রবীন্দ্রনাথ : সর্বাঙ্গসুন্দর এক বিস্ময় *** কলমে কৃষ্ণা সেন।

রবীন্দ্রনাথ : সর্বাঙ্গসুন্দর এক বিস্ময়
কলমে কৃষ্ণা সেন।
যে মানুষটি একাধারে কবি, গায়ক, সুরকার, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক—তাঁকে কি কোনও এক নামে ডাকা যায়? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে শুধু নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নন, তিনি এক অনন্ত পথের দিশারী, এক শাশ্বত আলোর উৎস।
“আমার এ পথ চাওয়াতেই আনন্দ”—এই পংক্তি যেন তাঁর নিজের জীবনের মানে।
তিনি আমাদের শেখান, জীবন কেবল বেঁচে থাকার নাম নয়, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সৌন্দর্য খোঁজার সাধনা। তাঁর কবিতায় যেমন প্রকৃতি, তেমনি প্রেম, তেমনি প্রার্থনা। তাঁর গানে যেমন বেদনা, তেমনি আশাবাদ। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি যেন জীবনের এক নতুন পাঠ।
“জীবনেরে করিব ধন্য, জীবনেরে ভালবাসিব”—এই বাক্যে তাঁর বিশ্বাস, তাঁর বোধ।
তিনি যখন লেখেন—
“হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণে…”
তখন আমরা টের পাই, নতুনের প্রতি তাঁর আহ্বান কেমন করে শতাব্দীর পর শতাব্দী তরুণ মনকে জাগিয়ে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ শুধুই বাংলা ভাষার নয়, তিনি মানবজাতির কবি। শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তিনি গড়েছেন এমন এক শিক্ষা-স্বপ্ন, যেখানে জ্ঞান শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, আত্মাকে জাগ্রত করার জন্য।
তিনি আমাদের বলেছিলেন—
“তোমরা যাহা কর, মন দিয়া কর। ভালবাসিয়া কর। তাহাতে জীবনের স্বাদ থাকে।”
তাঁর কবিতায় যেমন প্রেম ও প্রকৃতি, তেমনি আছে প্রতিবাদ ও প্রতিবিম্ব।
যখন তিনি ‘আফ্রিকা’ কবিতায় কাঁপা গলায় উচ্চারণ করেন
“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে প্রদোষ কাল, ঝঞ্জা বাতাসে রুদ্ধশ্বাস
যখন গুপ্ত গহবর থেকে পশুরা বেরিয়ে এলো অশুভ ধ্বনিতে
ঘোষণা করলো দিনের অন্তিম কাল
এসো যুগান্তের কবি
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মি পাতে দাড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে
বলো “ক্ষমা করো ”
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্য বানী।”
—তখন তিনি হয়ে ওঠেন নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর, সাম্রাজ্যবাদ আর সভ্যতার নামধারী বর্বরতার বিরুদ্ধে এক অমোঘ প্রতিবাদ।
এই মানুষটির মধ্যে এমন এক বিস্ময় ছিল, যার গভীরতা মাপা যায় না। আমরা যখন তাঁকে পড়ি, শুনি, দেখি—তখন তিনি আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন করে ভাবতে শেখান।
তিনি রূপ দিয়েছেন বাংলার বসন্তকে, ছায়া দিয়েছেন বৃক্ষের, কণ্ঠ দিয়েছেন নদীকে, আর ভাষা দিয়েছেন আমাদের হৃদয়কে। তাঁর সৃষ্টি আমাদের ভেতর আলো জ্বালায়, আমাদের সাহস জোগায়, আমাদের চোখে স্বপ্ন আনে।
এই জন্মজয়ন্তীতে তাঁকে শুধু স্মরণ নয়, তাঁকে বরণ করা দরকার—প্রতিদিনের চিন্তা, চেতনা ও চর্চায়।
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”—
এই আহ্বান আজও পৃথিবীর প্রতিটি সচেতন হৃদয়ের স্পন্দনে ধ্বনিত হয়।
শ্রদ্ধা, প্রণাম, ভালবাসা—রবীন্দ্রনাথ, তুমি আমাদের অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।