ট দার্শনিক কার্ল মার্ক্স শ্রেণী সংগ্রাম কেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন l অনেক সময় প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীকে মোতায়েন করা হয় এবং প্রতিবাদীরা তাতে বাধা দেন l শাসকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ গুলি প্রকাশ্য ‘নাগরিক অবাধ্যতা ‘র রূপ ধারণ করতে পারে l
হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদের এক মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি মনু l ‘মনুসংহিতা’ যদি এই মুনিরই রচনা হয় তাহলে তার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল l সেই তখনই তিনি লিখে গেছেন , প্রয়োজনে স্ত্রীকে প্রহার করা যাবে এবং কি ভাবে প্রহার করতে হবে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন – ” রজ্জু প্রভৃতি দ্বারা প্রহার যদি করিতে হয় তাহলে শরীরের পশ্চাদ ভাগে প্রহার কর্তব্য , কখনো উত্তমাঙ্গে বা মাথায় যেন প্রহার করা না হয় ۔۔۔۔” l ঋকবৈদিক যুগের ( খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ – খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী – প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ – সুকুমারী ভট্টাচার্য্য )
বিদুষী নারী গার্গী বাচুক্লোভি ও বেশ কিছু বিদ্বান ব্যক্তি ঋষি যাজ্ঞবল্কের সাথে তর্ক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন l
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জিতলে পুরস্কার স্বরূপ পাওয়া যাবে ১০০০ গাভী এবং গাভীদের۔ শিং এ ঝোলানো দশগ্রাম করে সোনা ও অন্যান্য সম্পত্তি l যাজ্ঞবল্ক শিষ্যদের নিয়ে বিতর্ক সভায় এলেন এবং শিষ্যদের আদেশ দিলেন , গাভী সহ যাবতীয় সম্পত্তি তার আশ্রমে যেন নিয়ে যাওয়া হয় l বিদুষী গার্গী যাজ্ঞবল্কের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন – আগে বিতর্ক পরে পুরস্কার l পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে সেই প্রথম এক নারীর তীব্র প্রতিবাদ l বিতর্ক সভায় যাজ্ঞবল্কের কাছে গার্গীর শেষ প্রশ্ন প্রশ্ন ছিল – ব্রহ্মের উপকরণ কি ? গার্গীর জ্ঞানের পরিধির স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্যে ক্ষিপ্ত হয়ে যাজ্ঞবল্ক যাজ্ঞবল্কের প্রতিবাদ ,
“স্তব্ধ হন ভদ্রে ” l
প্রফেসর ক্ষুদিরাম দাস লিখেছেন , বিশ্বের প্রথম প্রতিবাদ বাক্য উচ্চারিত হয়েছিল আদি কবির কণ্ঠে , ক্ৰৌঞ্চ হত্যার রূপকে- মা নিষাদ l প্রকৃতপক্ষে এক নারীকে লুটে নেওয়ার পণ্যসামগ্রী হিসাবে বিবেচনা করেছিল যে বর্বর তার বিরুদ্ধে l ক্রমে সে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল দিক দিগন্তে , কালে কালে কাব্য নাটক গানে – রাজপ্রাসাদ থেকে পর্ণকুটিরে l শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেল – নিষাদ বন্ধু রাম , প্রজাতান্ত্রিক রাম , অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচন্ড কালান্তক রাম মানুষের স্বপ্ন কে অধিকার করে বিলীন হয়ে পড়লো ধর্মের মধ্যে l
ঐতিহাসিকদের মতে , খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের ঠিক আগে ভারতে ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়দের মধ্যে আঁতাত হল , বৈশ্য ও শূদ্ররা হল নিচু জাতি l জাতি বর্ণের বিভেদ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে শোষণ করার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হলো l এই সময় বর্ধমান মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ যথাক্রমে জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঘটালেন l তাঁরাই কঠোর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে , পশুহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদী আন্দোলন’ শুরু করেছিলেন l একসময় ভক্তিবাদের উত্থান ঘটলো – এলেন শ্রীচৈতন্যদেব , কবির , নানক l কিন্তু দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার , মাৎস্যন্যায় – সমস্ত ধরণের প্রতিবাদ কে চুপ করিয়ে দিল l সোচ্চার হল ধনী ও শক্তিমানদের নৃশংস আস্ফালন l
রায় গুনাকার ভারতচন্দ্র ১৭৫২ সালে অন্নদামঙ্গল কাব্যে – ফুল্লরাকে প্রতিবাদী নারী হিসাবে চিত্রিত করেছেন l ‘ কালকেতু ফুল্লরা ‘ উপাখ্যানে – ফুল্লরা বলছেন কালকেতুকে –
” আজি হইতে বিধাতা হৈলো মোর বাম l
তুমি হৈলা রাবন বিপক্ষ হৈল রাম l
পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে l
কাহার ষোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে ll ”
স্বামীর পরকীয়ার বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ l
এর অনেক আগে দেশে পাঠান ,মোগল , ইউরোপীয় কোম্পানিরা এসেছে l ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছে l ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এক বলিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবাদের নাম মঙ্গল পান্ডে , একজন দেশীয় সিপাহী l সিপাহীরা ছিল হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে কোম্পানির উর্দি হীন স্থানীয় সৈন্য l কোম্পানিতে ছেয়ানব্বই শতাংশ ছিল ভারতীয় সৈন্য ,কোম্পানির নিজস্ব সৈন্যদের সাথে বেতন ও মানসম্মানের ক্ষেত্রে দেশীয় সিপাহীদের বিশাল পার্থক্য ছিল l সেখান থেকেই সিপাহীদের মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে উঠেছিল l ১৮৫০ এর দশকের মাঝামাঝি গ্যারিসনে যখন মঙ্গল পান্ডেকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল তখন ব্যারাকপুরে নতুন এনফিল্ড রাইফেল এসেছিল l রাইফেলে গুলি ভরার জন্য সৈনিকদের গ্রীস যুক্ত কার্তুজের প্রান্তগুলি দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে হত l এই সময় রটনা শোনা যায় – ওই কার্তুজের মোড়ক গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরী l স্বভাবতই হিন্দু মুসলিম দেশীয় সিপাহীরা নিজেদের জাত হারানোর ভয়ে সেটি দাঁত দিয়ে ব্যবহার করতে রাজি হলোনা l
মঙ্গল পান্ডে প্রথম এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার করতে অস্বীকার করে l সেদিন ২৯ শে মার্চ ১৮৫৭ সাল , সিপাহী মঙ্গলপান্ডের ওপর যেন কোনো দেবতা ভর করেছিল l চিবুক আকাশের দিকে তুলে গুলিভর্তি বন্দুক হাতে সামনে পেছনে পায়চারি করছিল সে , ড্রামার কে ড্রাম বাজিয়ে সকলকে জড়ো করতে বলেছিল l বলেছিল ইউরোপ থেকে ম্যাগাজিন এসেছে , নতুন কার্তুজ দাঁতে কেটে ভরতে হবে l ওরা আমাদের ধর্ম নাশ করতে চায় , সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে l এটাই আঠারোশো সাতান্ন সালের প্রথম প্রতিবাদ সিপাহী বিদ্রোহের আহবান l
মৃত্যুদণ্ডের দশদিন আগেই মঙ্গল পান্ডে কে ফাঁসি দেওয়া হয় l
উনিশ শতকের তথাকথিত রেনেসাঁসের সমান্তরাল ঘৃণ্য জাতি বর্ণ সম্বলিত যে রক্ষণশীলতার আবর্জনা দেশে স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছিল তারই বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর l ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ প্রথম জানাল যে , কবির আত্মলীনতা থেকে মোহমুক্তি ঘটেছে l কবি লিখলেন – ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা আঘাতে আঘাত কর ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখি ۔۔۔۔’ l একবার স্বাদেশিক এক অভিজাত গোষ্ঠীর মেলায় কবিকে সবাই গান গাওয়ার অনুরোধ করলে কবি গানের মধ্যে দিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান –
” আমায় বোলোনা গাহিতে বোলোনা ,
একি শুধু হাসি খেলা , প্রমোদের মেলা , শুধু মিছে ছলনা ۔۔۔l ”
রাজনৈতিক প্রতিবাদ বিভিন্ন রূপ নিতে পারে অহিংস বা সহিংস I অহিংস এর মধ্যে পিটিশন , সংবাদপত্রের নিবন্ধন , শিল্পকর্ম , ধর্মঘট ,শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রয়েছে l অনেক সময় পুলিশ প্রতিবাদীদের নানা ভাবে বাধা দেন , এই ধরনের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ গুলি প্রকাশ্য নাগরিক অবাধ্যতার রূপ ধারণ করতে পারে l যেমন ,
৬ই এপ্রিল ১৯৩০ সালে গান্ধীজী তিনশত অষ্টআশি কিলোমিটার পায়ে হেঁটে উপকূলীয় গ্রামের ডান্ডিতে পৌঁছেছিলেন۔l গান্ধীজির ডান্ডি অভিযান ছিল ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব আদায়ের জন্য লবন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি মিছিল l মিছিলটি ভারত জুড়ে ব্রিটিশ “আইনের অবাধ্যতা ” করেছিল l ব্রিটিশ পুলিশ অত্যাচারের মাধ্যমে আন্দোলন বন্ধ করেছিলেন l ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে “তলোয়ার” জাহাজের মাথার ওপর থেকে
” ইউনিয়ন জ্যাক ” টেনে নামিয়ে তেরঙ্গা পতাকা উড্ডীন করা ছিল – ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌসেনা বাহিনীর শেষ তীব্রতম প্রতিবাদ l
আমাদের বিবেক যেকোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে l কিন্তু সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের প্রতিবাদের পথ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে l ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ১০০ জনই বলবে এটা অন্যায় অথচ টাকার বিনিময়ে চাকরি নেবো না এ কথাটাও আমরা বলতে পারছি না l সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিনের খবরে উঠে আসা প্রতিহিংসা ও জৈব কামনা বাসনার যে বিকৃত রূপ আমরা দেখছি তা অহরহ সংবেদনশীল মানুষকে তাড়িত করছে l
তবু ‘না’ বলতে না পারা আমাদের সব থেকে বড় দুর্বলতা l মানুষ তার অস্তিত্ব বিক্রি করছে অথচ বিপুল শক্তির অধিকারী এই ‘না’ উচ্চারণের জন্য শুধু প্রয়োজন নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী সাহস l
প্রতিবাদের অধিকার , প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার , সরকারকে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রাজী করানোর অধিকার – ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী এ সবই মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে۔l ‘প্রতিবাদ’ তার নিজস্ব ঢঙে চিরকাল ছিল আছে ও থাকবে l
“অগ্রপথিক” কবিতায় বিদ্রোহী কবি লিখেছেন –
“নেমেছে কি রাতি ফুরায় না পথ সুদুর্গম ?
কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম !
বসেনে খানিক পথ- মঞ্জিলে ভয় কি ভাই ?
থামিলে দুদিন ভোলে যদি লোকে ভুলুক তাই !
মোদের লক্ষ্য চির অটল , অগ্রপথিক ব্রতীর দল ,
বাঁধরে বুক চল রে চল l”
***